ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে আসনের নিরিখে এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধার ঘেঁষে আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্ক থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। বাম-কংগ্রেস মিলিত হয়েছে একমঞ্চে। তাদের অবস্থান তৃতীয় স্থানেই স্থির হয়ে আছে।
রাজ্যে বিধানসভার মোট আসন ২৯৪। ইতোমধ্যে ‘এবিপি আনন্দ’-‘সিএনএক্স’ পশ্চিমবঙ্গে জনমতের সমীক্ষা করেছে। মহিলা ও পুরুষ মিলিয়ে তারা কথা বলেছে ৮ হাজার ৯৬০ জনের সঙ্গে। ২৩ জানুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ সমীক্ষাটি চালানো হয়। সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, তৃণমূল জয় পেতে পারে ১৪৬ থেকে ১৫৬ আসনে।
একক শক্তিতে সরকার গঠনের জন্য যে কোনো দলের দরকার কমপক্ষে ১৪৮ আসন। সেদিক থেকে তৃণমূলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিজেপি ১১৩ থেকে ১২১ আসন পেতে পারে; বাম-কংগ্রেস জোটের সম্ভাব্য আসন হতে পারে ২০ থেকে ২৮।
সমীক্ষা অনুযায়ী, তৃণমূল মোট ভোটের ৪৩ শতাংশ, বিজেপি ৩৭ শতাংশ এবং বাম-কংগ্রেস ১২ শতাংশ ভোট টানতে পারে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাটা ছিল এরকম। তৃণমূল ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, বিজেপি ৪০ দশমিক ২৫ শতাংশ, বাম ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
এ বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি ‘সি ভোটার’-‘এবিপি আনন্দ’-এর অন্য একটি সমীক্ষায় তৃণমূলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ইঙ্গিত ছিল। সেখানে তৃণমূলের সম্ভাব্য আসন ছিল ১৫৪ থেকে ১৬২। বিজেপির ছিল অনেকটাই কম- ৯৮ থেকে ১০৬। তুলনায় বেশি ছিল বাম-কংগ্রেস জোটের-২৬ থেকে ৩৪। এক মাসের ব্যবধানে দুটি সমীক্ষার ফলাফলে তারতম্য দেখা যাচ্ছে।
এ এক মাসের মধ্যে তৃণমূলে কিছু ভাঙন দেখা গেছে। মন্ত্রী, বিধায়কসহ অনেকেই শিবির বদল করে গেরুয়া পতাকা ধরেছেন। রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা এবং আরও অনেক কেন্দ্রীয় নেতার আনাগোনা বেড়েছে। এসব তোড়জোড়ে বিজেপির অবস্থানের আরও কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে।
কিন্তু এখনো সেখানে পছন্দের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জনপ্রিয়তায় মমতাই এগিয়ে আছেন। তবে ভোটের শতাংশ বিচারে ‘সিএনএক্স’ এবং ‘সি ভোটারে’র দুটি সমীক্ষার তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচনে সরকার গঠনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হতে পারে কোনো একটি দল।
সেক্ষেত্রে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতে পারে। আর কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে বাম-কংগ্রেসের গুরুত্ব অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। কেননা, তাদের সমর্থন ছাড়া তৃণমূল কিংবা বিজেপি কারও পক্ষেই সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না।
যে দেশ ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পরও সাড়ে ১৯ কোটি মুসলমানের স্বভূমি, যে দেশ হিন্দুপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও সরকারিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ-সেই দেশের রাজনীতিতে বিজেপি সরকার গঠন করেছে এবং ২০১৪ সালের সেই বিজেপিতে একজনও মুসলমান সংসদ সদস্য ছিল না। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এমন ঘটনা এটাই ছিল প্রথম।
১৯৮০ সালে কংগ্রেস শাসনামলে ভারত দেখেছিল ৪৯ জন মুসলমান সংসদ সদস্য। কিন্তু উদার ও বহুত্ববাদী ভারতেও কেন সংখ্যালঘুরা কোণঠাসাই রয়ে গেল, সে বিশ্লেষণ বড় জটিল। আর সেই জটিল হিসাবের ফল হলো ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায়-যেখানে একজন সংসদ সদস্যও আসেনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে।
কংগ্রেস বহু দশক ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার উত্তরাধিকার ভোটারদের মধ্যে বিক্রির চেষ্টা যতখানি করেছে, জনতার মনে ধর্মনিরপেক্ষতা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা তার সিকিভাগও করেনি। মুখে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা আর মনে সুপ্ত হিন্দুত্ববাদ। সেই সুযোগটাই মোদির বিজেপি গ্রহণ করেছে।
১৯৯৯ সাল থেকে সংসদে মুসলমান প্রতিনিধি ক্রমেই কমেছে। ফলাফলও হাতেনাতে দেখা গেছে। সংসদে সেই হারে কমেছে সম্প্রদায়কেন্দ্রিক প্রশ্ন। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি দল একরকম প্রমাণই করে দিয়েছে, একজন মুসলমানকেও টিকিট না দিলে ক্ষতি নেই। বাকিরাও সেই পথেই হাঁটে।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা ২ কোটি ৪৬ লাখ। হিন্দু জনসংখ্যা ৭১ শতাংশ, মুসলিম ২৭ শতাংশ এবং খ্রিষ্টান-শিখ মিলে ১ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের কথা তো একটু আলাদা হওয়ারই কথা ছিল। প্রবাদ আছে-বাঙালি আজ যা ভাবে, ভারত তা ভাবে দশ বছর পর। সেই পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। ভোটের খেলা যেন বেশ জমে উঠেছে সেখানে। চলছে অনুমানচর্চার রমরমা ব্যবসা। সেই ব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে দল বদলকারীরা।
চাকরি বদল কিংবা দল বদল; এ নৌকা থেকে ওই নৌকায় লাফ দেওয়ার নেপথ্যে কিছু চাওয়া-পাওয়ার আশ্বাস লুকিয়ে থাকে। যাকে রাজনৈতিক ভাষায় বলে ‘টোপ’। তবে লক্ষণীয়, তৃণমূলের বেশকিছু মন্ত্রী পুরোটা সময় মন্ত্রিত্ব করে শেষবেলায় এসে জড়ো হয়েছেন বিজেপির ছাতায়। বিষয়টি বেশ মজার! প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়, তাহলে কি মতাদর্শ বিষয়টি রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেল এরই মধ্যে?
ইতিহাস বলছে, রাজনীতিতে জার্সি বদলালে কিংবা বেসুরো গাইলে সবসময় বিপ্লবী তকমা জোটে না। কখনো কখনো উলটোটাও হয়। জার্সি বদলে ভোটে জিতলে ‘বিপ্লবী’, আর হারলে ‘মীরজাফর’ হয়েও যেতে হয়।
রাজনীতি একটি অনিশ্চিত জায়গা। ঘন ঘন বদলায় রাজনীতির রং। অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া গেলেও ভোটের ভাগ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না। বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হলেও ভোটারের মন বোঝার যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি।
কিন্তু তারপরও কথা তো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সেই বাঙালিদের নিয়ে-যাদের গ্রহণশীলতা আর গ্রহণযোগ্যতা চিরায়ত ভাবাবেগের মতো, স্বচ্ছ অনুভূতির মতো উদার-অন্তহীন তার বিস্তৃতি; যাদের দিগন্ত নেই, কালের মাত্রা নেই, নেই সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রতার নির্বোধ মানচিত্রায়ণ।
সে যেমন বিশেষের, তেমনি নির্বিশেষের; যেমন ব্যাপ্তির, তেমনি গোষ্ঠীহীন সমাজের। বাঙালির সেই আকাশকে, তার ভৌগোলিকতাবোধকে, সত্তার বিশিষ্ট রাজনৈতিক সংজ্ঞাকে যারা বিভাজিত-কলুষিত করতে চাইছে, বাঙালির প্রেমাসক্তি একত্রিত হয়ে তাদের তোড়ের মুখে ভাসিয়ে দিতে পারবে কি? নাকি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বিভাজনের বাণী বুকে নিয়ে শত বছরের বাঙালি তার ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে যাবে?
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বাধ্যবাধকতার প্রশ্নে বিতর্ক-সমালোচনা চলতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গের মমতার তৃণমূল নিয়েও তা আছে। আমাদের বাংলাদেশের মানুষেরও একটা রিজার্ভেশন আছে তার ব্যাপারে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কারণ হাজার সদিচ্ছা সত্ত্বেও কোথাও কোনো সামাজিক কর্মসূচি কখনো পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত রাখা যায় না। আর তা যদি হয় আন্তর্জাতিক আর দেশীয় স্বার্থে পরস্পরবিরোধী, তবে তো দু’পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি দু’রকম হতেই পারে।
তবে দেখার বিষয় হলো, যাদের কাছে সুবিধা পৌঁছেছে তারা সংখ্যা ও গুরুত্বে বেশি, নাকি যাদের হাতে পৌঁছায়নি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের বাজারে আরও একটি বিষয় বড় স্পর্শকাতর। যে লোকটি চিকিৎসার আশ্বাস, ভাতের আশ্বাস, মেয়ের বিয়ে, সন্তানের লেখাপড়াসহ বিবিধ সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে আশ্বস্ত, তার কাছে বাস্তবতার ছবিটি নিছক রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা। সেখানে কোনো উন্নততর ও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প সামনে না থাকলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলায় তার জেতা কঠিন হতে পারে।
এই মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ঠিক এর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীর একটি মন্তব্য ভারত ও বাংলাদেশে কিছুটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেছেন, ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের মতবিরোধ রয়েছে। সে কারণে তিস্তা চুক্তি রূপায়ণ করা যায়নি। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ।’
ভারতীয় হাইকমিশনার কোনো রাজ্যের নাম না করলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলেছেন। প্রশ্ন জাগে, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে হাইকমিশনারের এ ধরনের মন্তব্য কি কোনো ইঙ্গিত বহন করছে? বাংলাদেশকে কি তিনি ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চাচ্ছেন? পশ্চিমবঙ্গের একটি বড় অংশের মানুষ অতীতে বাংলাদেশ থেকে গেছেন। ভারতে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে সবসময়ই বাংলাদেশ নিয়ে একটি নস্টালজিয়া কাজ করে।
আমরা যে অনুভূতির ছোঁয়া পেয়েছি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর মধ্যে। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ একটি প্রাণের বাঁধনে আটকা পড়ে আছে। কেউ সেখানে মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ খ্রিষ্টান-কিন্তু সবাই সেখানে বাঙালি। তারা একে অপরের কাছে বাঁধা পড়ে আছে ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির অদৃশ্য বন্ধনে।
বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া সেই শ্রেণির প্রতি কোনো ইঙ্গিত কি এটি? ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ভেতরকার অভ্যন্তরীণ বিষয়কে ভিনদেশের সংবাদমাধ্যমে বলা কি নিছক ঘটনার বর্ণনা মাত্র? বিষয়টি হতে পারে কাকতালীয়, আবার না-ও হতে পারে।
রাজ্যে কোয়ালিশন সরকারই হোক কিংবা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার, এখন দেখার পালা সামনের নির্বাচনটি বাঙালির কবিতা, চিত্রকর্ম, কথাসাহিত্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত এবং সীমা ভাঙার রাজনীতি শত ভাঙন আর রক্তক্ষয়ের পরিহাসকে অতিক্রম করে অতীতের গৌরব আর ঐতিহ্যকে বুকে জড়িয়ে একটি সংহত-সংযত পশ্চিমবঙ্গ উপহার দিতে পারে কিনা। অথবা দেখার পালা-বাঙালি হিসাবে কিছু বিশ্বাস থেকে সরে যায় কিনা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক