যুক্তরাষ্ট্রে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নির্ধারণে পোস্টাল ব্যালট বা ডাকযোগে পাঠানো ভোট গণনায় জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনে দোদুল্যমান যেসব অঙ্গরাজ্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তার মধ্যে মিশিগান অন্যতম। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে ওই অঙ্গরাজ্যের কয়েকটি শহর থেকে প্রথম শ্রেণির চিঠি বিলির গতি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ধীর হয়ে পড়েছে।
নতুন করে নেওয়া ব্যয় সংকোচন নীতির কারণেই এই ধীরগতি। বিশেষত ডেট্রয়েট শহরে চিঠি বিলির এই বিলম্ব ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী এবং জো বাইডেনের প্রচার দলের জন্য সমস্যা বলে দেখা যেতে পারে। তবে ডাক বিভাগ দ্য গার্ডিয়ানের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। পোস্টাল শ্রমিক ইউনিয়ন বলছে, সময় মতো পোস্টাল ব্যালট পৌঁছে দিতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য মিশিগানে ডেমোক্র্যাটদের শক্ত অবস্থান বলে বিবেচিত ডেট্রয়েট, অ্যান আরবর এবং হ্যামট্রামাক শহর থেকে প্রায় ১৫০টি প্রথম শ্রেণির চিঠি পাঠায় ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান। ডাকযোগে পাঠানো ভোটগুলো যে পথ ধরে বিলি হবে সেই একই পথ ধরে ওই চিঠিগুলো পাঠানো হয়। এতে তারা দেখেছেন, প্রায় ৮৩ শতাংশ চিঠি সময় মতো পৌঁছেছে। কিন্তু ডেট্রয়েট শহরে এই সেবা সবচেয়ে জঘন্য। প্রায় ৩৬ শতাংশ চিঠি পৌঁছেছে তিন দিন দেরিতে, আর একটি চিঠির এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের আগে শহরটির এক লাখ ৭০ হাজার বাসিন্দা ডাকযোগে ভোট দেওয়ার আবেদন করেছেন। এদের বড় অংশই ডেমোক্র্যাট সমর্থক।
শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, সমগ্র প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ এই দিনের ভোটে নির্ধারিত হবে। কিন্তু সময়মতো নির্বাচনের ফলাফল পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, ৩ তারিখ রাতে তো নয়ই, কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস লেগে যেতে পারে ফলাফল পেতে।
এটি একদম শূন্যগর্ভ হুমকি নয়। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এবারের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক মানুষ ডাক মারফত ভোট দেবেন। অনেক ক্ষেত্রে ৩ তারিখ পর্যন্ত ডাক মারফত ভোট দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। ভোট গ্রহণ শেষে এই ভোট গণনা শুরু হলে কত দ্রুত তা শেষ হবে, তা বলা কঠিন।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, ডাক মারফত ভোট হলে তাতে বিপুল কারচুপির আশঙ্কা রয়েছে। এ কথার কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু তার কথার প্রতিধ্বনি করে রিপাবলিকান নেতৃত্ব একই কথা বলা শুরু করেছেন। ফলে ডাক ভোট গণনা শেষ হলেও তার ফলাফল নিয়ে উভয় পক্ষই আপত্তি জানাবে। শেষ পর্যন্ত এই বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে, যা একাধিক ধাপ কাটিয়ে হয়তো সুপ্রিম কোর্টের কাছে আসবে চূড়ান্ত রায়ের জন্য। ২০০০ সালে আল গোর বনাম জর্জ বুশের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে এক মাসের অধিক বিলম্ব হয়, যা কেবল সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে নিষ্পত্তি হয়।
গত নির্বাচনে মিশিগান অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতলেও ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ১০ হাজার। সম্প্রতি মিশিগানের এক বিচারক রায় দিয়েছেন ডাকযোগে পাঠানো ভোট বিলম্বে পৌঁছালে তা গণনা করা হবে না। অথচ নির্বাচনের চূড়ান্ত সপ্তাহেও প্রায় ৭০ হাজার ডাক ভোট পৌঁছাতে পারেনি ডেট্রয়েট শহরের পোস্টাল কর্তৃপক্ষ।
দ্য গার্ডিয়ান বলছে, মহামারির আগে ট্রাম্প নিযুক্ত পোস্ট মাস্টার জেনারেল লুইস ডেজয় এই গ্রীষ্মে যে পরিবর্তন আনেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক ব্যবস্থায় সময় মতো চিঠি পৌঁছানোর হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। তবে ব্যয় কমানোর নতুন কৌশলের কারণে চিঠি বিতরণের গতি ধীর হয়ে পড়েছে।
গার্ডিয়ানের অনুসন্ধান এবং ডাক সেবার তথ্য অনুযায়ী, ডেট্রয়েট শহরে সময়মতো চিঠি বিলির হার তিন দিন সময়ের মধ্যে ৫২ শতাংশের কম। গত ১৬ অক্টোবর শেষ হওয়া এক সপ্তাহ মেয়াদে দেশজুড়ে এই হার ৮২ শতাংশ। তবে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে এই হার আরও কম।
মিশিগানের সিনেটর গ্যারি পিটারস বলেছেন, এই হার সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘পোস্টমাস্টার জেনারেলকে অবশ্যই অবিলম্বে আদালতের সব আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং চিঠি বিলির বিলম্বের কারণ হওয়া সব ক্ষতিকর পরিবর্তন এখনই বাতিল করতে হবে।’
মিশিগানের আমেরিকান পোস্টাল শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট রসকোয়ে উডস বলেন, ‘মহামারি এবং অন্যান্য পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন করে তুলেছে। আমরা এখনো চেষ্টা করছি। কোনো অতিরিক্ত সুবিধা না পাওয়া এবং কোভিডের কারণে আমাদের শ্রমশক্তি ব্যাহত হচ্ছে।’
তবে উডস বলেন, ডাক সেবার ক্ষেত্রে তারা ব্যালট পৌঁছানো এবং নির্বাচনের চিঠির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রতি শিফটের কর্মীরা চিঠির স্তূপ থেকে ব্যালটের চিঠিগুলো আলাদা করে ফেলছে আর সেগুলো বিতরণের প্রক্রিয়া জোরালো করছে। ফলে উডস আত্মবিশ্বাসী যে প্রথম শ্রেণির চিঠির চেয়ে ব্যালটের চিঠিগুলো আরও দ্রুত বিলি করা সম্ভব হচ্ছে। কর্মীরা অতিরিক্ত সময়ও কাজ করছে বলেও জানান তিনি। গত গ্রীষ্মে কর্মীদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে দেওয়া থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় পোস্টমাস্টার জেনারেল।
পোস্টাল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা রসকোয়ে উডস অবশ্য ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে অ্যান আরবর এবং হ্যামট্রামাক শহরের চিঠি কেন ডেট্রয়েট শহরের চেয়ে দ্রুত বিলি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো বিতরণে সমস্যা থাকে আর নির্দিষ্ট কয়েকটি শহর অন্যদের চেয়ে বেশি ভালো কাজ করছে। এ ছাড়া আর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ আমি চিহ্নিত করতে পারছি না।’
এ ছাড়াও অন্যান্য টেকনিক্যাল জটিলতাও ব্যালটের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে পাঠানো ১১ শতাংশ চিঠিতে অযোগ্য পোস্টমার্ক পড়েছে। এসব চিঠির খামের ওপর সময় ও প্রাপকের নাম পাওয়া যায়নি। শ্রমিক নেতা উডস বলেন, প্রিন্টারে অনেক সময় কালি কম থাকায় আর দ্রুত তা না বদলানোর কারণে এমনটা হতে পারে।
মিশিগান দেরিতে পৌঁছানো ব্যালট গণনা না করলেও পেনসিলভানিয়া অবশ্য নির্বাচনের দিন পর্যন্ত পোস্ট করা ভোট গণনায় নেবে। তবে যেসব ব্যালটে তারিখের সিলমোহর থাকবে না সেগুলোও সেখানে গণনা করা হবে না।
ট্রাম্প নিযুক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল লুইস ডেজয়ের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ব্যালট দেরিতে পৌঁছানো জন্য ডাক সেবায় পরিবর্তন আনার অভিযোগ রয়েছে। তবে তার আনা অনেক পরিবর্তন বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় বিচারক। তারপরও মিশিগানের নষ্ট হয়ে যাওয়া বাছাই মেশিন বদলানো হয়নি।
গার্ডিয়ানকে পাঠানো মার্কিন পোস্টমাস্টার জেনারেলের মুখপাত্র মারথা জনসনের এক লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সময়মতো ব্যালট পৌঁছানো নিশ্চিত করতে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গার্ডিয়ানের পরীক্ষার নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি লেখেন, ‘ব্যালট চিঠির সঙ্গে আপনাদের পাঠানো চিঠির তুলনা করা নিয়ে আপনাদের পরীক্ষাকে যথার্থ বলে মনে করছে না ডাক কর্তৃপক্ষ।’