এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হলো জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপিএকে। সাধারণত নোবেল শান্তি পুরস্কার ব্যক্তি বিশেষকেই দেয়া হয়। দেয়া হয় বিশ্বশান্তি বা মানবতার খেদমতে অসাধরণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারপারসন বেরিট রিস অ্যান্ডারসন এ বছরের শান্তি পুরস্কার জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে দেয়ার সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে যথার্থই কয়েকটি বিশ্ব-বাস্তবতার প্রতি দিকনির্দেশ দিয়েছেন। তার এই ব্যাখ্যার পর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নোবেল জয়ে ‘অবাক হওয়ার’ কোনো তথ্যঘাটতি বা বিভ্রান্তি থাকতে পারে বলে মনে হয় না। তিনি বলেছেন, ‘জগৎজুড়ে মানুষের ক্ষুধার আগুন উসকে দিচ্ছে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং বিবদমান পক্ষগুলো আর সর্বশেষ আঘাত হেনেছে মানবজাতির বৈশ্বিক আপদ ‘করোনাভাইরাস’ মহামারী। ভাইরাসটি যেমন জগদ্বাসীকে ঠেলে দিয়েছে বিনাশের পথে; ক্ষুধা-অপুষ্টিও তেমনি মানবতাকে ঠেলে দিয়েছে বিনাশের পথে। অসুখে মরার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর, গ্লানিকর এবং অপমানজনক হলো, না খেয়ে মরা। তাই ক্ষুধার বিরুদ্ধে জগৎজোড়া সংগ্রামের অগ্রদূত সংস্থা ডব্লিউএফপিএর এই বিরল সম্মাননা মানবজাতির জন্য গৌরবময়ই বটে।
কমিটি ঠিকই বলেছে, এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ‘সভ্য’ ও ‘সচ্ছল’ পৃথিবীকে ক্ষুধাতাড়িত দেশ ও অঞ্চলের দিকে সহানুভূতির সাথে তাকাতে অনুপ্রাণিত এবং জাতিসঙ্ঘের অন্যান্য সংস্থাকেও মানবতার খেদমতে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে। নোবেলের দেশ নরওয়ে নিজেও হাইটেক কৃষির মাধ্যমে খাদ্যশস্য ফলন প্রচুর বাড়িয়েছে এবং দেশটি নেদারল্যান্ডসের মতোই ক্ষুধাতাড়িত দেশ ও অঞ্চলগুলোতে তাদের বাড়তি খাদ্য অকাতরে দান করে চলেছে। এই মানবিক সহানুভূতি দেখেও এতটুকু লজ্জা পায়নি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা, এটাই পরিহাসজনক। কেননা এই সংস্থার (WFP) যখন জন্ম হয় তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার এই সংস্থার পক্ষ থেকে ক্ষুধাপীড়িত বিশ্বে উদার হস্তে খাদ্যসাহায্য পরিচালনার ওয়াদা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গম ও যব উৎপাদনকারী দেশ। অথচ WFP-তে সাহায্যদাতা দেশগুলোর মধ্যে সেই যুক্তরাষ্ট্র নিতান্তই তলানিতে। এটা তার দান এবং তার দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের অনুপাতে। বিশ্বখাদ্য কর্মসূচিতে অবদান রাখা প্রধানতম দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং গোষ্ঠীগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। অথচ এই দেশগুলোর মোট উৎপাদনের চেয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ডাকোটা ও কানসাস অঙ্গরাজ্যই বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করে থাকে। কথায় বলে, ধনীরা আসলে কৃপণই হয়ে থাকে। নব্য-জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীলদের হাতে আমেরিকার কৃপণতা যে কতখানি দুঃখজনক, জাতিসঙ্ঘে দেয়া চাঁদা বকেয়া রাখা এবং চাঁদা দিতে অস্বীকার করে আমেরিকা সেটা প্রমাণ করেই দিয়েছে। এটা হলো এমন ‘মোড়ল’ গাঁয়ে যার দান-দক্ষিণা ঠনঠনে, আছে শুধু ‘আভিজাত্যের’ অহঙ্কার ও জাতের বড়াই!
এ বছরের নোবেল পুরস্কারের জন্য ৩১৮টি নমিনি প্রতিষ্ঠান, ২১১ জন ব্যক্তি ও ১০৭টি সংগঠনের নাম ছিল। এর মধ্যে ‘বিস্ময়কর পরিবেশ-বালিকা’ সুইডেনের গ্রেটা থানবার্গের নামও ছিল; ছিল রাশিয়ার ভিন্নমতাবলম্বী বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালিনের নামও। গত বছরের নোবেল পুরস্কার নমিনেশনের ব্যাপারে আত্মসন্তুষ্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত আশাবাদী ছিলেন এবং সেই মোতাবেক জোর লবিংও চলছিল। ছিল ইথিওপিয়ার বিতর্কিত শাসক আবু আহমদের নামও।
উগ্র জাতীয়তাবাদী ট্রাম্প এখনো আশা ছাড়েননি। তার লোকজন এখন থেকেই বলাবলি শুরু করেছেন, আরব আমিরাত ও বাহরাইনকে ইসরাইলের বন্ধু করে তোলার মতো বড় কাজে অবদান রাখা ট্রাম্পকে ২০২১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য চিন্তা করা যেতে পারে। হায়রে আরব আমিরাত আর বাহরাইন, মানবজাতির দুশমন ইহুদি-ইসরাইলের হাত শক্ত করে কথিত ‘শান্তির’ ঘটক ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এখন নোবেল দেয়ার আবদার শুরু হয়েছে। এটা যদি বিবেচনাযোগ্য বলেও গণ্য করেন, তাহলে নোবেল-কমিটির চেয়ারম্যানের জন্য তা হবে আত্মহত্যারই শামিল। এই সহজ সরল কথাটি কি তারা বুঝতে পারছেন?
মানবজাতির এক- চতুর্থাংশ এখন পর্যন্ত আগ্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকারই করে নেয়নি। সেই ইসরাইলের হাতকে শক্ত করার ‘অবদানকে’ যদি নোবেল তকমার স্বর্ণ দিয়ে মোড়া হয় তাহলে সেটা সোনা কেন, ছাই ভস্মের মর্যাদাও পাবে না। এ পৃথিবী কার্যত আজ দুই ভাগে বিভক্ত- একপক্ষে যারা ইসরাইলকে স্বীকারই করে না। আরেক পক্ষ যারা ইসরাইলের বন্ধু। এ নিয়ে আর ‘নোবেলকে’ কলঙ্কিত না করলেই কি নয়?
বরং বলব, ডব্লিউএফপির মতো উদ্বাস্তুবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ হাইকমিশন UNHRC বা এরকম আরো অনেক মহানুভব মানব-সংগঠন বা ব্যক্তি উদ্যোক্তা আছেন, যাদের কথা আগামী দিনে ভাবা যায়। ১৫ বছর বয়সী পরিবেশকন্যা গ্রেটা থানবার্গ, ওর কথা ভাবা যায়, যে কার্বন নিঃসরণকারী বিশ্ব শিল্পমোড়লদের বিরুদ্ধে নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দিয়েছে তার শৈশব-কৈশোর। মালালা ইউসুফজাইয়ের চেয়ে তার অবদান কম নয়! সে এমনই এক সাহসী কিশোরী, যে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার পরিবেশ তহবিলে কৃপণতার কারণে জোরে এক ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল। এ জগতে থানবার্গের মতো দরদিরই দরকার। দরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো নারীর ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য দূর করার সংগ্রামী, শির উঁচু করা যোদ্ধার। অনেকে রাজনীতির কৌশলে দেশনেতা হয়ে যায়, যাক। গণতন্ত্রে কিছু আপদ, ঝুট-ঝামেলা থেকেই যেতে পারে। সেই সুযোগে অনেক ‘মিডিওকার’ও দেশবরেণ্য হয়ে ওঠে, যার যোগ্যই নয় তারা। ভাবতে কষ্ট হয়, যে আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন, জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, জন অ্যাডামস, জেমস ম্যাডিসন, জেমস মনরো, হ্যারিসন, বুকানন, ক্লিভল্যান্ড, রুজভেল্ট, উড্রো উইলসন, হারবার্ট হুভার, হ্যারি ট্রুম্যান, আইজেনহাওয়ার, জন কেনেডি, সেই চেয়ারে আজ বসা এক দেমাগি, অর্ধশিক্ষিত ব্যবসায়ী! কোথায় দার্শনিক রাজা আর কোথায় বণিক, ইন্দ্রিরপূজারী এক ভোট জালিয়াত! রাশিয়া সাইবার-দস্যুতা না করলে যার ওই চেয়ারে হয়তো বসাই হতো না! হায়রে অবমূল্যায়ন, the perils of degeneration! তেমনি, মস্কোর সেই চেয়ারে কি মানায় এক জন গোঁয়ার গোয়েন্দাকে?
২০২০ সালের নোবেলজয়ী জাতিসঙ্ঘ ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’ আসলেই ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাদের পরিচালনায় এশিয়া ও আফ্রিকার বহু মানুষ, বিশেষ করে দেশান্তরী মানুষের মুখে দু’বেলা দুমুঠো আহার জোগানো সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য জরুরি খাদ্য ত্রাণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। শুধু মানবতার ডাকে এই সাড়াদানের কারণেই তারা নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত এবং বিবেচিত হতে পারে। ১০ লাখ মানুষের খাদ্য জোগানো এবং সেই কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা কম কথা নয়।