পীর সাররাযির পেশা এখন কাঙালি। এ বাড়ি থেকে ওবাড়ি, এ দুয়ার থেকে ও দুয়ারে ভিক্ষা চেয়ে বেড়ান। একদিন তিনি এক আমিরের প্রাসাদে গেলেন। তখন তার কাঁধে ঝুলি, গায়ে আলখেল্লা, আর মুখে শাইয়ান লিল্লাহ (আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দিন)। কামেল লোকদের এমন আচরণের রহস্য বোঝা বড় কঠিন। বড় বড় জ্ঞানীরাও এর হেতু অনুসন্ধানে দিশেহারা হয়ে যান। বিরক্ত হয়ে আমির বললেন, শেখ! লজ্জা-শরম বলতে কিছু থাকা চাই। এক বাড়িতে দিনে কয়বার ধরনা দিতে আসেন। সকাল থেকে চারবার এভাবে বিরক্ত করার কোনো মানে আছে? মনে করেছেন এখানে বুঝি আপনার বুজরুকিতে ধোঁকা খাওয়ার লোক আছে। এমন লোক দেখলে তো পাড়ার ভিক্ষুকরাও লজ্জা পাবে। বিনা পুঁজিতে কোন ধরনের ব্যবসা পেতেছেন? নফসের গোলামিতে জীবনটা বরবাদ করে দিচ্ছেন এভাবে। সাররাযি এতক্ষণে মুখ খুললেন, জনাব আমির! ক্ষান্ত হোন, আমি কিন্তু এমনিতে কাঙাল সাজিনি। আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর দ্বীনের জন্য এ পথে নেমেছি। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পদে জাকাত ফরজ করে দিয়েছেন। এ জাকাত তাদের (ধনীদের) থেকে আদায় করা হবে আর তাদের গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হবে। (বোখারি)। সাররাযি আরও বললেন, আমার নিজের রুটি-রুজির জন্য যদি পথে নামতাম তাহলে আমার এ পেট নিজেই ফাটিয়ে ফেলতাম। সাতটি বছর প্রেমের অনলে দগ্ধ হয়ে দিন গুজরান করেছি। সেই আমি আপনার কাছে ভিক্ষার জন্য ধরনা দেব, কীভাবে ভাবতে পারেন? আপনি আসলে প্রেমশূন্য, শুধু মনুষ্য চামড়ায় আচ্ছাদিত। বাইরের আবরণের ভেতরে অন্তর্জগতে আপনার দৃষ্টিশক্তি অগম্য।
হে মানুষ! প্রেমের আগুনে পোড়া লোকদের নিজের জ্ঞানের মাপকাঠিতে ওজন দেওয়ার চেষ্টা করো না। তুমি জাগতিক জ্ঞান, জাদুবিদ্যা, দর্শন, অর্থ উপার্জনের নানা কূটকৌশল আয়ত্ত করে নিজেকে ভাবছ অনেক কিছু। জাহেরি ইলমের বন্দিদশায় ঘুরপাক খাচ্ছ। তাই আল্লাহকে চেনার ইলম থেকে তুমি বঞ্চিত। তুমি তো এখনও নিজেরই পরিচয় পাওনি; কীভাবে মহামহিমের পরিচয় পাবে? একটি উপদেশ বলছি, শোনো। প্রেমিকদের প্রেমের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার, মূল্যায়ন করার চেষ্টা কর। এই লোকেরা কেন আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দ্বীনের জন্য, অসহায় মানুষের জন্য পাগলপারা, কেন নিজের স্বার্থ, অর্থবিত্তের কথা চিন্তা না করে আল্লাহর জন্য নিবেদিতপ্রাণ, বোঝার চেষ্টা কর। এসব কথার ব্যাখ্যা প্রেমিকরা তোমাকে দেবে না। কারণ তাদের হাতে সময় নেই। তারা সর্বক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন।
ফাহম কুন মওকুফে আন গোফতান মবাশ
সীনেহায়ে আশেকান রা কম খারা’শ
বুঝবার চেষ্টা কর, মুখের বুলিতে তুষ্ট থেক না
প্রেমিকদের বক্ষ বিক্ষত করার চেষ্টা করো না।
একথা বলেই সাররাযি কেঁদে দিলেন। তার দুচোখে অশ্রুর বন্যা আর থামে না। সাররাযির কথাগুলো ছিল অন্তর থেকে নিসৃত। মনের স্বচ্ছতা, পবিত্রতা আলোকিত করে অন্য মানুষকেও। এখানেও সাররাযির সততা, স্বচ্ছতা আমিরের অন্তরকে আলোড়িত করল। মনের স্বচ্ছতা, সততা যেখানে জড়পদার্থকেও প্রভাবিত করে, সেখানে জ্ঞানী লোকেরা তো স্বাভাবতই প্রভাবিত হবেন। ইতিহাস কথা বলে,
সিদকে মুসা বর আসা ও কূহ যদ
বল্কে বর দরয়ায়ে পুর এশকূহ যদ
মুসার সততা শুধু লাঠি ও পর্বত প্রভাবিত করেনি
উত্তাল সাগরকেও প্রভাবিত করেছিল ঠিক তেমনি।
এই বয়েতে মওলানা রুমি (রহ.) হজরত মুসা (আ.) এর হাতের লাঠি প্রাণ পেয়ে সাপ হওয়া, আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার সময় তুর পাহাড় উন্মাতাল হওয়া এবং মিশর থেকে পলায়নপর বনি ইসরাইলের জন্য নীলনদের মাঝখানে রাস্তা তৈরি হওয়ার অলৌকিক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। হজরত মোহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর হাতের ইশারায়ও আকাশের চাঁদ দুই টুকরো হয়েছিল এবং একবার যুদ্ধরত হজরত আলী (রা.) এর আসরের নামাজ যাতে কাজা না হয় সে জন্য নবীজির দোয়ায় ডুবে যাওয়া সূর্য ফিরে এসেছিল। মওলানার ভাষায় এসবই ছিল মনের স্বচ্ছতার প্রভাব,
সিদকে আহমদ বর জমালে মাহ যদ
বলকে বর খোরশীদ রাখশান রাহ যদ
নবীজির সততা চাঁদের সৌন্দর্য হরণ করেছে
এমনকি তা উজ্জ্বল সূর্যেরও গতিরোধ করেছে।
পীর সাররাযির মনের সততা ও স্বচ্ছতার আলোকচ্ছটা আমিরের অন্তরেও ভাবান্তর ঘটাল। আমিরও কান্না শুরু করলেন অঝোর নয়নে। দুজন সামনাসামনি পরস্পর চোখে চোখ রেখে কেবলই কাঁদছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই, শুধুই কান্না। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে গেল। স্বাভাবিক হয়ে আমির ফকিরকে বললেন, উঠুন হে সম্মানিত! এই নিন আমার ধনরতেœর চাবি। আমার কোষাগার থেকে যত ইচ্ছা নিয়ে যান। আমার বাড়িঘর, সম্পদ আপনার। আপনি যেভাবে ইচ্ছা ভোগ ব্যবহার করুন। ফকির বুজুর্গ বললেন, সে অনুমতি আমার নেই। আমি হুকুমের গোলাম। আপনার সম্পদ আমি নিতে পরব না নিজের হাতে। একথা বলেই ফকির চলে গেলেন আমিরের কাছ থেকে।
পীর সাররাযির জীবন সংগ্রাম কিন্তু থেমে নেই। তিনি ধনীদের কাছ থেকে নেন আর পূর্ণ আমানতদারীর সঙ্গে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। নিজের ভোগ-বিলাসিতার জন্য ব্যয় করেন না কিছুই। অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষ অকাতরে ধনসম্পদ তুলে দেয় সাররাযির হাতে। কারণ, তারা জানে, সাররাযিকে দেওয়া টাকা-পয়সা যথাযথ আল্লাহর রাহে ব্যয় হবে। সাররাযির দুটি বছর কেটে গেল ফকিরির বেশে পরের দুয়ারে যাচনা করে। এবার আল্লাহর পক্ষ থেকে ফকিরের অন্তরে আদেশ এলো, তুমি কারও কাছে কিছু চাইতে পারবে না, শুধুই দান করবে। গায়েবি কোষাগার থেকে আমি তোমাকে দিতে থাকব আর তুমি তা অভাবী মানুষের মধ্যে বিলাবে। অভাব-অভিযোগ নিয়ে যেই আসুক, তাকে দাও। হাতে যখন কিছু থাকবে না বিছানার মাদুরের নিচে হাত দাও। সেখান থেকে নিয়ে অভাবীদের অভাব মোচনের চেষ্টা চালাও। দেখবে তোমার হাতে মাটি স্বর্ণে পরিণত হচ্ছে।
বাদ আযীন মী দেহ ওলী আয কাস মাখা’হ
মা বেদাদীমাত যে গাইব ইন দস্তগাহ
এরপর বিলাতে থাক; কিন্তু চেও না কারও কাছে,
আমিই তোমাকে দিয়েছি এ ধনভান্ডার অদৃশ্য থেকে।
এখন থেকে তোমার সাধনা হবে, কারও কাছ থেকে কিছু চাইতে পারবে না। শুধু দান করবে। কম হোক বেশি হোক কোনো সাহায্যপ্রার্থীকে ফেরাতে পারবে না। প্রশ্ন করতে পার, এত টাকা তুমি কোথায় পাবে? চিন্তা নেই, তোমার বিছানার মাদুর ওল্টাও, সেখানই পেয়ে যাবে। আমি তোমার জন্য আমার রহমতের দুয়ার খুলে দেব। তোমার হাতের পরশে তখন মাটি স্বর্ণ হয়ে যাবে। কাউকে দান করতে কুণ্ঠিত হবে না। দিতে থাক। যত দাও আরও দেব। আমার রহমতের ভান্ডার খুলে দেব।
রও য়াদুল্লাহ ফাউকা আইদিহিম তো বা’শ
হামচো দাস্তে হক গেযাফী রিযক পা’শ
যাও ‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর’ হও
আল্লাহর হাতের মতো দান অকাতরে বিলাও।
দান-দক্ষিণায় ‘ওয়াহহাব’ আল্লাহর দানশীলতা গুণের প্রকাশকারীতে পরিণত হও। আল্লাহ তায়ালা যেমন কোনো স্বার্থচিন্তা বা প্রতিদানের আশা ব্যতিরেকে দান করেন তুমিও মনের স্বচ্ছতায় অকাতরে বিলাতে থাক।
ওয়ামদারা’ন রা’ যে ওহদে ওয়ারেহা’ন
হামচো বারা’ন সবজ কুন ফরশে জাহা’ন
ঋণগ্রস্তদের তুমি মুক্তি দাও ঋণের বোঝা হতে
বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর বিছানা সাজাও সবুজ ফরাশে।
অবারিত অকাতরে দান ও বদান্যতায় মানুষের মনে খুশির জোয়ার আন। সমাজের সর্বত্র স্বচ্ছতা, সততা, মানব প্রেমের পসরা সাজাও। মানুষে মানুষে প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসার সুবাতাস প্রবাহিত কর।
পীর সাররাযির জীবনে একটি বছর কেটে গেল। অবস্থা এমন হলো, কোনো সাহায্যপ্রার্থী এলে মুখে বলতে হয় না। সাররাযি আগন্তুকের মনের পুস্তক পাঠ করে এমনভাবে দান করেন, যাতে প্রার্থীর মনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। এই কারামাতের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একদল লোক শায়খের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে, হুজুর! কি ব্যাপার! যেই আসুক মুখে বলা ছাড়াই আপনি তার ঠিক প্রয়োজনটি পূরণ করে দেন। তার মনের কথা কীভাবে জানতে পারেন? সাররাযি জবাব দিলেন, আমার মনের বাড়ি শূূন্যঘর। এখানে কোনো কিছুর লোভ বা আশা নেই। বেহেশতের বাসনাও লালন করি না। আল্লাহর ভালোবাসা ছাড়া, তার মিলন ও সন্তুষ্টির বাসনা ছাড়া আর কিছু চাই না। ফলে মনটা স্বচ্ছ আয়নার মতো হয়ে আছে। আয়নার সামনে যা কিছু আসে হুবহু তাতে প্রতিবিম্বিত হয়। তাই আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুর চিন্তা যদি আমার মনে আসে, আমি বুঝে নেই যে, এই চিন্তা আমার নিজের নয়, আগন্তুকের।
হে যুবক! পানির পাত্রে যদি কোনো কিছুর ছবি দেখ বুঝে নাও, সে ছবি পানির নয়, বাইরের প্রতিচ্ছায়া। তবে শর্ত হলো, পাত্র ও পানি স্বচ্ছ, নির্মল হতে হবে। তাহলেই বাইরের বস্তুর প্রতিফলন নির্ভুল হবে। তুমি যদি শুধু খাওয়া, ভোগ ও নিদ্রার মধ্যে ডুবে থাক, তোমার মানসপট কীভাবে স্বচ্ছ নির্মল হবে? তোমার বাড়ি যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকে, আশপাশ যদি ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে থাকে তাহলে তো দৈত্যদানব, হিংস্র প্রাণীর আখড়ায় পরিণত হবে। কাজেই আধ্যাত্মিক জ্ঞানে আলোকিত হতে চাইলে আগে মনের বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখ। আল্লাহর নিত্য স্মরণে মনকে শান্তি, সততা ও স্বচ্ছতার গুণে সজ্জিত কর। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত ২৭৩১-২৮০৫)