[ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর সমঝোতায় পৌঁছার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, যা আব্রাহাম অ্যাকর্ডস বা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। লেখাটিতে এ চুক্তির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।]
যদি ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধকে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তবে এ দ্বন্দ্ব ৫৩ বছর ধরে চলছে। চলমান এ সংঘর্ষের শুরুকে ১৯৪৭ সালের যুদ্ধ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এ দ্বন্দ্ব অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলছে। এ সময়ের মধ্যে হয়েছে বহু জীবনহানি এবং মানবিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়।
এ অঞ্চলে ক্ষমতা ও প্রভাবের কেন্দ্রে থাকা বেশিরভাগ মানুষ হয় ১৯৬৭ সালে শিশু ছিল অথবা তখনও জন্মগ্রহণ করেননি। এ অঞ্চলের আরব ও মুসলিমরা বড় হয়েছে ফিলিস্তিন সংকটের প্রতি সহানুভূতিশীল অনুভূতি নিয়েই, যা আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের ফলে শুধু দেশ দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং এর প্রভাব সমগ্র অঞ্চলকেই এক জায়গায় আটকে রেখেছে। আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করছি, যেখানে এক দেশ বা জনপদের উন্নয়নের প্রভাব দ্রুত অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারী এ ক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট উদাহরণ এবং এটি সম্ভবত ইন্টারনেট যুগের প্রথম স্বীকৃত বৈশ্বিক সংকট, যা প্রশমনে বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত সাড়া প্রয়োজন।
সম্ভাবনাময় এ ভূখণ্ডটির ক্ষয়ক্ষতি ও হুমকি মোকাবিলা করা এখন পুরনো প্রচলিত পদ্ধতিতে কঠিন হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভ্যুদয়ের পর থেকে গত অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে আমরা এ অকল্পনীয় বিষয়টি লক্ষ করে আসছি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এ বিপ্লবের যুগে যখন পেট্রোডলারের রাজনীতি, একমেরু ও দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামো প্রায় ভেঙে পড়ছে, তখন যে কোনো উদ্যোগেই যথেষ্ট সম্ভাবনা ও ঝুঁকি থাকে। সেকেলে চিন্তাভাবনা যখন অচল হয়ে পড়েছে পরিবর্তনশীল এ বিশ্বে, তখন কেউই নিজেকে পরিবর্তন না করে থাকতে পারে না। পুরনো ধ্যান ধারণায় বা মতবাদে বিশ্বাসীরা সময়ের প্রয়োজন বা সুযোগ অনুধাবন করতে না পারলেও নতুনরা পারে; কারণ তরুণ প্রজন্ম সময়ের সৃষ্টি। প্রবীণরা যদি তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা থেকে কোনো মতবাদ নাকচ করে দেয়, নতুন প্রজন্মের তা জানার অধিকার রয়েছে; কারণ নতুন প্রজন্মকেই এর সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে।
২০২০ সালের ১৩ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইল দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ নেয়। যদিও এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না; কিন্তু আমিরাত দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে উপলব্ধি করে আসছে শধু ফিলিস্তিনই নয়, বরং এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সাধারণ সমস্যাগুলো একত্রে মোকাবিলা এবং আঞ্চলিক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তনের বিষয়টি খুবই জরুরি। এবারের আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে জাতিসংঘে পাঠানো বিবৃতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শেখ খলিফা বিন যায়েদ আল নাহিয়ান বেশ দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেছেন, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার চলমান অচলাবস্থার অবসান ও দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ প্রবর্তন ছাড়া আমিরাতের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
জনসংখ্যা ও বয়সের দিক থেকে আমিরাত কনিষ্ঠ হলেও নতুনত্ব ও উদ্ভাবনী ধারণার ওপরই দেশটি প্রতিষ্ঠিত। আমাদের অগ্রগতির প্রতিটি পদক্ষেপকেই অন্যরা অসম্ভব মনে করত। কারণ তা ছিল অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ ও সর্বোৎকৃষ্ট জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতি। আরব ও মুসলিম তরুণ প্রজন্মের সামনে উদাহরণ হয়ে রয়েছে যে, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং নিজেকে পরিবর্তনের অদম্য ইচ্ছা শক্তি থাকলে সব কিছুই সম্ভব। এ অদম্য ইচ্ছা শক্তির প্রতিফলনই হচ্ছে আমাদের মঙ্গলগ্রহে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ অভিযান এবং কোভিড-১৯ মহামারীর এ কঠিন সময়ে বিশ্বব্যাপী মেডিকেল সহায়তা প্রেরণের সিদ্ধান্ত। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা এবং এর অভিযোজন প্রক্রিয়ার লড়াইয়েও আমিরাত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আব্রাহাম অ্যাকর্ডস হচ্ছে আমিরাতের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশারই অংশ, যা একটি সহনশীল অঞ্চল গঠনে সহায়তা করবে। জাতিসংঘের পাঠানো ওই বিবৃতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শেখ খলিফা বিন যায়েদ আল নাহিয়ান ইতোমধ্যে দৃঢ়ভাবেই বলেছেন, আব্রাহাম অ্যাকর্ডস মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্য উন্নত, নিরাপদ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করবে। চুক্তির ফলে ফিলিস্তিনের জনগণ অবশ্যই লাভবান হবে। এ চুক্তির ফলে আমাদের নতুন কিছু গ্রহণের জন্য সমঝোতার দ্বার উন্মুক্ত রাখা হয়েছে (বিশেষত, দ্বি-রাষ্ট্রতত্ত্বের ভিত্তিতে সমাধানের কথা বলা হলেও ইসরাইলের ভূমি অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনায় তা নস্যাৎ হয়ে যেতে পারত)।
স্থায়ী সমাধানে আসার জন্য দশকের পর দশক দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ ও বৈরিতার পর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়াটি দুদেশের জন্যই একটা সুযোগ করে দিয়েছে, তবে এটি তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন শান্তির উদ্দেশ্য এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘদিন একই কাজের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে আসা একই ফলাফলের চেয়ে নতুন বিকল্প কোনো উদ্যোগই ভালো কিছু বয়ে আনবে।
সত্তরের দশক থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়ে সংহতি জানিয়ে আসছে এবং এ বিষয়ে সোচ্চার রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে পূর্ণ অবগত; কারণ আমরা বাংলাদেশের সঙ্গেই রয়েছি। আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আব্রাহাম অ্যাকর্ডস বা ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির প্রতি আস্থা রাখতে এবং চুক্তির ফলে অখণ্ড অংশীদার হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের এবং মিত্রদের কী লাভ হবে তা বিবেচনায় আনতে।
বাংলাদেশে অবস্থিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত
খলিফা শাহীন আলমারার : সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক সহকারী মন্ত্রী