ছোটবেলায় ছবি দেখেছিলাম একটি ভয়ানক দানবের, নাম কিংকং, নিউইয়র্ক শহরের আকাশচুম্বী ভবনগুলোর একছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সব কিছু ভাঙচুর করছে। তার বাহুর মধ্যে এক তরুণী, তাকে ছোট্ট পুতুলের মতো দেখাচ্ছে। প্রাণভয়ে সেই পুতুল কাঁদছে। তাকে রক্ষা করার কেউ নেই।
বন্দুক, রাইফেল, কামান কোনো কিছুই দানবকে কিছু করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত লোহার জাল আনা হলো, বহু কষ্টে সেই জালে তাকে বন্দি করে ছাদ থেকে নামিয়ে আনা হলো। জালবন্দি থাকাকালে কিংকংয়ের সে কী গর্জন! মনে হয় এই বুঝি জাল ছিঁড়ে মাটিতে নেমে এসে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করবে।
বহুকাল পর বুড়ো বয়সে সেই একই কিংকং দানবের ছবি দেখলাম আমেরিকা নামক দেশটিতেই। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে হুঙ্কার দানরত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি দেখেছি। সে এক ভয়াবহ ছবি। পিকাসো এই ভয়ংকর মুখ পেলে নিঃসন্দেহে ছবি আঁকতেন। এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর জালবন্দি ট্রাম্পের ছবি দেখছি।
মনে হয় জাল থেকে কিংকং হয়ে তিনি এখনই বেরিয়ে আসবেন। তার বাহুর তলে থাকবে সেই পুতুলের মতো তরুণী-আর্তস্বরে কাঁদছে। মনে হয় গোটা আমেরিকা সেই তরুণীর রূপ ধরে কাঁদছে। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, নিজেই একজন অসুখী মানুষ। পারবেন কি এই আমেরিকার দুঃখ দূর করতে?
জো বাইডেনকে দেখলে তার আগের এক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের কথা মনে পড়ে। তিনি অসুখী মানুষ ছিলেন না। তার চীনা বাদামের ব্যবসা আর সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে সুখী মানুষ ছিলেন। তিনি আমেরিকাকে মানবতাবাদী করবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পারেননি।
আমেরিকার এস্টাবলিশমেন্ট মানবতাবাদী নয়। তিনি দেশটাকে মানবতাবাদী করবেন কী করে? তিনি তার এস্টাবলিশমেন্টের একটা বড় আশা পূর্ণ করেছেন। তিনি ইসরাইলের পরমশত্রু মিসরকে ইহুদি রাষ্ট্রের পরম মিত্র বানিয়েছেন। আরব-ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছেন। প্যালিস্টিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের আশা-আকাঙ্ক্ষা গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছেন।
জিমি কার্টার যুদ্ধবাদী প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। জো বাইডেনও নন। আমেরিকার এস্টাবলিশমেন্ট ও অস্ত্র ব্যবসায়ী কার্টেলগুলোকে খুশি করতে না পারায় জিমি কার্টার মাত্র এক টার্ম প্রেসিডেন্ট পদে থেকে হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নিয়ে তার চীনা বাদামের ব্যবসায় ফিরে গিয়েছিলেন। জো বাইডেনের ভাগ্যে কী আছে তা বলা মুশকিল। তাকে একহাতে কোভিড-১৯-এর দানবের বিরুদ্ধে, অন্য হাতে ভয়াবহ ট্রাম্পইজমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যুদ্ধে তিনি কতটা জয়ী হবেন সে সম্পর্কে মার্কিন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ততটা আশাবাদী নন।
জো বাইডেন অসুখী, তবে উচ্চাভিলাষী মানুষ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন এটা তার আজীবনের আকাঙ্ক্ষা। ভাগ্য তাকে বারবার আঘাত করেছে। তার সুখ ও সাফল্যের পথে কাঁটা বিছিয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে বাইডেন যখন মাত্র ২৯ বছরের যুবক, সিনেটে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তখন তার স্ত্রী নেইলা এবং মেয়ে নাওমী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
তারপর ছেলে বুয়ো মারা যান ক্যান্সারে। তারপর ঘটে আরেকটি বড় দুর্ঘটনা। কেউজ কোডের কাছে নালটাকেটে আটলান্টিকের পাড়ঘেঁষে ছিল তাদের পারিবারিক রিট্রিট। এই রিট্রিটে জো বাইডেনের গোটা পরিবার থ্যাঙ্কস গিভিং ডেতে জড়ো হতেন। গোটা পরিবার একসঙ্গে ছবি তোলেন।
সেই পারিবারিক ঐতিহ্যের মতো ঘরটি অকস্মাৎ বাইডেনের চোখের সামনে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একটার পর একটা পারিবারিক ট্র্যাজেডিতে বাইডেন ভেঙে পড়েন। তিনি এক সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
জো বাইডেনের রাজনৈতিক জীবনও সরলরেখায় চলেনি। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি সিনেটর হয়েছেন বটে, কিন্তু একবার প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট দলের নমিনেশন চেয়ে পাননি। নমিনেশন পেয়েছিলেন বারাক ওবামা, ওবামা তাকে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে গ্রহণ করেন।
এবার তিনি প্রেসিডেন্ট পদে দলের নমিনেশন পান এবং নির্বাচনে জয়ীও হন, কিন্তু তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে সভ্যতা-ভব্যতাবর্জিত এক সিটিং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। যিনি শুধু কথায় নন, কাজেও হিংস্র। তার রাজনীতি বর্ণবাদী ও ফ্যাসিবাদী। তার সমর্থকরা কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে হামলা চালাতে দ্বিধা করেনি।
ট্রাম্প অভিশংসনেরও পরোয়া করেন না। এখনো পরাজয় মানেননি। তবে ২০ জানুয়ারি তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। এই সময় দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতে পারে এই আশঙ্কায় সামরিক বাহিনী সারা দেশে ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানও হবে অত্যন্ত কঠোর সতর্কতায়। সভা-শোভাযাত্রা আনন্দানুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।
সবাই এখন স্বীকার করছেন, ট্রাম্পের চার বছরের শাসনকাল ছিল আমেরিকার জন্য এক অন্ধকার যুগ। আমেরিকার গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি তিনি সম্পূর্ণ নষ্ট করেছেন। আমেরিকার গণতন্ত্রের ইনস্টিটিউটগুলোকে সম্পূর্ণ ভাঙতে চেয়েছিলেন। গত শতকের ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের কায়দায় আমেরিকায় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন।
তার এই চেষ্টা যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, তা এখনো কেউ বলতে পারে না। তার ইচ্ছাকৃত অবহেলায় আমেরিকায় করোনা মহামারিতে লাখ লাখ নরনারীর মৃত্যু হয়েছে। আমেরিকা আধুনিক বিজ্ঞানে ওষুধ শিল্পে সবচেয়ে উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্পের ঔদাসীন্য ও অবহেলায় করোনা প্রতিরোধক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সারা আমেরিকা এখন এক মৃত্যু উপত্যকা।
প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েই বাইডেন তাই বলেছেন, হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করেই তার প্রথম দায়িত্ব হবে মহামারি ঠেকানো এবং দ্বিতীয় চেষ্টা হবে ট্রাম্প আমেরিকার জন্য যে অন্ধকার যুগ সৃষ্টি করে গেছেন, তা থেকে আমেরিকাকে মুক্ত করা। করোনা ঠেকানোর জন্য বাইডেন কোটি কোটি টাকার এক পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছেন।
অন্ধকার ট্রাম্প যুগ থেকে তিনি কীভাবে দ্রুত আমেরিকাকে উদ্ধার করবেন, তার পরিকল্পনাও তিনি আঁটছেন। কিন্তু ভয়ংকর ফ্যাসিবাদের কবল থেকে আমেরিকাকে তিনি পূর্ব গৌরবে কতদিনে ফিরিয়ে নিতে পারবেন অথবা আদৌ পারবেন কিনা সে সম্পর্কে অনেকেই নিশ্চিত নন।
একবার কোনো দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে এবং কোনো ধরনের ফ্যাসিবাদ সেই ফাটলে ঢুকে পড়লে তাকে দূর করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমরা বাংলাদেশের দিকে চেয়ে দেখতে পারি। ১৯৭৫ সালের আগে বাংলাদেশে যেটুকু গণতন্ত্র ও কথা বলার স্বাধীনতা ছিল তা আজ নেই বললেই চলে। সমাজ ধর্মীয় কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন।
দুর্নীতি প্রতিপদে। ধর্মের স্থান দখল করেছে ধর্মীয় রাজনীতি অথবা ধর্মের ব্যবসা। নারীদের নিরাপত্তা নেই, বুদ্ধিজীবীরা বিব্রত অথবা বিভ্রান্ত। এই বাংলা এককালে এমন ছিল না। ২১ বছরের সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসনে বাংলাদেশকেও এক অন্ধকার যুগ অতিক্রম করতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে এই অন্ধকার যুগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়েছে। কিন্তু এই লড়াইয়ে এখনো জয়ী হতে পারেনি। দেশটির বৈষয়িক উন্নতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ। স্বৈরাচারী শাসকরা এই অবস্থা তৈরি করে গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার এই অবক্ষয় ঠেকাতে পারছে না। বরং অবক্ষয় ঠেকাতে গিয়ে নিজেরাও অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছেন।
দুর্বল গণতন্ত্র দ্বারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। তার উদাহরণ গত শতকের ইতালি, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল। শেখ হাসিনা যতদিন দুর্বল গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোকে দমন করার চেষ্টা করেছেন, ততদিন পারেননি। অতঃপর কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রকে অনুসরণের পর তিনি বহু লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশি ট্রাম্পদের ক্ষমতাসীন হতে দেননি।
আমেরিকায় জো বাইডেনকেও তার দেশে উদীয়মান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নইলে তিনি আমেরিকাকে ট্রাম্প যুগের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করতে পারবেন না। দেশটিতে বর্ণবাদ ও ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিতে পারলে বর্তমান নির্বাচনে পরাজয়ের ক্ষতি পুষিয়ে আগামী নির্বাচনে তারা হোয়াইট হাউজ দখলের চেষ্টা করবে।
হয়তো পারবেও। যদি জো বাইডেন নিজেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মতো একজন শক্ত প্রেসিডেন্ট প্রমাণ করতে না পারেন, জাতির সামনে নিউ ডিলের মতো কোনো প্রণোদনামূলক জাতিগঠন পরিকল্পনা তুলে ধরতে না পারেন, তাহলে তিনি সফল হবেন না।
জো বাইডেন নম্র স্বভাবের ভদ্রলোক। কিন্তু তার সাংগঠনিক শক্তি প্রচুর। ব্যক্তিগত জীবনের বহু ট্র্যাজেডি কাটিয়ে উঠে তিনি অন্ধকারে বিপন্ন আমেরিকার হাল ধরেছেন। তিনি কতটা সফল হবেন তার আভাস আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কেউ চায় না তিনি জিমি কার্টারের মতো একজন অসফল প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নেন।