যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বেরিয়েছে দুই সপ্তাহের বেশি হলো। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার মধ্যে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। অথচ মার্কিন রীতি অনুযায়ী হওয়ার কথা ছিল- ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার করে হবু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অভিনন্দন জানাবেন, ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার করবনে। ট্রাম্প তা তো করছেনই না উল্টো এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন যাতে করে নতুন প্রেসিডেন্টের পথচলা জটিল হয়ে পড়ে।
গেল এক সপ্তাহের ট্রাম্প বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যা বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অবস্থানকে বেশ বিতর্কিত করে তুলেছে। ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকে ছিল ইরানের ওপর খড়্্গহস্ত। ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে গিয়ে পুরনো সব নিষেধাজ্ঞা তেহরানের ওপর আরোপ করেছে। এর সঙ্গে আরও নতুন এবং কঠোর নিষেধাজ্ঞা যোগ করেছেন ট্রাম্প। অর্থাৎ শুরু থেকেই ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে ‘সর্বোচ্চ চাপে’ রেখেছে। এখানেও থেমে থাকেননি। ট্রাম্প ক্ষমতার মেয়াদের একেবারে শেষপ্রান্তে গত
বুধবার তেহরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন- যার আওতায় ১০ ব্যক্তিসহ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এর পরও কথা থেকে যাচ্ছে, আসলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও হয়তো ইরানের ওপর ট্রাম্পের ক্ষোভের প্রশমন হচ্ছিল না। তাই তিনি ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনাতেও হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। সম্প্রতি মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি বৈঠকে তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন হামলার উপায় বের করতে। শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে, বড় ধরনের সংঘাত হতে পারে- কর্মকর্তাদের এমন ভাষ্যে সেই পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসেন ট্রাম্প।
নির্বাচনে পরাজিত হয়েও ট্রাম্প নিজের অবস্থান একটুও পরিবর্তন করেননি। শুরুর দিকে আমরা দেখেছি, কিছুদিন পর পর ট্রাম্প প্রশাসন থেকে একে একে কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হচ্ছে অথবা পদত্যাগ করছেন। নির্বাচনের পরও সেই ধারা অব্যাহত
রয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারকে বরখাস্ত করেছেন ট্রাম্প। তার জায়গায় বসিয়েছেন ক্রিস্টোফার মিলারকে। আর মিলার দায়িত্ব পাওয়ার পরই যে বক্তব্য দিয়েছেন যা ট্রাম্প কিছুদিন আগে থেকেই বলে আসছেন। মিলার বলেছেন আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে আরও সেনা কমিয়ে আনবেন। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন শীর্ষ রিপাবলিকান নেতৃবৃন্দও। কেননা শেষ মুহূর্তে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক এ ধরনের স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত যা নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে। সর্বশেষ ট্রাম্প যে সমালোচিত পদক্ষেপটি নিয়েছেন তা হলো শীর্ষ নির্বাচনী কর্মকর্তা ক্রিস ক্রেবসকে বরাখাস্ত করা। ক্রেবস একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান যা মার্কিন নির্বাচনের স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করে। আর সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠান বিবৃতিতে জানিয়েছে নির্বাচনে কোনো কারচুপি তো হয়নি বরং মার্কিন ইতিহাসে এটি সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো ভিত্তিহীন। আর এতেই চটে গেছেন ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার ট্রাম্প টুইট করে জানিয়েছে ‘মারাত্মক ভুল’ মন্তব্য করায় ক্রেবসকে তিনি বহিষ্কার করেছেন।
এদিকে শোনা যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনে যারা আস্থা হারিয়েছেন বা বরখাস্ত হয়েছেন তারা যোগাযোগ করছেন বাইডেন শিবিবেরর সঙ্গে। এ ছাড়া সিএনএনের খবরে বলা হয়, হোয়াইট হাউসের অনেক কর্মকর্তাই ট্রাম্পের ওপর হতাশ হয়ে বাইডেনকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতি যখন এমন ঠিক এমন সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ১০ দিনের সফরে বেরিয়েছেন। আর এর মধ্যেই তিনি ফিলিস্তিনের দখলকৃত পশ্চিমতীরে অবৈধ ও বিতর্কিত গোলান পরিদর্শন করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ‘বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর’ কাছে ট্রাম্প প্রশাসনের শেষবার্তা পৌঁছাতেই পম্পেও এই ম্যারাথন সফরে নেমেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ঝা-া উড়িয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন সেটি হলো ‘আমেরিকা মহান’। নিজের দেশকে তিনি সবার ওপরে দেখতে চেয়েছিলেন। বলা যায় এটি তার মূলমন্ত্র। এমনকি ক্ষমতার শেষপ্রান্তে এসেও তিনি সেই দীক্ষা থেকে পিছপা হননি। নির্বাচনে হেরেছেন বটে নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন। হয়তো এভাবেই তিনি ক্ষমতা থেকে সরে যাবেন, পরাজয় স্বীকার করবেন না কিন্তু বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন আসলে তিনি কী চান। এ ছাড়া ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন কিন্তু পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, তিনি গত নির্বাচনের তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ ট্রাম্পের ‘আমেরিকা মহান’ মতবাদের ভোক্তা নিহায়ত কম নয়।