রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০২ পূর্বাহ্ন

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০
  • ১৯৯ বার

শিক্ষা নিয়ে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে প্রাথমিক স্তরে ভর্তির হার শতভাগে উন্নীতকরণ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে গিয়ে এই শিক্ষার্থীদের একটি বিপুল অংশ ঝরে পড়ছে। মাধ্যমিক স্তর একজন শিক্ষার্থীর সুস্থ-সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা এবং মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এই স্তরে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ায় আমাদের মানবশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এখানেই সম্ভাবনাময় দক্ষ জনশক্তির একটি বিশাল অংশ জীবনের শুরুতেই হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে এদের পেছনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকার যে বিনিয়োগ করছে তা কোনো কাজেই আসছে না। অন্য দিকে, তাদের পরিবারগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে ঝরে পড়া এই শিক্ষার্থীরা যা শিখল তা খুব সহজেই ভুলে যায়।

শিক্ষার্থীদের এই অকালে ঝরে পড়া বেশ কয়েকটি কারণে হতে পারে। তবে এ যাবৎ দেখা গেছে, অভিভাবকদের অসচেতনতা ও দারিদ্র্যের কারণেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। প্রাকৃতিক নানা বৈরী পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। প্রতি বছর ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা অনেকাংশে বেড়ে যায়। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর বন্যাও হয়েছে বেশ কয়েকবার। কৃষকরা ফসলি জমিসহ নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং, যেকোনো বছরের তুলনায় ঝরে পড়ার এই সংখ্যা আগামীতে ব্যাপক হবে। এখন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে তাই এর সঠিক পরিসংখ্যান জানা মুশকিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনার প্রভাবে বিশে^ প্রায় এক কোটির মতো শিশু আর কখনো স্কুলে ফিরবে না। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে গরিব দেশগুলো শিক্ষা খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হবে। এরই প্রভাবে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কা বিশ^ময় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে করোনা অতিমারীর নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষাব্যবস্থায় পড়েছে। অন্য খাতগুলো কিছুটা হলেও এই ক্ষতি পুষিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু শিক্ষাব্যস্থার সেই দুরবস্থা এখনো কাটেনি। তবে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষতি পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ ক্ষেত্রে বেশ সফলতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

করোনা অতিমারীর কারণে মানুষের আয় কমেছে। এ অবস্থায় দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে, এমনটাই ধরে নেয়া হচ্ছে। দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে আসায় নি¤œ ও স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়ই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আবার অনেক মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি ও শিল্প কারখানার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কারণে অনেকে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে তারা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। এসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা দিন দিন প্রবল হচ্ছে। আর এই অতিমারী যতই দীর্ঘায়িত হবে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তত বাড়তে থাকবে। সেই সাথে বাড়বে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যাও।
পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। তখন এসব বন্যাকবলিত, দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের পরিবারের কতজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত থাকবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। করোনাকাল অতিক্রান্ত হলে এসব পরিবারগুলোর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা করার সক্ষমতা হারাবে- এটাই স্বাভাবিক। দেখার বিষয়, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কারণ এর ওপরই নির্ভর করছে দেশে কতজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। নাকি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।

সরকারের উচিত এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রমে সম্পৃক্তকরণের নিমিত্তে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আর সেটা হতে পারে বিশেষ কোনো সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে। সচ্ছল পরিবারের তুলনায় দরিদ্র পরিবারে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা অনেক বেশি। অন্য দিকে শহরের চেয়ে মফস্বল এলাকায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও বেশি। এর সাথে অন্যান্য কারণ তো আছেই। তাই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের জন্য সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি এখনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে এসব শিক্ষার্থী ক্রমেই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আগামী বছরগুলোতেও এ ঝরে পড়ার হার আরো বাড়তে থাকবে যার দ্বারা এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ বাধাগ্রস্ত হবে।
সেইসাথে এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় ও শনাক্তকরণে প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে সমাজের সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসবে না। যেহেতু দেশের করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে জীবন ও জীবিকার তাগিদে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে; এমন পরিস্থিতিতে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে এলাকাভিত্তিক জরিপ ছাড়া এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বের করা দুরূহ ব্যাপার। এই জরিপ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়েই শিক্ষা প্রশাসনকে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। যাতে এটি কাগজে-কলমে নামমাত্র জরিপে পরিণত না হয়।

যেসব শিক্ষার্থী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছে, তাদের মধ্যে এমন অনেক শিক্ষার্থীও আছে, যাদের অভিভাবকদের আবার শহরে ফিরে যাওয়ার আর্থিক সঙ্গতি নেই কিংবা তারা জীবন-জীবিকার কারণে জায়গা বদল করেছেন। এমন অভিভাবকদের সন্তানদের নিকটস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়টি ভাবতে হবে। যদি তাদের পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান থেকে টিসি আনা বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলে তারা ঝামেলায় পড়তে পারেন। তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানে তাদের বেতন পরিশোধ করতে হতে পারে। এটি নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি করবে। কারণ অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই করোনার মধ্যেও বেতন ও পরীক্ষার ফি আদায়ের নানা কৌশল আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com