ইতিহাস বোধহীনতা এবং ইতিহাসচর্চা বিচ্ছিন্নতা প্রকৃত সত্যকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে ফেলে। তাই একুশ নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের অনেকের দৃষ্টিসীমা ১৯৪৭-এর পেছনের পটভূমির খোঁজ পায় না। তাহলে বলতে হবে ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা খুব পেছনের নয়। পাকিস্তানি শাসকরা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ায় বাঙালি ভাষা আন্দোলন শুরু করে।
ভাষা আন্দোলনের এ হচ্ছে তাৎক্ষণিক কারণ। কিন্তু এ প্রশ্নটিও থেকে যায় যে, মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বিশ্বের অনেক দেশের মানুষই তো প্রতিবাদ করেছে। তবে আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রায় এক দশক পর আসামের শিলচরে রক্তক্ষরণের ঘটনা ছাড়া বুলেটের সামনে এভাবে বুক পেতে দাঁড়ায়নি কেউ।
বাঙালির এ লড়াইয়ের দৃঢ়তা নিহিত রয়েছে ইতিহাসে। মধ্যযুগে উপ্ত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের শক্তি। কারণ বাংলা ভাষাচর্চার যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তা ক্রমাগত ধারণ করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তাই সে ভাষার কলজে কেউ খামচে ধরলে সেখানে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ হবেই।
ইতিহাসের গতিধারা পর্যবেক্ষণ করলে এ বক্তব্যে অতিশয়োক্তি করা হবে না যে, বাংলা ভাষা সাধারণ মানুষ বা প্রাকৃতজনের কথ্য ভাষার নড়বড়ে স্থান নিয়েই হয়তো কায়ক্লেশে টিকে থাকত। পরিচর্যাহীন সে ভাষায় বড় কোনো সাহিত্য সৃষ্টি দুরাশা হতো বললেও বোধকরি অন্যায় হবে না। এ ধারার মন্তব্য করার কারণ কিন্তু সুস্পষ্ট।
ছয় থেকে আট শতকে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের যে ভ্রূণ শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন, এর উজ্জ্বল বিকাশের সম্ভাবনা নয়-দশ শতকে পাল শাসন যুগে দেখা দিয়েছিল। মনে হয়েছিল সংস্কৃত সাহিত্যের প্রবল বেষ্টনী থেকে বোধহয় বাংলা সাহিত্যের ছোট চারাটি বেরিয়ে আসবে আলোকিত মাটিতে।
চর্যা গীতিকার আগে এ দেশে সাহিত্য হয় সংস্কৃত নয়তো প্রাকৃত ভাষায় চর্চা করা হতো। ধারণা করা হয় বণিক ও সাধুসন্তুদের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ পৌঁছানোর আগেই বাংলায় সংস্কৃতি ভাষা প্রবেশ লাভে সক্ষম হয়েছিল। তাই সংস্কৃতকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষা বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিত না যদি পাল রাজাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি না থাকত। চর্যাপদের চর্চা হয়েছে এ প্রেক্ষাপটেই। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেও পিছপা ছিলেন না।
এ কারণে পাল যুগে একটি উদার সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চর্যাগীতিকার পথ ধরে হয়তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্য একটি বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছতে পারত। কিন্তু ছন্দোচ্ছেদ ঘটল সুদূর কর্ণাটবাসী কট্টর ব্রাহ্মণ সেনদের হাতে বাংলার রাজদণ্ড চলে যাওয়ায়। এগারো শতকে এ বিদেশি শাসকরা নিজেদের ক্ষমতার আসনকে শক্ত করার জন্য বাংলার সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির বিকাশের মূল সুর অঙ্কুরেই থামিয়ে দিতে চাইল।
বর্ণপ্রথার পৃষ্ঠপোষক সেনরা শূদ্র ও অন্তঃজ শ্রেণি বলে সমাজের নিম্নস্তরে যাদের ফেলে রাখল তারাই প্রধানত এ মাটির সন্তান-বাঙালি। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার পথ তৈরি হোক তা সচেতনভাবেই চাইল না শাসক সেনরা। ফলে ভাষা ও সাহিত্যের শক্তিকে অনুভব করার আগেই বাঙালি শাসক-শ্রেণির আঘাতে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল।
সমাজে বিধান জারি হলো, সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ বা শ্রবণ করা শূদ্রের জন্য হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশীয় ভাষায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করলে পাতকের জায়গা হবে রৌরব নরকে। তাই গোটা সেন শাসন যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের কোনো সুযোগ রইল না। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল চর্যাপদের দোহা গান।
ভিনভাষী ভিনদেশি সেন শাসকদের শাসনকালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের সম্ভাবনা অন্ধকারেই ঘুরপাক খেল। সাংস্কৃতিক শক্তিতে বাঙালির আত্মোপলব্ধির কোনো সুযোগ রইল না। রাজক্ষমতায় বাঙালির ফিরে আসার কোনো সুযোগ তখন ছিল না। বাংলার রাজক্ষমতায় পালাবদলের মধ্যদিয়ে মধ্যযুগের সূচনা হলো।
সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে আবার বাংলার রাজক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ভিনভাষী ভিনদেশি মুসলমান সুলতানরা। সংস্কৃতির বদলে এবার রাষ্ট্রভাষা হলো ফারসি। বাংলা সাহিত্যের ভ্রূণ শিশু শৈশব দেখতে পাওয়ার আগেই লাঞ্ছিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তাই মধ্যযুগের এ রাজনৈতিক পালাবদলে এর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করাই ছিল স্বাভাবিক।
যদি তা হতো তবে সাতচল্লিশের পটপরিবর্তনের পর পাকিস্তানি শাসক চক্রের গলদঘর্ম হওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। মাতৃভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্ব উপলব্ধির চেতনাও ততদিনে বাঙালির হারিয়ে ফেলার শঙ্কাও তৈরি হতো না। ফলে ভাষার প্রশ্নে আটচল্লিশে প্রতিবাদী হওয়ার তেমন কারণ ছিল না। বাহান্নতেও হয়তো রক্ত ঝরানোর অহংকার থেকে বাঙালি বঞ্চিত হতো।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য সর্বোপরি বাঙালির সৌভাগ্য যে বিদেশাগত সুলতানরা বাংলার শাসন ক্ষমতায় এসে অচিরেই নিজ কর্মভূমিকায় বাঙালি হয়ে গেলেন। এরও কারণ ছিল। কারণটি প্রধানত রাজনৈতিক। তেরো শতকের পর বাংলার দিল্লির সালতানাতের প্রদেশ হিসাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কথা। কিন্তু এ দেশে নিয়োজিত গভর্নররা বাংলার মাটির প্রকৃত হাতছানি অনুভব করলেন।
এ দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ, সমৃদ্ধ জীবন মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকেই যুগ যুগ ধরে উৎসাহিত করেছে। এ বাস্তবতাই বোধকরি উৎসাহিত করেছিল অবাঙালি গভর্নরদের। তারা অচিরেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন দিল্লির স্বজাতি সুলতানদের বিরুদ্ধে। দিল্লির দায়িত্ব বর্তায় বিদ্রোহীদের দমন করার। তাই নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্যই বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণাকারী সুলতানদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছিল।
এভাবে চৌদ্দ শতকের ভেতরেই নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারেন বাংলার সুলতানরা। এরপর বাংলার প্রশ্নে হাল ছেড়ে দেন দিল্লির সুলতানরা। বাংলার স্বাধীন সুলতানি নির্বিঘ্নে বিকশিত হতে থাকে। বাংলার অবাঙালি শাসকরাও ততদিনে বাংলার জলমাটির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছেন। পিতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহ আর তাদের ছিল না। সুতরাং বাংলা আর বাঙালির শ্রীবৃদ্ধিতে তারা অকুণ্ঠচিত্তে ভূমিকা রেখেছেন।
সুলতানদের কর্মভূমিকায় যে উদারতা দেখা গেছে তার প্রেক্ষাপটও খুঁজতে হবে এখানেই। সুলতানরা অনুভব করেছিলেন বাঙালির প্রকৃত সংস্কৃতিকে বিকশিত করেই তাদের মনন অনুভব করা যাবে। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে এর প্রয়োজন ছিল। এ কারণেই সেন যুগের বদ্ধ অর্গল খুলে গেল সুলতানদের উদার নীতিতে।
ধর্ম-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার দ্বার অবারিত হলো। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জোয়ার তীব্র হলো। অচিরেই তার ফসল দেখা দিল। প্রসারিত হলো বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্র। এ ভাষায় কাব্য সৃষ্টি হতে থাকল। সাধারণ হিন্দুর মধ্যেও যে ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছিল তা বোঝা গেল এ শ্রেণির কবিদের কাব্য রচনা দেখে।
এভাবে সুলতানি যুগের উদার পরিবেশ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন প্রেরণা দিল। বাঙালি কবির রচনায় সৃষ্টি হলো মঙ্গল কাব্যের বিশাল ভান্ডার। এতে হিন্দু সমাজ ধর্মীয় প্রেরণার মধ্যদিয়ে তাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে শানিত করার নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করে।
সংস্কৃতির জোয়ার ভাসিয়ে দেয় চারদিক। তাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার এ খোলা প্রান্তরে এসে যোগ দিলেন মুসলমান কবিরাও। ষোলো শতকেই বাংলা ভাষায় কাব্য সৃষ্টি হতে থাকল মুসলমান কবিদের হাতে। এ সময় রচিত প্রণয়োপাখ্যানের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’। এ যুগে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে মুসলমান কবিরা তো বটেই, হিন্দু কবিরাও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন সুলতানদের কাছ থেকে।
পনেরো শতক থেকে সুলতান, অমাত্যবর্গ ও হিন্দু জায়গিরদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় কাব্যচর্চা বিশেষ গতি পায়। এ পর্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পুরাণ ও মহাকাব্যগুলোকে অবলম্বন করে কাব্য রচনা করা। এভাবে রচিত হয় কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’, হুসেন শাহের আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খানের আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর কর্তৃক রচিত হয়েছিল ‘পাণ্ডব বিজয়’ নামে মহাভারতের একটি কাব্যানুবাদ।
পরাগল খানের পুত্র ছুটি খানের আদেশে শ্রীকর নন্দীও অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব’। সাংস্কৃতিক বিবর্তনের এ জোয়ার মঙ্গলকাব্য, সুফি সাহিত্যের ক্ষেত্রকেও ঐশ্বর্যশালী করে তোলে। এভাবে সাহিত্যচর্চার যে ভিত্তি রচিত হয় তা চৈতন্যোত্তর যুগে ষোলো-সতেরো শতকের কবিদের উদ্দীপ্ত করে। শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলনের ভাববন্যায় আপ্লুত বৈষ্ণব ভক্ত কবিরা চৈতন্য চরিত কাব্য রচনা শুরু করেন। এর পথ ধরে জীবন চরিত সাহিত্যের এক নতুন ভান্ডার উন্মোচিত হয় বাংলা কাব্য জগতে।
ইতিহাস অনুসন্ধানী সচেতন মানুষ এ প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে অনুভব করবেন মধ্যযুগ-পূর্ব বাংলায় একটি জগদ্দল পাথর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের পথ যেভাবে রুদ্ধ করেছিল তা বিশ শতকের মাঝ পর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে অহংকার করার মতো কোনো সাহিত্য বা এর বাহন ভাষা দাঁড় করাতে পারত না বাঙালি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার চারণভূমিকে মধ্যযুগের সুলতানরা অবমুক্ত করে দিয়েছিলেন। ফলে বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন হিন্দু-মুসলমান কবিরা। তারা নানামুখী পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অনুকূল পরিবেশের প্রণোদনায় কর্ষণ করতে থাকেন সে চারণ ভূমি। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভুবন ফলে ফুলে বিকশিত হয়। এভাবে বাঙালি সংস্কৃতি চেতনায় নতুন উপলব্ধি লাভ করে। এ সাংস্কৃতিক চৈতন্য বাঙালিকে দিয়েছিল স্বাজাত্যবোধ আর আত্মমর্যাদার ধারণা।
সংস্কৃতিসচেতন বাঙালিকে অনুভব করতে না পেরে অর্থাৎ সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চায় ঋদ্ধ বাঙালিকে বুঝতে না পেরে অপরিণামদর্শী পাকিস্তানি শাসকচক্র আঘাত করেছিল বাঙালি চেতনায়।
এ কারণে শানিত বাঙালির পক্ষে ভাষার প্রশ্নে প্রতিবাদী হওয়া ছিল অবধারিত। অমন উজ্জ্বল ঐতিহ্যের পথ মাড়িয়ে এসেছে বলে বাঙালি শাসকের রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেনি। রক্ত দিয়ে রক্ষা করেছে মাতৃভাষার সম্মান। আর এ দীর্ঘ প্রেক্ষাপট বাঙালিকে যেভাবে সম্মানিত করেছে, এরই বহিঃপ্রকাশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ২১ ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি।
এ কারণেই একুশের চেতনার সঙ্গে প্রায় সত্তর বছর পরের প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হলে ইতিহাসের মূলে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার গর্বিত পদচারণা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়