বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো দেশে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী বন্ড সুকুক চালু করতে যাচ্ছে। সুকুক আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে সিলমোহর লাগিয়ে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেয়ার আইনি দলিল। চলতি বন্ড ও সুকুক বন্ডের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সুকুকে ইসলামী রীতি অনুসরণ করা হয়। এখানে সুদের ব্যবস্থা নেই, আছে মুনাফা যা আগে থেকে নির্ধারণের উপায় নেই। যেটি বার্ষিক আয়-ব্যয়ের ওপর নির্ধারিত হয়। বিশ্বের অনেক দেশে এই বন্ড চালু আছে। মালয়েশিয়া বিশ্বে প্রথম সুকুক বন্ড চালু করে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) সুকুক ছেড়েছে। এ ছাড়া বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুকুক প্রচলিত। মুসলিম দেশের পাশাপাশি অনেক অমুসলিম দেশও এখন সুকুক চালু করেছে।
বাংলাদেশে দুই ধরনের বন্ড রয়েছে। একটি ট্রেজারি বিল, অন্যটি ট্রেজারি বন্ড। ট্রেজারি বিল স্বল্পমেয়াদি আর ট্রেজারি বন্ড দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ ০২ থেকে ১০ বছর। বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসাবে বিভিন্ন সরকারি বন্ড সঞ্চয়পত্র এবং প্রাইজ বন্ড প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এখন সাধারণভাবে বলা যায় ইসলামী বন্ড সুকুকও একধরনের সরকারি বন্ড।
সুকুক ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক একটি প্রডাক্ট। এখানে প্রচলিত বন্ডের মতো সুদের ব্যবহার থাকে না। বন্ডের সুদের হার আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। সুকুকে মুনাফা নির্ধারিত হয় বার্ষিক কর্মকাণ্ডের আয় ব্যয়ের ওপর। প্রচলিত বন্ড বা সঞ্জয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা যে অর্থ বিনিয়োগ করে তার ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে অর্থ লাভ করে। কিন্তু সুকুকের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা আগে থেকে নির্ধারিত হারে কোনো অর্থ পায় না। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে ওই প্রতিষ্ঠানের আয় ও মুনাফা যখন যেমন হয় তার অংশীদারিত্ব লাভ করে। ইসলামী বন্ড হবে ইজারাভিত্তিক মানে নির্দিষ্ট প্রকল্পভিত্তিক। কিন্তু সাধারণ বন্ডের ক্ষেত্রে তা হয় না। ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার মধ্যে যে চুক্তি হয়ে থাকে তা হলো প্রচলিত বন্ড। এতে ঋণের পরিমাণ, ঋণ পরিশোধের সময় ও সুদের হার নির্ধারিত থাকে। সুকুক হচ্ছে এমন একটি বিনিয়োগ সনদ যেখানে সম্পদের ওপর মালিকানা দেয়ার নিশ্চয়তা থাকে। সাধারণ সুকুককারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করে এবং শরিয়াহসম্মতভাবে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মুনাফা লাভ করে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সুকুকসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘শরিয়াহ’ অর্থ কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস-এ বর্ণিত ইসলামিক বিধিবিধান। প্রজ্ঞাপনের ৯ নম্বর পয়েন্টে সুকুককে যেভাবে বোঝানো হয়েছে তা হলো ‘বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ সুকুক (Bangladesh Government Investment Sukuk) (অতঃপর সুকুক নামে অভিহিত) অর্থ সমমূল্যের এইরূপ- অনুমোদিত সম্পত্তি-নিদর্শনপত্র যাহা কোনো শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় নির্দিষ্ট প্রকল্পের অথবা বিশেষ বিনিয়োগের বিদ্যমান সম্পদের (Tangible Assets) ওপর অথবা/এবং ভবিষ্যতে উৎপাদনে বা প্রস্তুতের মাধ্যমে উক্ত চুক্তির অধীনে অন্তর্ভুক্ত হইবে এইরূপ সম্পদের উপর অথবা/এবং ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতে ক্রয় করা হইবে বা ইতোমধ্যে ক্রয় করা হয়েছে এমন কোনো শরিয়াহসম্মত পণ্য দ্রব্যের ওপর অবিভক্ত মালিকানা অথবা অংশীদারিত্ব (Share) নির্দেশ করবে। সুকুক-এ অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে। তার মানে ইসলামী অর্থনীতিতে সুদের কোনো স্থান নেই। এখানে মালিকানায় অংশীদারিত্ব করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় শেষে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয় হিসাবের ওপর মুনাফা নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ এর সম্পদের বিপরীতে এই প্রথম ছাড়া হচ্ছে সুকুক। যিনি এতে বিনিয়োগ করবেন তিনি এই প্রকল্পের মালিকানায় মানে ওই প্রকল্পের যাবতীয় সম্পত্তির অংশীদার হয়ে যাবেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক চার হাজার কোটি টাকা করে দুই দফায় বিনিয়োগকারীদের কাছে সুকুকের সার্টিফিকেট বিক্রি করবে। বিপরীতে তারা মুনাফা পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে দেশে মোট সঞ্চয় ও বিনিয়োগকারীদের ২৮ শতাংশ ইসলামী ধারায় বিনিয়োগে আগ্রহী। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবস্থায় সুদ গ্রহণ ও প্রদানে তারা আগ্রহী নয়। তা ছাড়া দেশে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত, বিনিয়োগ রেমিট্যান্স ও আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এসব ইসলামী প্রতিষ্ঠান অবদান রেখে যাচ্ছে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারিত্ব প্রায় ২৫ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক ও শরিয়াহভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও ঝোঁক দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা থমসনের ২০১৬-১৭ সময়ে প্রকাশ করা বৈশ্বিক ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বৈশ্বিক ইসলামী অর্থায়নে সম্পদের পরিমাণ ছিল দুই ট্রিলিয়ন বা দুই লাখ মার্কিন ডলার। বলা হয়, ইসলামী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এতই ইতিবাচক যে, চলতি ২০২১ সালেই তা সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোনো উপকরণ নেই। সুকুক চালু হলে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অংশীদার হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে এবং সরকারও ঘাটতি অর্থায়নে তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। সরকারের সুদের ব্যয়ও কমবে। বাংলাদেশের নাগরিক যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক সুকুক কিনতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক, একজন বিনিয়োগকারী সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা নেই। সুকুক ৫ বছর মেয়াদি এবং বিনিয়োগকারীরা ৬ মাস পরপর মুনাফা পাবেন। দেশে প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর স্কিম যেমন- ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট বন্ড যার মুনাফার হার ৩.৬৯ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সুকুকের প্রাক্কলিত মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪.৬৯ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, সুকুকে প্রাইমারি ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রসপেকটাস অনুযায়ী (স্পেশাল পারপাস ভেহিকল) এসপিভি প্রাইভেট প্লেসমেন্ট অথবা অকশনের মাধ্যমে অভিহিত মূল্যে সুকুক ইস্যু করা যাবে। ইনভেস্টমেন্ট ডিলারসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুকুক অকশনে নিজেদের জন্য বিড দাখিল করতে পারবে। প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ক্রয়কৃত সুকুক সেকেন্ডারি মার্কেটেও ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। নিবাসী অথবা অনিবাসী বিনিয়োগকারী উভয়ই সেকেন্ডারি মার্কেটে ক্রয়-বিক্রয়ে অংশ নিতে পারবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তারল্য ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সুকুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া সমাজের বৈষম্য নিরসনে সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ও মালিকানার জন্য সুকুক একটি উত্তম ও শরিয়াহসম্মত প্রডাক্ট। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুকুক ইস্যু একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকারের এসডিজি বাস্তবায়নেও সুকুক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কমিটির মাধ্যমে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস-এর বিধিবিধানের কতটা প্রতিফলন ঘটবে সেটি দেখার বিষয় রয়েছে। সুকুক প্রডাক্ট সফল বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ব্যবস্থাপকদের ও বিনিয়োগকারীদের শরিয়াহ নীতিমালাবিষয়ক জ্ঞান অর্জন অতীব জরুরি। তবে সরকারের প্রাথমিকভাবে লাভজনক প্রকল্পগুলোতে সুকুক ইস্যু করা উচিত এবং পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে বড় প্রজেক্ট না নিয়ে স্বল্প ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে সুকুক ইস্যু করতে পারে। শরিয়াহ নীতিমালা অনুসরণ করে সুকুক বন্ড কার্যকর হলে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা জাতীয় অর্থনীতিতে আরো বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক