আমেরিকার নির্বাচনের ফল ইতোমধ্যে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এতদিন কত না উত্তেজনা, হিসাব-নিকাশ। তবে এবারের হিসাবটা সব সময়ের চেয়ে সহজ মনে হলেও নির্বাচনের প্রথম তিন দিন সহজ হিসাবটা অনেকটাই যেন কেঁচে যাচ্ছিল আর সেটাই ঘুম হারাম করে দিয়েছিল পৃথিবীর বহু মানুষের। এবং সম্ভবত এবারের নির্বাচনই সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাবহুল নির্বাচন। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অনেক মানুষের ঘুম হারাম করেছে এই নির্বাচন। বিশেষ করে গতবারের নির্বাচনে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অনেকে দিন গুনছিলেন পরবর্তী নির্বাচনের জন্য। অন্য সময় হলে ভোট দেওয়া নিয়ে ততটা টেনশনে না থাকলেও বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই যারা এই সময় দেশে আছেন তারা উৎসাহ নিয়েই অগ্রিম ভোট দিয়েছেন।
আমেরিকার সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের দিন-রাতের পার্থক্য হওয়াতে কেউ কেউ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। কেউ একটু এদিক-ওদিক গেলেই কিংবা ফোন করলেই নির্বাচনের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য আঁকু-পাঁকু করছেন। রাস্তায় একবার একটা জরুরি কাজে বের হলাম, ফোনে একজন চিৎকার দিয়ে কথা বলছিল, ‘ট্রাম্প এত ভোট পায় কেমনে? মানুষ কী সব গরু নাকি? আরে চিন্তা কইরেন না, বাইডেনই জিতব শেষ পর্যন্ত, দোয়া রাখবেন শুধু।’ অথচ এই বাইডেন বা ট্রাম্প হয়তো জানেন না এ দেশের মতো অনেক দেশের মানুষই তাদের জন্য প্রার্থনা করছেন, দোয়া রাখছেন।
শুধু যে ‘শিক্ষিত’দের মধ্যেই এই নির্বাচন উত্তেজনা ছড়িয়েছে তা নয়, আমার বাসার সাহায্যকারী মেয়েটিও খবর দিল আমেরিকার নির্বাচনের কারণে নাকি তার অন্য বাসাগুলোতে রাতদিন টিভি খুলে রাখা হয়েছে। সেও কিছুতেই বুঝতে পারছে না এর কারণ কী? তিনি বলেছেন, ‘আমগো দেশের রাজা নির্বাচন না, হেগো দেশেরটাতে আমগো কী এত? আমগো তো কোনো লাভ নাই।’ তাই তো আমাদের কেন এত মাথাব্যথা, এত টেনশন? আমেরিকার রাজা কে হবে তা নিয়ে আমাদের দেশের বাস করা আদার ব্যাপারীদের এত উত্তেজনার কারণ কী? হুদাই কি এত উত্তেজনা? ট্রাম্প আবারও জিতলে কী সমস্যা হবে বাংলাদেশিদের? কিংবা বাইডেন জিতলে কী লাভ হবে? অনেকেই আমেরিকায় বসবাসরত তাদের আত্মীয়স্বজন থেকে বিভিন্ন রাজ্যের প্রচারণা, সমর্থন এবং নির্বাচনী খোঁজখবর পাচ্ছেন, তাদের অভিজ্ঞতায় সমর্থন দিতে প্রভাবিতও হচ্ছেন, প্রার্থীদের ভালো দিক, মন্দ দিক বিচার-বিবেচনায় আনছেন। অনেকে ফেসবুক লাইভে সেগুলো শেয়ার দিয়ে বাঙালি ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্প এবং বাইডেন- এই দুই প্রার্থীকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক, টক শোসহ অনেক অনুষ্ঠান অনেকেই শেয়ার দিয়েছেন।
আমি জানি, নিশ্চিতভাবেই জানি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের নির্বাচন এত মনোযোগ পায়নি। সব বাদ দিয়ে আমি আমেরিকায় বসবাস করি না কিংবা আমেরিকার কোনো কিছুর সঙ্গে আমার লাভ-লসের সম্পর্ক নেই, আমার মতো এ রকম অবস্থায় থাকা অনেকেই কেন এই নির্বাচন নিয়ে এত মাথা খারাপ করছেন?
বাংলাদেশের সবাই জানে যে, আমেরিকার রাজা মানেই বর্তমান পৃথিবীর রাজা। তার ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু। তাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন তা নিয়ে বিশ্বপ্রধানদের যে মাথাব্যথা থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদরাও এক ধরনের চিন্তায় ছিলেন। পর্দার আড়ালে থেকে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই বাংলাদেশসহ সব দেশের রাজনীতিতে নাক গলায় এবং ভূরাজনীতিতেও তাদের কৌশল ফলানোর চেষ্টা করে। তাই মোটা দাগে বলতে গেলে বলা যায়, সারাবিশ্বের রাজনীতির জন্যই আমেরিকার নির্বাচন এবং তার ফল একটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশ্ব বাস্তবতায় বর্তমানে আমেরিকা প্রধান সুপারপাওয়ার, তাদের সামরিক ঘাঁটি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাব এবং হস্তক্ষেপ- এসব কিছুর মধ্য দিয়ে তারা পুঁজিবাদী বিশ্বকে সবার সামনে জোরালোভাবে হাজির করেছে। তাই এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে অন্যান্য দেশের চেয়ে বাড়তি মনোযোগ দাবি করছে।
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নির্বাচনে সব দূতাবাসগুলো নড়েচড়ে ওঠে এবং রাজনীতিবিদদেরও সেই রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক, তাদের কাছে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করতে শোনা যায়। কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কোনো কোনো রাষ্ট্রদূতকে বাড়িতে দাওয়াত করেন। সবটার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হলো নির্বাচনে জয়লাভে তাদের সমর্থন পাওয়া এবং শুধু তাই নয়, সরকার গঠনেও তাদের সমর্থন প্রয়োজন হয়। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, সংসদ সদস্য মনোনয়ন এবং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বণ্টনের সময়ও বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করে। এর মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ভূমিকা কতখানি। পেছনের দরজা দিয়ে বা নেপথ্যে থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময় তারা কলকাঠি নেড়েছেন। তাই আমেরিকার নির্বাচন সত্যিই অনেকেরই ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট।
আমেরিকা শক্তিধর দেশ, তাতে কারও কোনো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তার নির্বাচন নিয়ে পত্রিকা, মিডিয়া সবাই আগ্রহের সঙ্গে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। এই কয়েকদিন দেশের ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে আরও কোনো কিছু সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতো করে পক্ষাপাতহীনভাবেই তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, যে-ই আসুক তাদের কোনো সমস্যা নেই। বিএনপিও বলছে একই কথা। তবে মনে মনে তারা হয়তো ভিন্নটাই চাচ্ছেন। বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, যে-ই আসুক তারা পুঁজিবাদকেই সম্প্রসারিত করবে। সেখানে আসলে পছন্দের জায়গা নেই তাদের।
শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরাই নন, বিভিন্ন ক্যাটাগরির মানুষকে ভাবতে হচ্ছে এই নির্বাচন নিয়ে। আমেরিকায় যাওয়া বা আমেরিকায় পড়োশোনা করতে যাবে এই ধরনের শিক্ষার্থীরাও খোঁজখবর রাখছেন নির্বাচনের। কারণ তারা আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে এডমিশন অফার লেটার নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু তারাও ভিসা পাচ্ছেন না। কারণ ভিসা দেওয়া হচ্ছে একেবারই লিমিটেড। তাই করোনা এবং নির্বাচন দুটোই তাদের জন্য বিবেচ্য বিষয় এই মুহূর্তে।
আরেক ক্যাটাগরির মানুষও আছেন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে, যাদের আত্মীয়স্বজনরা তাদের জন্য ইমিগ্রেশনের আবেদন করেছেন, তারা অপেক্ষা করছেন তাদের ভিসার জন্য। অন্যদিকে যারা দীর্ঘদিন ধরে ইমিগ্রেশনে ভিসা ফেস করার অপেক্ষায় আছেন তাদেরও এক ধরনের টেনশনের জায়গা এই নির্বাচন। কিন্তু করোনার আঘাত এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া বর্তমানে স্থবির হয়ে আছে বলে তারাও পড়ছেন বিপাকে। আমার একজন পরিচিত ইতোমধ্যেই জায়গা-জমি বিক্রি করে ফেলছেন এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে অনেকটাই প্রস্তুত ছিলেন আমেরিকায় চলে যাবেন বলে। কারণ তাদের আইনজীবী জানিয়েছিলেন তাদের ভিসা ডেট গত মার্চে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনায় সেটি আর হয়নি। এর মধ্যেই তাদের আত্মীয় আবেদনকারী করোনায় আমেরিকাতে মারা যান। এখন নতুন সরকারে কবে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া চালু হবে এবং তা কী ধরনের হবে সেটির ওপর নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ।
সেই নির্বাচন শেষ। এখন অপেক্ষার পালা। শেষ পর্যন্ত যে কারণে সবার এত চিন্তা, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা সেসবের কি সুরাহা মিলবে? হয়তো মিলবে, হয়তো না? তবু নতুনত্বের আবেশ দেয়, স্বপ্ন দেখায়।
ড. জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়