শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৫ অপরাহ্ন

আঁধারে মুখ ঢেকেছে ঝিলম পাড়ের ‘জান্নাত’

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯
  • ৩২৬ বার

‘‘ইয়ে ঠিক নেহি হুয়া। ইয়ে ধোঁকা হুয়া হামারে সাথ।’’

শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে লাল চক। ডাল লেক থেকে ডাউনটাউন। ঘুরে ফিরে একই কথা।

বৃহস্পতিবার ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মির এবং লাদাখ পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। জম্মু-কাশ্মিরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে গিরিশচন্দ্র মুর্মু এবং লাদাখের লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে শপথ নিয়েছেন রাধাকৃষ্ণ মাথুর। এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবারও বলেছেন, এ বার কাশ্মিরে উন্নয়নের জোয়ার বইবে।

কিন্তু উপত্যকা জুড়ে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে একটাই প্রশ্ন যেন পাক খাচ্ছে—৩৭০ রদ হলো, রাজ্যের তকমা কেড়ে নেয়া হলো। কেউ আমাদের মতামতও জানতে চাইল না। এটা কি ঠিক? এটা ধোঁকা নয়? মনে এই প্রশ্ন নিয়ে আঁধারে মুখ ঢেকেছে ঝিলম পাড়ের ‘জান্নাত’।

৫ অগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের পর থেকে প্রশাসনের নির্দেশে শ্রীনগরের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ ছিল। তার পর প্রশাসন দোকানপাট খুলতে বলছে। কিন্তু কাশ্মিরি ব্যবসায়ীরা দোকান খুলছেন না। সকালে নিত্যপ্রয়োজনের জিনিসপত্রের দোকান খুলছে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। তার পর সব বন্ধ। সন্ধ্যা নামলে শ্রীনগর যেন অন্ধকার মরুভূমি।

“আমরা কি হাতের পুতুল? যখন দোকানবাজার বন্ধ রাখতে বলবে, বন্ধ রাখব, খুলতে বললে খুলব?”—লাল চকে মোবাইলের দোকানের মালিকের প্রশ্ন শুনে থমকে যেতে হয়। এ তো প্রায় ‘সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স’? পাল্টা জবাব আসে, “স্বাধীনতার আগে গান্ধীজি এই আন্দোলন করেছিলেন। এটাও ধরে নিন তেমনই।’’

শ্রীনগরের অন্যতম পুরনো হোটেলের মালিকের গলায় ক্ষোভ, “উন্নয়ন আনতে গিয়ে তো পুরো পর্যটনের মরসুম চৌপাট হয়ে গেল। অগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর—এই তিন মাসেই তো পর্যটকেরা কাশ্মিরে আসেন। গত তিন মাসে তো হোটেলে সাংবাদিকেরা ছাড়া আর কেউ এসে থাকেননি”। ‘ট্যুরিস্ট সিজন’-এ ডাল লেকের শিকারাওয়ালাদের মাসে অন্তত ৩০ হাজার রুপি আয় হবেই। এ বার? খালি হাত। ডাল লেকের ভাসমান বাজারে মুক্তোর গয়না বেচে রোজগার করা কাশ্মিরি যুবকের গলায় অন্য ক্ষোভ, “গোস্ত না হয় খেলাম না। গাজরের সবজিই খাব। কিন্তু ওরা তো মনের শান্তিটাই কেড়ে নিলো।’’ ডাল লেকের হাউসবোট মালিকের প্রশ্ন, “জম্মু-পাঞ্জাব-হরিয়ানা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে না কি এখানে জমি কিনবে। তারাও কি হাউসবোট নামাবেন?”

মুখ খুললেই ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে। কিন্তু লাল চকের দোকানদার থেকে ডাল লেকের শিকারাওয়ালাদের একটাই অনুরোধ—নামটা লিখবেন না। সন্ধ্যাবেলা এসে তুলে নিয়ে যাবে। পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট-এ ভিতরে ঢুকিয়ে দেবে।

সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্তাদের যুক্তি, আসলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সদস্যেরা (যা বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিল প্রশাসনও)। বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই দোকানবাজার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিচ্ছে। বাস-ট্যাক্সি চলতে দিচ্ছে না। ট্যাক্সি, মালবাহী গাড়ি দেখলে পাথর ছোড়া হচ্ছে। স্কুল খোলা হলেও ছেলেমেয়েদের পাঠাতে বারণ করছে। তা না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিকই রয়েছে। চালু হয়ে গিয়েছে ল্যান্ডলাইন টেলিফোন, পোস্টপেড মোবাইল। ডাল লেকের হাউসবোট মালিকের প্রশ্ন, “সব স্বাভাবিক যখন, ইন্টারনেট চালু হচ্ছে না কেন? মোবাইল চললেও এসএমএস বন্ধ কেন? মোবাইল চালু হওয়ার পরও তো গন্ডগোল হয়নি!”

তবে পাথর ছোড়ার ভয় যে নেই তা নয়। লাল চক ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের অধিকাংশ গাড়িই হলুদ নম্বর প্লেট বদলে সাদা নম্বর প্লেট লাগিয়ে ফেলেছে। যাতে দূর থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি বলে মনে হয়। অনেক টেম্পো-মিনি ট্রাকের মতো পণ্যবাহী গাড়ির পিছনের নম্বর প্লেট হলুদ রঙের, সামনের নম্বর প্লেট সাদা। গাড়ির চালকদের জবাব, ‘‘পাথর ছোড়ার ভয় রয়েছে ঠিকই। কিন্তু যারা ছুড়ছে, তাদেরই বা দোষ কী? আমরা কেউই তো সিদ্ধান্তটা মানতে পারছি না।’’ ঘটনা হলো, প্রশাসন এখন পর্যটকদের কাশ্মীরে আসতে বলছে। বিজেপি নেতারা বলছেন, সন্ত্রাসবাদীদের বেছে বেছে হত্যা করা হবে। কিন্তু ট্যাক্সি চালক থেকে হোটেল ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, দোকানপাট বন্ধ থাকলে কোন পর্যটক কাশ্মিরে আসবেন?

প্রশ্ন একটাই। এ ভাবে কত দিন চলবে? কাশ্মিরিরা কি ধীরে ধীরে মেনে নেবেন? না কি জমতে থাকা ক্ষোভ বেরিয়ে পড়বে? অন্য কোনোভাবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com