কথায় বলে, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। আপনি বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার শান্তির সেরা পদক পাবেন অথচ কোনো দুর্যোগে মুখ খুলবেন না এটা কি মানা যায়? না তা শোভন? আমাদের দেশে কেউ কোনোকালে নোবেল পাবেন এমন আমরা আসলেই ভাবতে পারিনি। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাঙালি যে নোবেল জয় করেনি তেমন নয়। তবে সে জয় আসেনি স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলাদেশিদের হাত ধরে। অতঃপর আমাদের একজন পেয়ে গেলেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। আমরা আনন্দে ভাসলাম। সারাদেশ, সারা দুনিয়ার বাংলাদেশিদের মনে সে কী আনন্দ। সে আনন্দও ধরে রাখা গেল না।
রাজনীতি যেমন তার পথে বাধার পাহাড় গড়ে তুলল, তেমনি নোবেলজয়ীও হয়ে গেলেন বিদ্রোহী কবির মতো মূক। কবি নির্বাক হয়েছিলেন শারীরিক কারণে। সে তার পোড়া কপাল। অথচ যখন যেখানে যেমন তিনি ছিলেন তেমন প্রতিবাদী। নোবেলজয়ীর এর বিপরীত চরিত্র। দেশের বিষয়ে যেমন তিনি কথা বলেন না, তেমনি দেশের ওপর চাপানো সমস্যা নিয়েও মুখ খোলেন না। বিশেষত বাংলাদেশের ওপর চাপানো রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন, তখন তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তখন তার কথা শুনত বিশ্ব। তিনি যদি সরকারের গোড়ার দিকের ভুল পথের সমালোচনা করতেন তাও হতো গঠনমূলক। করেননি।
পাশের দেশ মিয়ানমার। যাকে আমরা চিনতাম বার্মা নামে। এই বার্মা দেশকে আমরা মগের মুল্লুক বলেও জানতাম। বলা বাহুল্য, মগের মুল্লুক কোনো সুখকর উপাধি নয়। যেখানে কোনো আইন-কানুন নেই বা কেউ তার ধার ধারে না তাকেই বলে মগের মুল্লুক। মগি লোকরা যা বোঝে তার বাইরে না ভাবতে পারে, না কিছু করতে পারে। এর প্রমাণ আমরা অবশ্য চোখে দেখেছি। আমাদের চট্টগ্রাম ছিল বার্মার মানুষে ভরা। চট্টগ্রামের মানুষজন যেমন সে দেশে সোনা-রুপার ব্যবসা করতে যেতেন, তেমনি তারাও আসত। পরিচিত অনেকেই সে দেশে গিয়ে বিয়ে করে ফেলতেন। অনেকের দাদি-নানি-দিদারা ছিলেন মূলত বার্মিজ। সেই বার্মা নাম পাল্টে হলো মিয়ানমার।
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের আগের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও থাকল না আগের মতো। এক সময় আমাদের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রানি শেফালী ঘোষ গেয়েছিলেন, ও শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইও। শ্যাম রেঙ্গুন গেলে যদি আর ফিরে না আসে সেজন্য এই আর্তি। সেই রেঙ্গুন ও মিয়ানমার আজ আমাদের বন্ধু কিনা তা তর্কের বিষয়। বিশেষত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী করে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর তারা দলে দলে চলে আসে বাংলাদেশে। এমন না যে, তারা আগে আসত না। সে আগমন ছিল চোরাগোপ্তা। কিন্তু এবার তা হলো ওপেন।
একাত্তরে আমরা যেমন ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম অনেকটা তাই। কিন্তু পার্থক্য হলো আমরা জানতাম আমরা স্বাধীন হবো। আমাদের ছিল সঠিক দিকনির্দেশনা। ছিলেন বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনের মতো নেতা। রোহিঙ্গাদের তা নেই। শুধু কি তাই, তারা জাতিগতভাবেও অপরাধপ্রবণ। তাদের আছে জঙ্গিবাদের সঙ্গে কানেকশন। লেখাপড়া না জানা এই জাতিসত্তাকে জামাই আদরে নেওয়াটা ছিল এই সরকারের ভুল। তারা স্বীকার করুক আর না করুক, যে আবেগ আর অনুভূতি তখন যুক্তি ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল তা ছিল ভুল। মিয়ানমার যে কেমন দেশ আর তার আসল শাসক কে তা এখন আবার প্রকাশিত।
শুরুতে বলছিলাম নোবলজয়ীদের অদ্ভুত আচরণের কথা। আমাদের দেশের জনগণ যখন মুখবন্ধ করে দিন কাটাচ্ছেন। তখন অং সান সু চি মিয়ানমারে ছিলেন সরব। তিনি তাদের সামরিক জান্তাকে খুশি রাখার জন্য এবং নিজের দেশে ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার জন্য রোহিঙ্গা দমন সমর্থন করেন। তখন তার আচরণ মানবাধিকার ও মানবিকতাকে বিস্মিত করেছিল। মানুষ অবাক হয়ে দেখেছিল একজন নির্যাতিত রমণীর পাল্টি খাওয়া কিংবা অবস্থান বদল। সেই সু চি আজ কোথায়?
সোমবার সু চিকে আটকের পর কোথায় রাখা হয়েছে সে বিষয়ে সেনাবাহিনী বা অন্য কোথাও থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনএলডির এক এমপির বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উয়িন মিন্টকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্বিগ্ন না হতে বলা হয়েছে। যদিও আমরা খুবই উদ্বেগের মধ্যে আছি। যদি আমরা বাড়িতে তাদের অবস্থানের কোনো ছবি হাতে পেতাম তাও কিছুটা স্বস্তি পেতাম।’ সোমবার এনএলডির আরও বেশ কয়েকজন এমপিকে আটক করা হয়। তাদেরও রাজধানী নেপিদোতে তাদের নিজ নিজ সরকারি বাসভবনে আটকে রাখা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ওদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, এনএলডির কেন্দ্রীয় তথ্য কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কি তোয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে ‘সু চির স্বাস্থ্য ভালো আছে’ বলে জানিয়েছেন। মঙ্গলবারের ওই ফেসবুক পোস্টে তোয়ে বলেন, তিনি জানতে পেরেছেন সু চির শরীর ভালো আছে এবং তাকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
মোদ্দা কথা হলো সামরিক শাসনের এটাই নিয়ম। তারা মানবিকতা বা মানবিক কিছুর ধার ধারে না। সে ধারাবাহিকতায় সু চি এখন অন্তরীণ। প্রতিবাদ জানানো দরকার হলেও জানাতে পারছি না। মন থেকে সায় নেই। আমাদের দেশ ও জাতিকে অপমান করা কাউকে সমর্থন করতে পারব না। বরং ভাবছি এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা কতটা বিলম্বিত করবে, কখন তারা ফিরতে পারবে? এমনিতেই তারা যেতে নারাজ। তার ওপর এখন বলবে, আমরা আরও অনিরাপদ। সব মিলিয়ে গণতন্ত্র নামের ভেলকিবাজি আসলে কী চাল চেলেছে আর মিয়ানমার কী চাচ্ছে বলা মুশকিল। তবে এটা পরিষ্কার, সে দেশের সামরিক শাসকরা কখনো হটেনি। এবারও হটবে না।
আমরা বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। দেশ ও সমাজ জেনারেল জিয়া ও এরশাদের মতো সেনা শাসকের কবলে কী বিপদে ছিল সে আমাদের জানা। যেসব দেশে সামরিক শাসন তারা না পারে মাথা তুলতে, না মুক্তজীবন উপভোগ করতে। মিয়ানমার লাগোয়া দেশ কিন্তু তার ইতিহাস এমনই। সে দেশের যত মানুষ আমি দেখেছি বা মেলামেশা করেছি হয় তারা ভীতু, নয়তো উগ্র। আর একটা বিষয় পরিষ্কার, এরা মুখ খুলতেই ভুলে গেছে।
তাই আমাদের দায়িত্ব হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের ভূমিকা সঠিক করে এর মোকাবিলায় কাজ করা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনো কলহ বা যুদ্ধ আমরা চাই না। তবে শান্তির জন্যও কিছু কঠিন কাজ করতে হয়। সে কাজটি শরণার্থী আগমনের বেলায় হয়নি। এখন না হলে এই বোঝা নামানো যাবে না। তার পরও আমরা চাই মিয়ানমারে গণতন্ত্র আসুক। সু চিও ফিরে পাক মুক্তজীবন এবং এটা শিখুন বিপদে বন্ধুর পরিচয় না দিলে যে কেউ অনিরাপদ।
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক, সিডনি