শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১১ অপরাহ্ন

শিক্ষকতা জীবনের ঝুঁকি মোকাবেলা

সারওয়ার মো: সাইফুল্লাহ্ খালেদ
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০২০
  • ২০৭ বার

১৯৭১ সালের পর দেশে শিক্ষাঙ্গনের সার্বিক পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে গেল। ১৯৭৪ সালের শেষভাগে আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। এরপর তিতুমীর কলেজ, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ হয়ে ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজে এসে ১৯৯০ সালের মার্চ পর্যন্ত ছিলাম। এর পর আরো তিনটি কলেজ যথা- কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, অল্প ক’দিন চাঁদপুর কলেজ ও কুমিল্লা উইমেন্স কলেজে ছিলাম। এই একটি কলামে সব কলেজের অভিজ্ঞতা বলে শেষ করা যাবে না। সেটি ছিল অনিয়মের যুগ।

এডওয়ার্ড কলেজে ১৯৭৫ সালের জুনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন। অডিটোরিয়ামের পুবের অংশে ডিউটি। ডিউটিতে আমিই নতুন এবং বয়োকনিষ্ঠ। সামনের টেবিলে এক পরীক্ষার্থী সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে এসেছে। জানতে চাইলে বলল, ‘গায়ে জ্বর’। তার কপালে হাত রাখলাম। বললাম, ‘তোমার গায়ে তো জ্বর নেই’। বলল, ‘এখন নেই তবে শীত করছে’। বললাম, ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম’। এক সহকর্মী আমাকে বললেন, ‘এই ছেলে দুইজনকে খুন করে তৃপ্তি নিলয় হোটেলের গেটের দুই মাথায় তাদের মাথা খাড়া করে রেখেছিল’।

হঠাৎ লক্ষ করলাম, সে উসখুস করছে। একটি কাগজ বের করল। এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কাগজটি দিয়ে দাও আর চাদরটা খোলো’। কাগজ দিলো কিন্তু চাদরটা খুলল না। বলল, ‘আর নেই’। বললাম, ‘এবারো বিশ্বাস করলাম’। আবার কাগজ বের করল। কাছে গিয়ে বললাম, ‘কাগজটি দাও আর দাঁড়াও। তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। এবার চাদরটি খোলো’। দাঁড়িয়ে কাগজটি দিলো কিন্তু চাদর খুলতে রাজি হলো না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি জীবনে কী হতে চাও’? বলল, ‘আমি মন্ত্রী হবো’। বললাম, ‘ভালো কথা। দোয়া করি মন্ত্রী হও। আচ্ছা, মনে করো তুমি শিক্ষামন্ত্রী হলে। তুমি যেভাবে পরীক্ষা দিতে চাও তাতে তোমার মন্ত্রিত্বের অধীনে শিক্ষার কী অবস্থা হবে?’। সে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বললাম, ‘চাদরটি খুলে আমার হাতে দাও’। সে চাদর খুলল। চাদরের নিচে একটা বই ও আরো কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেল। পরদিন অডিটোরিয়ামের পশ্চিম পাশে ডিউটি পড়ল। কৌতূহলী হয়ে ছেলেটিকে দেখতে গেলাম। সে আজ আসেনি। পরীক্ষা দিচ্ছে না।

পাবনায় একটি মিষ্টি পাওয়া যায়। রসকদম। রসগোল্লার মতো গোল, উপরে সাগুদানা বসানো। এক সন্ধ্যায় খালি দোকানে বসে মিষ্টি খাচ্ছি। এমন সময় সেই পরীক্ষার্থীটি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, বসতে পারি’? বললাম, ‘বসো’। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এবার পরীক্ষা দিলে না কেন’? বলল, ‘ভালো প্রিপারেশন নেই। ভালো করে পড়ে আগামীবার পরীক্ষা দেবো’।

এরপর বলল, ‘স্যার, আপনাকে প্রায়ই দেখি মিষ্টি খান। আপনি মিষ্টি পছন্দ করেন’? বললাম, ‘মিষ্টি আমি কমই খাই। তোমাদের এখানের রসকদমটা ভালো লাগে তাই এটা খেতে মাঝে মাঝে আসি’। বলল, ‘স্যার, আর দুটা খান। আমি খাওয়াব’। বললাম, ‘দুটা খেয়েছি। আর না। তোমাকে ধন্যবাদ’। মনে হলো, পরীক্ষার হলে আমি তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছি যে কারণে সে অনুতপ্ত। শুনেছি, বলতে জানলে কথায় নাকি পাথরও গলে।

ঢাকা কলেজের দক্ষিণ হোস্টেলের অ্যাসিস্টেন্ট সুপার আমি। হোস্টেলটি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য। হোস্টেলে ভর্তির একটি ওয়েটিং লিস্টের কেস নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো। নবাগত এক ছাত্রের বাবা বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত কর্নেল। হোস্টেলে ছেলের সিটের ব্যাপারে জানতে এসেছেন। আমি তখন লেকচারার। বললাম, ‘আপনার ছেলে যেহেতু ওয়েটিং লিস্টের উপর দিকে আছে একটা সিট সে আশা করি পাবে। তবে একটু সময় লাগবে। আমি আপনাকে আশ্বাস দিতে পারি তাকে টপকে কেউ সিট পাবে না। সে তিনি আবার আনেন। বললেন, ‘আমি অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে দেখা করেছি। তিনি আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে বলেছেন’। আমি তাকে বুঝলাম। বললাম, ‘সিরিয়াল এলে আপনার ছেলেকে ক্লাসে নোটিশ দিয়ে ডাকব।’ তিনি অফিসকক্ষে এলেই আমি দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করি, যখন বেরিয়ে যান তখনো দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাই। তিনি তৃতীয়বারের মতো এলে আমি তার ছেলের ভর্তির নিশ্চিত ডেট দিতে পারলাম। সে ডেট এক মাস পর। নির্দিষ্ট দিনে ছেলে এসে ভর্তি হলো। আমি সে কর্নেলকে স্যালুট দিই, কারণ তিনি আমার সমস্যা বুঝতে পেরেছেন। তিনবার বগুড়া থেকে ঢাকা এসে বিফল হলেও বিরক্ত হননি। ধৈর্য ধরেছেন। এসব নিয়মনিষ্ঠ লোক মানুষকে নিয়মনিষ্ঠ হতে অনুপ্রাণিত করে।

দেশে এরশাদ সাহেবের মার্শল ল চলছে। সা’দত কলেজে সম্মান তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় আমরা পাঁচজন দোতলার একটি কক্ষে পরিদর্শকের দায়িত্বে। এদের মধ্যে আমি বয়োকনিষ্ঠ। একপর্যায়ে কক্ষের পেছনের দিকে দেখলাম সাদাপেড়ে মিশকালো মিহি সুতির আনকোরা শাড়ি পরা এক প্রিয়দর্শিনী তরুণী খাতার নিচে কাগজ রেখে লিখছে। এগিয়ে গিয়ে তার কাগজটি নিয়ে এলাম। বললাম, সে যেন আর এমনটা না করে। সে আবার একই কর্ম শুরু করল। এবার গিয়ে তাকে বললাম, ‘তোমার কাছে যা কাগজ আছে দিয়ে দাও’। তার হাতের কাগজটি আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘আর নেই স্যার’। আমি তাকে বিশ্বাস করলাম না। বললাম, ‘আরো যা লুকানো আছে তা-ও দাও’। সে তার শাড়ির পরিপাটি ভাঁজ থেকে আরো ক’টি কাগজ বের করে দিলো। আমি চলে এলাম। এমন সময় সামরিক পোশাকে টাঙ্গাইলের ডিসট্রিক্ট মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (ডিএমএলএ) এসে কারো অনুমতি না নিয়েই কক্ষে প্রবেশ করলেন। তিনি কেন্দ্র পরিদর্শনে এসেছেন। কক্ষে প্রবেশ করে তিনি সোজা এ মেয়েটির পাশে এসে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। মনে হলো মেয়েটি তার কেউ হবে। এরপর কোনো দিকে না তাকিয়ে যেমন এসেছিলেন তেমনি চলে গেলেন। লক্ষ করলাম, তিনি পেছনের কক্ষে প্রবেশ করেছেন। মেয়েটি আবার কাগজ বের করে লিখতে লাগল। তাকে বললাম, ‘কলেজে মহিলা শিক্ষক আছেন। যদি স্বেচ্ছায় তোমার সব কাগজ আমার হাতে না দাও তবে তাকে ডেকে তোমার বডি সার্চ করাব।’ সে তার শাড়ির গোপন ভাঁজে সেফটিপিনে আঁটা ও শাড়ির নিচে ব্লাউজে আঁটা কাগজগুলো বের করে দিলো। সে সময়ে এ কলেজে নকলের দায়ে কোনো পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার রেওয়াজ ছিল না। একসময় কক্ষের মাঝখানের দরজায় বারান্দার ফ্লোরে ভারী আওয়াজ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি দু’জন সিপাই রাইফেলের বাঁট দিয়ে ফ্লোরে আঘাত করে সটান দাঁড়িয়ে আছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ডিএমএলএ বারান্দা দিয়ে চলে গেলেন। সাথে সাথে সিপাই দু’জনও। মেয়েটি কলম তুলে বসে রইল। এরশাদ সাহেব তার শাসনামলের শেষ দিকে শেখ শহিদুল ইসলামকে শিক্ষামন্ত্রী বানিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেন। এ সময়ে সা’দত কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাস পরীক্ষা চলছে। আমার ডিউটি ছিল না। সন্ধ্যায় টাঙ্গাইল ক্লাবে বসে শুনলাম এক নকলবাজ ছেলে কর্তব্যরত এক মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটকে কলেজের দোতলার বারান্দায় গালে চড় মেরে দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে গেছে। কর্তব্যরত এডিসিকে নকলবাজ ছেলেরা ঘিরে ধরে বলেছে, ‘ঘুষ খাছ আবার নকল ধরতে আইসছ’। এতে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন ক্ষুব্ধ। তারা আর পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে কলেজে আসবে না। টাঙ্গাইলের ডিসি পরদিন সন্ধ্যায় তার সভাকক্ষে করটিয়া, কাগমারী, কুমুদিনী এই তিন সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সম্মিলিত সভা ডাকলেন।

সভায় সে দিন পরীক্ষার হলে কর্তব্য পালনকারী অফিসাররা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন। অফিসাররা বললেন, এ পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব নয়। তারা যাবেন না। কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলো, কিন্তু তারা সিদ্ধান্তে অনড়।

তিন কলেজের অধ্যক্ষও উপস্থিত। আমি সবার পরে উঠে সভাপতি ডিসির অনুমতি নিয়ে আমাদের অধ্যক্ষকে বললাম, ‘স্যার, আমরা কি আমাদের ছাত্রদের বলতে পারি না তোমরা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছ তাতে করে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি না আসতে পারলে বা না এলে আমরা তোমাদের পরীক্ষা নেবো না? আর পরীক্ষা নিলেও সেটি বৈধ হবে না। কারণ এটা পাবলিক পরীক্ষা’। এক প্রবীণ শিক্ষক আমার কথায় সায় দিলেন। ডিসি এতক্ষণ সবার বক্তৃতা শুনছিলেন। এবার বললেন, পরীক্ষা কেন্দ্রে জেলা প্রশাসন যাবে। আরো শক্তিশালী টিম যাবে। আমি নিজেও যাবো এবং এসপি-ও যাবেন। পরীক্ষা চলবে এবং নকলমুক্তভাবেই চলবে। পরের পরীক্ষাগুলো মোটামুটি নকলমুক্তই হলো।

ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। আমি এক কক্ষে হল সুপার। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে এবং ছাত্ররা লিখতে শুরু করেছে। কলেজের এক প্রভাবশালী ছাত্রনেতা জনা দশেক সাথী নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতে এলে আমি তাদের দরজায় বাধা দিই। দু’হাত ছড়িয়ে দরজার দু’চৌকাঠ আমি ধরে রাখি। বলি, ‘পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে’। নেতা ছেলেটি শান্তভাবে বলল, ‘স্যার, আমাকে বাধা দেয়ার সাহস এ কলেজে কারো নেই’। আমি দু’হাত গুটিয়ে বললাম, ‘এসো, প্রবেশ করো’। সে দরজার বাইরে চুপ করে আধা মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সাথীদের নিয়ে চলে গেল। কারো সেন্টিমেন্টে আঘাত না করলে এ জগতে পজিটিভ অনেক কিছুই হাসিল করা যায়।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com