অস্বীকার করার উপায় নেই, স্থানীয় শাসনকাঠামোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর উপজেলা। এর পরিষদ ও প্রশাসন পরিচালিত হয়ে থাকে নির্দিষ্ট আইন ও বিধিমালার ভিত্তিতে। কিন্তু সেই আইন ও বিধিমালায় যদি অসংগতি, অস্পষ্টতা ও স্ববিরোধিতা থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপজেলা পরিষদ অকার্যকর হতে বাধ্য। তদুপরি মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচার তো আছেই।
গত শনিবার বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনের নানা সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছে। এই পাঁচ দফায় উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত ১৭টি বিভাগের কার্যক্রম উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত করা, উপজেলাধীন সব রাজস্ব জমা-বিভাজন ব্যয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে সম্পাদন করার কথা আছে। আছে ২০১০ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী সব সরকারি নথিপত্রে উপজেলা প্রশাসনের স্থলে ‘উপজেলা পরিষদ’ ব্যবহার এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সংবিধান ও উপজেলা আইনবহির্ভূত পরিপত্রগুলো সংশোধন করার দাবিও।
অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) আমলাতান্ত্রিক মনোভাব জনপ্রতিনিধিদের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলেও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা (ইউএনও) সবকিছু উপেক্ষা করে উপজেলায় শাসকের দায়িত্ব পালন করছেন।’
আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ শুরু থেকে বিতর্কের ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারেনি। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই পরিষদ করেছিলেন তৃণমূল পর্যায়ে নিজের রাজনৈতিক ভিত শক্ত করতে। তাঁর শাসনামলে অনুষ্ঠিত প্রথম ও দ্বিতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দল বর্জন করেছিল। বিএনপির আমলে পুরোপুরি উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নতুন করে উপজেলা পরিষদ পদ্ধতি চালু হয়। কিন্তু আইনি জটিলতা রয়েই গেছে, যা উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সংবাদ সম্মেলনে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এর আগে তারা স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবকে লিখিতভাবে এসব বিষয় জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে। উচ্চ আদালতেও প্রতিকারের জন্য ধরনা দিয়েছে। দাবি না মানা হলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন উপজেলা পরিষদের নেতারা।
বর্তমানে উপজেলা পরিষদে যাঁরা আছেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগের। সরকারও আওয়ামী লীগের। তাহলে তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এ মুখোমুখি অবস্থান কেন? অনেক দেনদরবারের পর ১৭টি বিভাগ উপজেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত করার ঘোষণাও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি আইনি জটিলতার কারণে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকদের গাফিলতি ছিল। সরকারের এ মনোভাব প্রমাণ করে না যে তারা স্থানীয় স্বশাসনকে ক্ষমতায়িত করতে আগ্রহী। সরকার যদি আগ্রহী না হয়, কর্মকর্তারা সেই সুযোগ নেবেনই।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত প্রতিনিধি। আর ইউএনওসহ সেখানে অবস্থানরত সরকারি কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়োজিত। এখানে কেউ কারও ওপর খবরদারি বা জবরদস্তি করার সুযোগ নেই। তবে জনপ্রতিনিধিরাও যখন সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে গণতান্ত্রিক আচরণ দাবি করছেন, তখন তাঁদের নিজেদের আচরণেও গণতান্ত্রিক মনোভাব থাকা প্রয়োজন।
উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের মধ্যকার বিরোধ দীর্ঘদিনের। অবিলম্বে এ সমস্যার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচিত উপজেলা পরিষদকে উপেক্ষা করা যাবে না। উপজেলা পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একে অপরকে ‘শত্রু’ না ভেবে পরিপূরক হিসেবে কাজ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত।