বৈশ্বিক মহামারী করোনায় পুরো বিশ্ব থমকে যায়। বিভিন্ন দেশে দফায় দফায় লকডাউনের ঘোষণা আসে। সব দেশেই মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়ায় কাজহীন হয়ে পড়ে সব শ্রমিক। এ অবস্থা প্রবাসীরা দলে দলে ফিরেছেন দেশে। গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ছয় থেকে সাত লাখ মানুষ বিদেশে কাজের জন্য যান। এ হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কর্মী বিদেশ যান। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর মাত্র দুই লাখের মতো কর্মী বিদেশে যেতে পেরেছেন। এ সময়ে ফিরে এসেছেন প্রায় সোয়া চার লাখ শ্রমিক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় একদিকে নতুন কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রতিদিনই চাকরি হারিয়ে বিদেশ থেকে ফিরছে কর্মীরা। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর এ সময় ৪ লাখ ৮ হাজার ৪০৮ জন কর্মী বিদেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই নারীকর্মী। এ হিসাব গত বছরের শেষ দিন পর্যন্ত। ফেরত আসা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
ফেরত আসা কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন সৌদি আরব থেকে। এ দেশ থেকে এক লাখ ১৯ হাজার কর্মী ফেরত আসেন। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার, কাতার থেকে ৪৯ হাজার, ওমান থেকে ২৪ হাজার ৪৫৭, মালয়েশিয়া থেকে ১৭ হাজার ১০৬, মালদ্বীপ থেকে ১৬ হাজার, কুয়েত থেকে ১৫ হাজার ২২৭ জন, ইরাক থেকে ১০ হাজার, লেবানন থেকে আট হাজার ৭৬২, সিঙ্গাপুর থেকে আট হাজার ৪২৪ ও বাহরাইন থেকে সাড়ে চার হাজার কর্মী ফিরে এসেছেন।
ফেরত আসা কর্মীদের জন্য সরকার বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রবাসী ফেরত কর্মীদের আর্থ-সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। করোনার কারণে ফেরত আসা প্রত্যাগত শ্রমিক বা তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ চার শতাংশ সুদে ১ লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন।
নানা অস্থিরতার কারণে প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের অর্জিত অর্থ দেশে ফেরত পাঠান। ২০২০ সালের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স রেকর্ড গড়েছে। এর পরিমাণ প্রায় পৌনে ২২ বিলিয়ন ডলার।
করোনার লকডাউনের কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের চাকরি হারানো বা কাজ না পাওয়ার শঙ্কায় রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু করোনার পরের মাস এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমলেও তার পর থেকে রেমিট্যান্স আসা বাড়তে থাকে। গত ডিসেম্বরে দেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স এসেছে। এর পরিমাণ ২০৫ কোটি ৬ লাখ ডলার।
আগের মাস নভেম্বরে রেমিট্যান্স আসে আরও বেশি, ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। তার আগের মাস দেশের ইতিহাসে একক মাস হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসার রেকর্ড গড়ে। ওই মাসে রেমিট্যান্স আসে ২১০ কোটি ২১ লাখ ডলার। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে একক মাস হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে। জুলাইতে একক মাস হিসেবে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে, পরিমাণ ছিল ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে ২০২০ সালের পুরো সময়ে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) দেশে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ১৮ লাখ ( ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশে এত রেমিট্যান্স আর কখনো আসেনি। এটি তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩৪০ কোটি ৯৬ লাখ ডলার বা ১৮ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ২২ লাখ (১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন) ডলার।
এদিকে রেমিট্যান্সে ভর করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। গত ৩০ ডিসেম্বর অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ওইদিন দেশে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে ১০ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোয় ডলারের উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনে দাম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয় বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী, গতবছরের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে ২ টাকা প্রণোদনা পেয়ে আসছেন। ফলে করোনার মধ্যেও রেকর্ড গড়ছে রেমিট্যান্স।
করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে মন্দা কাটাতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ৫ হাজার ডলার বা প্রায় ৫ লাখ টাকা কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া ২ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। যা আগে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল।
এদিকে গত নভেম্বরে রেমিট্যান্স পাওয়া আরও সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেমিট্যান্স প্রদানকারী ব্যাংক রেমিটারের কাগজপত্র নিজ দায়িত্বেই যাচাই করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণোদনার অর্থ ছাড় করার জন্য রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংকের কাছে ‘কনফার্মেশন’ পাঠাবে। তার ভিত্তিতে রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংক রেমিট্যান্স প্রদানকারী ব্যাংক বরাবর প্রণোদনার টাকা ছাড় করবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যরোর (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি এখন দেশের বাইরে থাকেন। প্রবাসে থাকা এ বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখলেও প্রবাসীদের পদে পদে ভোগান্তি ও হয়রানি পোহাতে হয়।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন আমাদের সময়কে বলেন, করোনা কারণে যেসব কর্মী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন তাদের নিজ নিজ স্থানে পাঠাতে সরকার চেষ্টা করছে। এ মহামারী সম্পর্কে কারও ধারণা ছিল না। সবার কাছে অচেনা এক আতঙ্ক। তবে সেই আতঙ্ক এখন অনেকটাই কেটে গেছে।
পৃথিবী আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। শ্রমববাজারও স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি। তবে যারা ফিরে এসেছেন, তাদের জন্য সরকার সময়োপযোগী দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন। বিশেষ করে ফেরত আসা কর্মীদের আর্থ-সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে ফেরত আসা প্রত্যাগত শ্রমিক বা তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ চার শতাংশ সুদে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমদ চৌধুরী নোমান আমাদের সময়কে বলেন, অজানা এক বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস পুরো শ্রমবাজারকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। যেমন শ্রমিকরা কর্মহারা হয়েছে, তেমন কর্মসংস্থান না থাকায় নতুন করে কেউ যেতে পারেনি। বিশেষ করে যারা বিদেশে শ্রমিক পাঠান রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মালিকরা পথে বসে গেছেন। পুরো সময়টাতেই কোনো কর্মী পাঠাতে পারেনি, অন্যদিকে অফিস ভাড়া, কর্মীর বেতনসহ নানা ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।