রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫২ পূর্বাহ্ন

‘শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ’ মানবজাতির লজ্জা

খন্দকার হাসনাত করিম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২০
  • ২২৯ বার

ফ্রান্সের বা কমবেশি অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ইসলাম-আতঙ্কের (Islamophobia) পেছনে একটা সুস্পষ্ট ঔপনিবেশিক মানসিকতাজনিত পটভূমি এবং দার্শনিক হীনমনস্কতা (Inferiority Complex) সক্রিয়। তাদের প্রাচ্যবিদ্বেষ যতটা না ধর্মবিরোধ, তার চেয়েও বেশি হলো উগ্র বর্ণবাদ (Racism) এবং ইতিহাস-দর্শনের সঙ্ঘাত। ওরা বলছে, ওরা চিন্তাসম্পদ পেয়েছে গ্রিক ও ল্যাটিন উৎস থেকে। কিন্তু কালের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া গ্রিক-ল্যাটিন চিন্তাসম্পদগুলো তো মুসলিম বিজয়ীরাই উদ্ধার করে প্রথমে ল্যাটিন ভাষায় এবং তা থেকে অনুবাদের পথ করে দিয়েছে ডাচ, ফরাসি, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, রুশ প্রভৃতি ইউরোপীয় ভাষায়। এই চিন্তাসম্পদ পুনরুদ্ধার এবং সেগুলোকে যে চিন্তাঝরনার পানিতে পরিশুদ্ধ করা হয় সেই জলধারারই একেকটি স্তর হলো আবু হানিফা আল ফারাবি, ইবনে সিনা, ইমাম গাজ্জালি, ইবনে খালদুন, আবু রুশদ, আবু তাঈমিয়া, ইবনুল আরাবি, আল কিন্দি, জাকারিয়া আল রাজি, হামিদ আদদ্বীন কিরমানি, নিজামুদ্দিন কুবরা, নাসিরুদ্দিন তুসি, ইবনুল নাফিস, কুতুবউদ্দিন সিরাজী, জামি (হপ্ত আওরোং-খ্যাত), মীর ফানদেরসি (ইবনে সিনা বিশারদ), রজব আল তাবরিজি, ইবনে হাজম, সোহরাওয়ার্দী (শিহাবউদ্দীন আল সোহরাওয়ার্দী (১১৫৪-১১৯১) প্রমুখ। দার্শনিক আল ফারাবিই জগতের সামনে তুলে ধরেন ইউক্লিড, টলেমি, হিপোক্রেটিস ও গালেনের মতো বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাসম্পদ। আল কিন্দি জগতকে উপহার দিয়েছিলেন অ্যারিস্টটল (Aristotol), আফলাতুন (Plato) প্রমুখকে। আর দার্শনিক রাজার (Philosopher King) যে ধারণা, সেটা মোটেও মূল গ্রিক অবদান নয়। এটি একান্তই আল ফারাবির চিন্তাধারা। আবু নসর আল ফারাবি (৮৭২-৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ) বিজ্ঞান, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যা, রাষ্ট্রদর্শন, গণিত ও সঙ্গীত গবেষণা মানবজাতির দার্শনিক ঔৎকর্ষের এক বিরাট ধাপ। (তার জন্ম কাজাখস্তানে, মৃত্যু সিরিয়ায়)।

উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনযুগকে বলা হয় মানবসভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের আতুরঘর। বিস্মৃতপ্রায় গ্রিক গণিতশাস্ত্র, জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রচিন্তাকে উদ্ধার করেছিলেন তখনকার দিনের মুসলিম মনীষীরা। আবার ‘The translation of Arabic Philosophical texts into Latin led to the transformation of almost all philosophical disciplines in the Mediaval Latin world with a particularly strong influence of Muslim Philosophers being felt in natural philosophy, psychology and metaphysics.” (Dag Nicholaus Hasse’s Influence of Arabic and Islamic Philosophy on the Latin West)

পাশ্চাত্যের জ্ঞান-গরিমা-প্রজ্ঞা ও চিন্তালোকে আরব ও মুসলিম মনীষার এ ধরনের অসংখ্য পর্যবেক্ষণ ছড়িয়ে আছে সত্যানুসন্ধিৎসু দার্শনিক ও গবেষকদের লেখা বইপত্রে। তাদের মধ্যে যে নামগুলো অ্যাকাডেমিক তাগিদেই মনে পড়ে যায় তাদের মধ্যে রয়েছেন- লেবিডেল, লুইস, লেন ইভান গুডম্যান, করবিন, জোনস আরউইন, আলিভার গুডম্যান, অর্মসবি, জর্জ মার্কদিসি, সি বার্নেট, সি এইচ হাসকিন্স, আরডব্লিউ সাউদার্ন, ডেভিড ক্যাম্পবেল, অ্যালেন জর্জ ডেবাস, জন হলমিয়ার্ড, জন ও কনর, পিটার মার্শাল, আর্নেস্ট মুডি, ফিলিপ গিসন, পল আর্থার, অ্যালঘিরি দাঁন্তে প্রমুখ। আরো অতীতের বিশ্ববিখ্যাত দর্শন-ইতিহাসবিদদের অনেকেই পাশ্চাত্য ভাবনাজগতে আরব তুর্কি, ইরানি, মধ্য এশীয়, ভারতবর্ষীয়, চীনা ও অন্যান্য প্রাচ্যদেশীয় দার্শনিকদের অবদানের কথা লিখে গেছেন। এসব নিরপেক্ষ ও রাজশক্তির অনুকম্পাত্যাগী, নির্ভীক গবেষক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে যে নামগুলো না নিলেই নয়, তাদের মধ্যে আমরা পাই দেকার্তে, Guillaum d Auvergne (প্রাচ্য দর্শনে পণ্ডিত), রজার বেকন (আবু রুশদ বিশারদ), স্পিনোজা (আরবি ও হিব্রু ভাষাবিদ), হান্স ব্যারন, রবার্ট ডি ব্ল্যাক, জেরি ব্রেটন, অ্যালিসন ব্রাউন, পি এফ ব্রাউন, জাঁ বার্কার, পিটার বার্ক, ভিনসেন্ট ক্রনিন, পিটার ক্রপেটকিন প্রমুখ।

এসব শত শত সত্যানুসন্ধি পশ্চিমা দর্শনের খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ বিগত কয়েক হাজার ধরে চলে আসা পাশ্চাত্য দর্শনে ইসলামের প্রভাব নিয়ে যেসব মহামূল্যবান চিন্তাসম্পদ এবং ইতিহাস রেখে গেছেন বর্ণবাদী স্যামুয়েল হান্টিংটন সে সব কিছু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তথাকথিত The Clash of Civilization তত্ত্বটি হাজির করেছেন। তিনি প্রাচ্যের আলোয় প্রতীচ্যের চিন্তাধারার উদ্ভাসকে অস্বীকার করে যে বুদ্ধিবৃত্তিক মিথ্যাচার এবং নয়া-বর্ণবাদ তুলে ধরেছেন, তারই ফলে আজকের এই প্রাচ্যবিদ্বেষ বা কৃষ্টিগত সঙ্ঘাকথিত তত্ত্ব বা বিষোদগার। প্রাচ্য দর্শনের প্রধান উপলক্ষ ছিল ‘প্রেম’ এবং তার ফলেই ঘটেছিল ‘সমন্বয়’। আর আজকের প্রাচ্যবিদ্বেষীদের চিন্তার পটভূমিতে রয়েছে ঔপনিবেশিকতার বিষ বা ‘বর্ণবাদ’। তারই ফসল আজকের এই মুসলিম-বিদ্বেষ, কৃষ্ণ-বিদ্বেষ, ল্যাটিন-বিদ্বেষ।

ভাবতেও এখনো গা শিউরে ওঠে যে, ইউরোপের ঔপনিবেশবাদী জলদস্যু জাতিগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জগতব্যাপী কী লুটতরাজই না চালিয়েছে! প্রতিরোধের মুখে উপনিবেশগুলো ছেড়ে এলেও তাই তারা এখনো তাদের দখল করা ধনভাণ্ডারগুলোর কথা ভুলতে পারে না। সাবেক উপনিবেশগুলোর অর্থসম্পদই কেবল লোটেনি তারা, তাদের ভাষা-শিল্প-সাহিত্যকলা-সংস্কৃতিকেও মারাত্মকভাবে জখম করেছে, আঘাত করেছে তাদের ঐতিহ্যসম্পদ। ভারতের মোগল বাদশাহীর রত্নপ্রতীক ‘কোহিনুর’ হীরকখণ্ডটি এখনো ব্রিটেনের মোহাফেজখানায়! ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জাহাজ নোঙর করে যাকে এখন আমরা বলছি বাহামায়। সেই স্পেনীয়রা পৃথিবীর ওই অংশের সমৃদ্ধ ‘মায়া’ ও ‘আজটেক’ সভ্যতার অবশেষগুলোকেও ধ্বংস করে। জাহাজে করে স্পেনে নিয়ে আসে পেরুর টনকে টন স্বর্ণ, যেমন ইংরেজরা ব্রিটেনে নিয়ে যায় ভারতবর্ষের হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ, হীরা ও রত্নরাজি।

১৪৯২ থেকে ১৮৩২ সাল পর্যন্ত গোটা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে চলে স্প্যানিশ জবরদখল ও লুটতরাজ। দখলের প্রথম আগ্রাসনেই ৮০ লাখ স্থানীয় মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে স্পেন। ইউরোপীয় গণহ্যার পাশাপাশি চলে ইউরোপ থেকে ওই মহাদেশে বয়ে নিয়ে যাওয়া প্রাণঘাতী মহামারী ‘প্লেগ’ রোগের বিনাশ, যেমনটি ছিল ব্রিটিশ ভারতে গুটিবসন্ত, ওলাওঠা (কলেরা) রোগের প্রাদুর্ভাব। ব্রিটিশ-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কারণে সেসব রোগের প্রাণঘাতী বিস্তার হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য।

স্প্যানিশদের দেখাদেখি দরিয়ায় লুটতরাজ ও জবরদখলের জাহাজ ভাসায় পর্তুগিজরা। তারা দখলে নেয় ব্রাজিল। সেখানে তারা ঔপনিবেশিক লুটতরাজ ও গণহত্যা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, জোর করে পর্তুগিজ ভাষা চাপিয়ে দেয় ব্রাজিলবাসীর জবানে। তাই ল্যাটিন বিশ্বে সর্বত্র স্প্যানিশ ভাষা চললেও ব্রাজিলে আজ পর্যন্ত চলছে পর্তুগিজ ভাষা। এভাবেই ওলন্দাজরা দক্ষিণ আফ্রিকায় চাপিয়ে দেয় ওলন্দাজ-মিশ্রিত নতুন এক ভাষা ‘আফ্রিকানার’। ওলন্দাজরা এদিকে শ্রীলঙ্কায় উপনিবেশ বানায় এবং ভারতের দক্ষিণ উপকূলীয় কেরালায় বাণিজ্যের নামে দখল বসায়। ওলন্দাজদের সবচেয়ে মূল্যবান ঔপনিবেশিক শিকার ছিল ইন্দোনেশীয় দ্বীপমালা। ওই পুরো এলাকাকে তারা বলত ‘পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ’। তবে তুলনামূলক বিচারে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ওলন্দাজ উপনিবেশ ছিল কম সংহারী এবং কম নারকীয়। ভারতের সুতানটি (বর্তমান কলকাতা), পণ্ডিচেরী ও চন্দননগরে খুঁটি গেড়ে বসে ফরাসিরা। তবে দীর্ঘ ইঙ্গ-ফরাসি নৌযুদ্ধে পরাজিত ফরাসিরা একপর্যায়ে ওগুলো ইংরেজদের বরাবরে হাওলা করে দিতে বাধ্য হয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকেও সাহায্য করেছিল ফরাসিরা। পর্তুগিজরা দখল করে গোয়া, দিউ, দমন ও তৎসংলগ্ন বিস্তীর্ণ ভারতীয় উপকূল। তারা পুরোপুরি দখল করে নেয় আফ্রিকার মোজাম্বিক আর ফরাসিরা দখল করে সিরিয়া, সেনেগাল, মরক্কো, তিউনিশিয়া, বিশেষ করে আলজেরিয়া। পর্তুগিজরা এক দিকে চালায় বেপরোয়া লুটপাট এবং একই সাথে বলপূর্বক ধর্মান্তরের মাধ্যমে রোমান ক্যাথলিক গির্জার বলয় বিস্তার, যেমনটা করেছিল ইংরেজরা ভারতবর্ষে। পাদ্রিদের সেই ধর্মান্তরের মাধ্যমে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পূর্ব বাংলার মুনশী মেহেরুল্লার মতো দেশপ্রেমিকরা। শহীদ তিতুমীর ও দুদু মিয়ার (হাজী শরিয়তউল্লাহ) বীরত্বগাথা ইতিহাসে কিংবদন্তিতুল্য হয়ে আছে। পুরো কঙ্গো (বায়াফ্রাকে) গোরস্তান বানিয়ে ছাড়ে নিষ্ঠুর বেলজীয়রা। বায়াফ্রার গণহত্যার সাথে তুলনা চলে দক্ষিণ আমেরিকায় (ল্যাটিন) চালানো পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ গণহত্যার।

ফরাসিরা শুধু আলজেরিয়াতেই নয়, মিসরের বুকেও চালায় নিষ্ঠুর গণহত্যা ও সর্ব প্রকার ঔপনিবেশিক অত্যাচার নিপীড়ন। মিসর ও তুরস্কও বাদ যায়নি ফরাসি নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে। জনগণের মরণপণ প্রতিরোধ সংগ্রামের সাথে যোগ দেন তুর্কি সুলতান স্বয়ং, ঠিক যেমনভাবে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জনযুদ্ধে যোগ দেন স্বয়ং মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ব্রিটিশরা সম্রাটের ১৪ জন পুত্রসন্তানকে জবাই করে তাদের কাটা মাথা বাদশাহকে ‘উপহার’ পাঠায়। সম্র্রাট অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বলে তারা তার প্রাণ হরণ না করে অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে বার্মায় দেশান্তরে পাঠায়। পরে বন্দী অবস্থায় বার্মাতেই সম্র্রাটের মৃত্যু ও দাফন হয়। তুর্কি সুলতানও দখলদার ফরাসিদের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধের ডাক দেন। ফরাসিরা ভারতে ব্রিটিশদের কর-নির্যাতনের মতো তুরস্ক ও মিসরের মানুষের ওপর নিবর্তনমূলক রাজস্ব-সন্ত্রাস চাপিয়ে দেয়। মামলুকদের সম্পত্তি দখলের নামে তারা ঢালাওভাবে গৃহস্থদের দলিল করা সম্পত্তিও ক্রোক করে নিলামে তোলে। তুরস্কে প্রচণ্ড গণ-অভ্যুখান ঘটে ১৭৯৮ সালে এবং ভারতে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের অনুপ্রেরণাই ছিল ১৭৯৮ সালের তুর্কি গণবিদ্রোহ (আমরা আজও কেন একে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলি কে জানে? স্বয়ং কার্ল মার্কস লিখে গেছেন, ভারতে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল আসলে ‘ভারতের প্রথম জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ’। ফরাসিদের বিরুদ্ধে মিসরের আলেমসমাজ গণজাগরণের প্রধান নেতৃত্ব দেন এবং আল আজহার মসজিদ পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্রে। ফরাসিরা এই মসজিদে কামান বসিয়ে বৃষ্টির মতো গোলা দেগে হাজার হাজার মুক্তিকামী তুর্কি ও আরব যোদ্ধাকে খুন করে। ঠিক একইভাবে কামানের মুখে বেঁধে ১৮৫৭ সালে ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিটিশরা তোপ দেগে খুন করত। (ব্রিটিশদের সেই তোপাগারটির একটি ছিল ঢাকায়, যে জায়গাটি এখন তোপখানা রোড নামে সবাই চেনে।)।

প্রাচ্যের ইতিহাস তো প্রতœসম্পদ উদ্ধার করে পাঠ করার জিনিসও নয়; খ্রিষ্টপূর্ব যুগেরও ইতিহাস নয়। হাজার হাজার বছরের চীনা দর্শন-ইতিহাস ও জ্ঞানের কথা পর্যন্ত স্পষ্ট লিপিতে ধারণ করা আছে। আর ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগের কথা তো সে তুলনায় অতি সাম্প্রতিককালেই বলা চলে। ইসলামের ইতিহাস ও দর্শন তার আপন মহিমাতেই ভাস্বর, যা বিশ্বাসীরা ছাড়াও ভিনধর্মী দার্শনিকরা অকপটে স্বীকার করে গেছেন। গ্রিক ও রোমান ইতিহাস-দর্শন যেমন বিজয়ী মুসলিমদের হাতে ধ্বংস না হয়ে পরম সমাদর ও ইজ্জতের সাথে প্রথমে ল্যাটিনে ও পরে ল্যাটিন থেকে অন্যান্য পাশ্চাত্য ভাষায় অনুবাদ হয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেছিল, তেমনি সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক দখলদারদের অনুগত দার্শনিক ও ইতিহাসবিদদের হাতে পড়ে বিকৃতি সাধিত হওয়ারও অপচেষ্টা চলেছে। যেমন ম্যাক্স মুলারের মতো পণ্ডিতের হাতে ভারতের সমৃদ্ধ মুসলিম অতীত হয়ে পড়ে বিস্মৃত ও বিকৃত। ইতিহাস নিয়ে এই জোচ্চুরি বহু ভারতীয় ছাত্র ও পণ্ডিতকেও সাম্প্রদায়িক বা মুসলিমবিদ্বেষী করে তোলে। এ কথা অনেকে তাদের জীবনীতে লিখেও গেছেন।

কিন্তু তার পরও বিবেকবান পশ্চিমা দার্শনিকরা ইসলামের দর্শন ও ভাবনা-সম্পদের প্রাচুর্য দেখে বিস্মিত না হয়ে পারেননি। বহু দার্শনিককে এ কথা লিখে যেতে দেখা গেছে, প্রাচ্যের ইসলামী দর্শন ইউরোপের জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক নববিন্যাসের মাধ্যমে সত্যিকারের নবজাগরণ ঘটাতে সাহায্য করে। পাশ্চাত্যের দর্শনকে ইসলামের প্রজ্ঞা ও দর্শন যে কতখানি প্রভাবিত করেছে তার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন বহু পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ। এদের নামের স্রেফ তালিকা লিখতেও এরকম কয়েক শ’ পৃষ্ঠা লেগে যাবে। বিশেষ করে যদি ইতিহাসবিদদের কথা বলতে হয় তাহলে, টি ডব্লিউ আরনল্ড, এডমন্ড বার্ক, লরেন্স ব্রাউন, জেমস মিশেনার, ল্যান্সলট লোটন, এ জে টয়েনবি, এ বার্থান্ড, এইচ এ আর গিব, এ এম লথ্রপ, আর্থার গ্লিন, জাঁ হিউরেস প্রমুখের নাম নিতেই হয়। অন্য দিকে মানব জাতির দর্শন সম্পদকে আবু হানিফা, আল ফারাবি, ইবনে সিনা, ইমাম গাজ্জালি, আবু রুশদ, ইবনে খালদুন, আবু তাঈমিয়াহ, ইবনুল আরাবি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আহমেদ সিরাহিন্দে, জামাল উদ্দিন আফগানি কিংবা আল্লামা ইকবালের মতো দার্শনিক যে কতখানি সমৃদ্ধ করে গেছেন সেই সত্য স্বীকার করেও স্রেফ প্রাচ্যবিদ্বেষ বা ‘ইসলামভীতির’ রোগে আক্রান্ত কোনো কোনো পশ্চিমা পণ্ডিতকে দেখা গেছে এ দেশের কবি রবীন্দ্রনাথের মতো হয় মুসলিম যুগকে পুরো উপেক্ষা করে গেছেন, নতুবা দুর্বলতা ও দ্বন্দ্ব তালাশে ব্যাপৃত থেকেছেন। এদের মধ্যেও তেমনি অনেকে আছেন যাদের তালিকা ছাপাতেও একটা বই হয়ে যাবে। তবে যে কয়েকজনের নাম জটজলদি মনে আসে তাদের মধ্যে আছেন প্রোটেস্ট্যান্টবাদের প্রবক্তা মার্টিন লুথার, ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার, টকভিল, কুইন্সি অ্যাডামস, স্টিফেন্স শোয়ার্জ, এ যুগের চার্চিল, এ্যাডওয়ার্ড সাইদ, খালিদ দুরান, জোহানা আনানি, সালমান রুশদি প্রমুখ।

এই তালিকায় শোপেন হাওয়ারের মতো মনীষীও আছেন, যিনি জাভা দ্বীপের বুনো জংলিরা তাদের বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করে পুড়িয়ে ভক্ষণ করলে সেই বর্বরতার দুঃখে ক্রন্দন শুরু করেন। অথচ আলজেরিয়ায় ফরাসিরা বদ্ধ ঘর জালিয়ে দিয়ে স্থানীয়দের পুড়িয়ে মারলেও প্রতিবাদ করেন না। জংলি স্যাভেজদের তো ওটা সংস্কৃতি বা কৃষ্টি আর আলজেরিয়ার গণহত্যা বা বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ঠাণ্ডা মাথায় পরিচালিত জাতিগত গণহত্যা বা এথনিক ক্লিঞ্জিং তো জার্মানদের অ্যান্টি-সেমিটিজমেরই পুনরাবৃত্তি, এ সত্যটি শোপেন হাওয়ারকে কে বোঝাবে? জ্ঞানী যখন পাপী হয় তখন তার চেয়ে বিপজ্জনক আর কে হতে পারে? চার্চিল আর্মেনীয়দের জন্য অশ্রুপাত করে গেছেন; কিন্তু বাংলায় তারই সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে তিন কোটি মানুষ যে কঙ্কালসার হতে হতে মৃত্যুবরণ করে, তার কী নিয়েছেন?

পাশ্চাত্যের এসব ভণ্ড পণ্ডিত ও ইতিহাস বিকৃতকারী কূপমণ্ডুকের হাত থেকে পাশ্চাত্য ইতিহাস ও দর্শনের নিরপেক্ষ বিশ্ববীক্ষা এবং সত্যানুসন্ধানের সততা রক্ষা করা আজ সভ্যতারই দাবি। নব্য শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভরাডুবি থেকে স্পষ্ট হলো শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ এখনো মানুষের শুভবুদ্ধি এবং শুভশক্তির বিনাশ ঘটাতে পারেনি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com