পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন শেষ হয়েছে তিন দিন হলো। কিন্তু এখনো ভোট গণনা শেষ হয়নি। এর মধ্যে চলছে নানা নাটকীয়তা, উত্তেজনা। সন্দেহ নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের নাম্বার ওয়ান পরাশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দুনিয়ায় ঠা-া যুদ্ধের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়জুড়ে আমেরিকাই এককভাবে পালন করেছে বিশ্ব মোড়লের ভূমিকা। শুধু তাই নয়, আমেরিকার ভাগ্যের সঙ্গে অনেকাংশে জড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবীর ভাগ্যও। সে কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের উত্তাপ শুধু মার্কিন মুল্লুকেই সীমাবদ্ধ নয় বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। সে উত্তাপের খানিকটা আঁচ আমাদের দেশেও লেগেছে। কে হবেন আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? ট্রাম্প না বাইডেন? এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
প্রেসিডেন্টের দৌড়ে পাল্লা ভারী বাইডেনের, তবে ট্রাম্পের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে ট্রাম্প শিবির ভোটে জিততে সবচেয়ে মরিয়া। তারা ভোট চুরির অভিযোগ এনেছেন। মামলা করেছেন। হুমকি দিচ্ছেন। ট্রাম্পের আচরণ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, নির্বাচনটা বাংলাদেশে হচ্ছে, নাকি আমেরিকায়। এখানে যেমন প্রার্থীরা না জেতা পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগ তোলেন, আমেরিকাতেও তাই হচ্ছে। আর এটা বেশি করছে ট্রাম্পের রিপাবলিকানরা। তুলনায় জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট শিবির কিছুটা স্থিত। বাইডেন নিজে ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
“জেতাটা সহজ, হারা মোটেই সহজ নয়। ‘নট ফর মি’ আমার পক্ষে তো নয়ই। কত মিলিয়ন মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছেন, আর এক দল বাজে লোক এখন তাদের মতকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। না, আমরা কিছুতেই তা হতে দেব না। আমরা না জিতলেই বোঝা যাবে, ভোট রিগ করা হয়েছে।’’ ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের পরদিন বলেছেন এসব কথা। কাজেই খুব সহজে ছাড়ার পাত্র নন ট্রাম্প।
আসলে কেউই ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ট্রাম্পও নয়। তাই তো ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তিনি একের পর এক কারচুপির অভিযোগ আনছেন। যদিও ট্রাম্প শিবিরের আনা কারচুপির অভিযোগ ইতোমধ্যেই খারিজ করে দিয়েছে মিশিগান ও জর্জিয়ার আদালত। ওই অভিযোগের কোনো সারবত্তা নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরও নাছোড় ট্রাম্প। তার দাবি, ‘আমরাই জিতব। আমাদের ধারণা, মামলা-মোকদ্দমা অনেকদূর যাবে। কারণ আমাদের কাছে ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। হয়তো শেষমেশ সর্বোচ্চ আদালতেই বিষয়টি উঠবে। এভাবে ভোট চুরি হতে দিতে পারি না।’
ভোট গণনার প্রবণতায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে এখনো পর্যন্ত পাল্লা ভারী জো বাইডেনের দিকেই। ফল ঘোষিত রাজ্যগুলোর মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের দখলে ২৫৩ ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট। ২১৪ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট এসেছে ট্রাম্পের রিপাবলিকানদের হাতে।
৬টি রাজ্যের গণনা বাকি থাকলেও ফলাফলের প্রবণতায় ট্রাম্পের সামনে রাস্তা অত্যন্ত কঠিন বলেই মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। তবে এটাও ঠিক, দ্বিতীয়বার ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া একেবারে অসম্ভব, অন্তত খাতায়-কলমে তেমন পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।
কিন্তু অঙ্কের হিসাবে যতটা সহজ, বাস্তব তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। ভোট পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, হয়তো সেটা বুঝতে পেরেই পেনসিলভানিয়া, মিশিগান এবং জর্জিয়ার গণনা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে মামলা ঠুকে দিয়েছেন ট্রাম্প। ওই মামলাগুলোতে গণনা স্থগিত রাখার আর্জি জানানো হয়েছে। পেনসিলভানিয়া, মিশিগান নিয়ে রিপাবলিকান শিবিরের অভিযোগ, ব্যালট বাক্স খোলা এবং গণনার পদ্ধতি তাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। আবার ট্রাম্প নিজে টুইট করে দাবি করেছেন, গণনায় কারচুপির যথেষ্ট প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।
ট্রাম্প টুইট করে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘গণনা বন্ধ হোক’। জর্জিয়া নিয়ে রিপাবলিকানদের নালিশ, চেথাম কাউন্টির এক অবজার্ভার দেখেছেন নির্দিষ্ট সময়ের পরে পৌঁছানো ব্যালট বেআইনিভাবে বৈধ ব্যালটের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে। মিশিগান ও জর্জিয়ায় মামলাগুলো খারজি হয়ে গেলেও পেনসিলভানিয়ায় মামলা গৃহীত হয়েছে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও ট্রাম্প নিজে টুইট করেছেন, ‘পেনসিলভানিয়াতে বড় আইনি জয়।’
পেনসিলভানিয়ার গণনা নিয়ে ট্রাম্পের অভিযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওই রাজ্যে ২০টি ইলেক্টোরাল কলেজ রয়েছে। উল্লেখ্য, একেক প্রদেশে জনগণের ভোটে যিনি এগিয়ে থাকবেন, সেই প্রদেশের সব ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটই যাবে তার ঝুলিতে। তবে হ্যাঁ, শীর্ষ আদালত মামলাগুলো শুনতে রাজি হলে বা গণনায় স্থগিতাদেশ দিলে বিপাকে পড়ে যেতে পারে ডেমোক্র্যাট শিবির। আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত ফলাফল চূড়ান্ত করা যাবে না। এই তিনটি মামলার পাশাপাশি বাইডেন তথা ডেমোক্র্যাটরা যে কটি রাজ্যে জয়ের দাবি করেছে, সব কটিতেই মামলা করার হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
মামলা খারিজ হলে বা গৃহীত না হলে অবশ্য বাইডেনের সামনে হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর রাস্তা ক্রমেই চওড়া হচ্ছে। গণনা বাকি রয়েছে নেভাদা, অ্যারিজোনা, পেনসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া এবং আলাস্কা। এর মধ্যে নেভাদা ও অ্যারিজোনা ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি। এই দুই রাজ্যেই এগিয়ে বাইডেন। নেভাদায় ৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট। সেখানে ব্যবধান ১ শতাংশেরও কম। অ্যারিজোনায় (১১টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট) ফারাক ২ শতাংশের বেশি।
জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলিনায় ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ১৬ ও ১৫। আলাস্কায় এই সংখ্যা ৩। এই তিনটি রাজ্যেই এগিয়ে ট্রাম্প। তবে আলাস্কা ছাড়া বাকি ২টি বড় রাজ্যে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। জর্জিয়ায় তো ব্যবধান মাত্র .৩ শতাংশ। অন্যটিতে দেড় শতাংশের কাছাকাছি। ফলে শেষ পর্যন্ত কে জিতবেন, তা এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।
তবে সম্ভাবনা বেশি বাইডেনের সামনেই। কারণ ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি দুই রাজ্যে জয় পেলেই তিনি পৌঁছে যাবেন ম্যাজিক ফিগার ২৭০-এ। তার পর বাকি সব কটি রাজ্যে ট্রাম্প জিতলেও জয় থেকে যাবে অধরাই। তার ওপর জর্জিয়ায় দুজনের ব্যবধান এতটাই কম, ফল যে কোনো দিকে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাকি রাজ্যগুলোর প্রবণতা একই থাকলে এবং জর্জিয়াতেও ডেমোক্র্যাটরা জিতলে বাইডেনের জয় আরও পোক্ত হবে।
ট্রাম্পের সম্ভাবনাও অবশ্য উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ এগিয়ে থাকা চার রাজ্যের প্রবণতা ধরে রেখে শুধু নেভাদা নিজেদের দখলে নিতে পারলেই কিন্তু তিনিও ম্যাজিক ফিগার টপকে যেতে পারেন। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে আর কোনো বাধা থাকবে না ট্রাম্পের সামনে। বাজিমাত করে ফেলবেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট।
তবে ভোটের চূড়ান্ত ফল যাই হোক না কেন, এক অর্থে কিন্তু ট্রাম্পই জিতেছেন। এখনো পর্যন্ত ভোটের প্রায় অর্ধেক পেয়েছেন ট্রাম্প (৪৮.২ শতাংশ)। ক্ষমতাসীন নেতার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার যে সাধারণ প্রবণতা দেখা যায় গোটা দুনিয়ায়, যাকে বলে স্থিতাবস্থা-বিরোধিতা, তা মোটে কাজ করেনি। শতাব্দীর অঘটন করোনা মহামারী মোকাবিলায় ব্যর্থতা, বিপুল প্রাণক্ষয়, বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সংক্রমণ, সম্পূর্ণ ভুল নীতিÑ কোনো কিছুই মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে যায়নি। অর্থনীতি ম্লান হয়ে যাওয়া, চাকরির হাহাকার, কিছুই দাগ কাটতে পারেনি। দেশজুড়ে আগুন জ্বলছে বর্ণবিদ্বেষের, জাতিবিদ্বেষের, অভিবাসী-বিদ্বেষের; কিন্তু অর্ধেক আমেরিকা মনে করছে, কালোরা আর অভিবাসীরা আছে বলেই এত ঝামেলা, ট্রাম্প থাকলে বরং তাদের দাবিয়ে রাখা যাবে, ‘আইনশৃঙ্খলা’ বজায় রাখা যাবে। আইনশৃঙ্খলার আচ্ছাদন পরিয়ে যে রাস্তায় লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্বেষবিষকেই, তার ধারক ও বাহকরা ট্রাম্পের কোনো দোষ মানেননি।
প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির মামলা, প্রায় পঁচিশটা নারী নির্যাতনের অভিযোগ, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ, সব তারা তুড়ি দিয়ে উড়িয়েছেন, ক্ষমাসুন্দর হেসে বলেছেন, বয়েজ- উইল বি বয়েজ, ও রকম তো হয়েই থাকে। চীনকে কেমন মজা দেখাচ্ছে সেটাই বলো! আমেরিকার মানুষ আসলে এবারও ট্রাম্পকেই সমর্থন করেছেন। ২০১৬ সালে যদি ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতে থাকেন, এবার তার পক্ষে আরও দুই শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে এটা যে কোনো ক্ষমতাসীন শাসকের পক্ষে বিশাল কৃতিত্ব! ট্রাম্পই এই খেলার আসল জয়ী।
সবচেয়ে বড় কথা ট্রাম্প যে বিভেদের বীজ মার্কিন সমাজে পুঁতে দিয়েছেন, যে নীতি চালু করেছেন, তা সহজে উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না। নির্বাচনে যদি ডেমোক্র্যাটরা জয়ীও হন, একটি বিষয় স্পষ্ট, আমেরিকার মুক্ত সীমানা এবং অবাধ বাণিজ্যের দিনগুলোকে কিন্তু বাইডেন ফিরিয়ে আনতে পারবেন না, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশ টেনে দিয়েছেন। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা হয়তো শিথিল করতে পারেন, কিন্তু অভিবাসন নীতিকে আমূল বদলে দিতে তিনি পারবেন না। ওয়ার্ক-ভিসার কয়েকটি বিভাগে কিছুটা রদবদল করতে পারবেন, কিন্তু মার্কিন কর্মক্ষেত্রে বিদেশিদের একচেটিয়া রাখতে পারবেন না। ট্রাম্প তার শাসনকালে যে যে নীতি-নিয়ম চালু করেছেন তা বাদ দিতে পারবেন না জো বাইডেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, বাইডেন ডেমোক্র্যাট দলের হলেও তার বাণিজ্যিক কৌশলে কিন্তু রয়েছে ট্রাম্পেরই ছায়া।
তবে কিছুই কি বদল হবে না? যুক্তি বলছে হবে। জো বাইডেন জিতলে আমেরিকা ট্রান্স-আটলান্টিক জোটের সূচনা করে মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুনরায় সংযোগ স্থাপন হতে পারে এবং পারস্পরিক সম্মান বাড়তে পারে। তবে বড় কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক