খ্রিষ্টীয় দশম শতকের আগেই মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করলেন এবং দুনিয়া সম্পর্কে পুরনো ধারণা থেকে সরে এলেন। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ও গ্রহগুলোর আবর্তনের তত্ত্ব বা Geocentric model সংশোধন করলেন। এ ক্ষেত্রে আল বাত্তানি, ইবনে রুশদ, নাসিরুদ্দিন তুসি, মুহিউদ্দিন উরদি ও ইবনে শাতিব অগ্রগণ্য নাম। তারা এই পরিবর্তন আনার ফলে কোথাও আক্রান্ত হননি। সমাজ এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। চিন্তাশীল মহল থেকে তারা বরং অভিনন্দিত হয়েছেন। কিন্তু এই সংশোধনীর ল্যাতিন অনুবাদ বহু শতাব্দী পরে ইউরোপে যখন কোপার্নিকাসকে নতুন চিন্তায় আলোড়িত করল এবং কোপার্নিকাস সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলোর আবর্তনের মতবাদ প্রচার করলেন, কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেখানে? সবাই জানেন, বলা হয়েছিল, এ আবিষ্কার বাইবেলবিরোধী। এ মতবাদের কারণে ধর্মগ্রন্থের অবমাননা হবে।
১৫৩৬ সালে তার এ বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ান মার্টিন লুথার, ফিলিপ মেলান্সথন ও অপরাপর ধর্মীয় ও জাতীয় নেতারা। বাধ্য হয়ে বইয়ে আনতে হয়েছিল বহু সংস্কার, লিখে দিতে হয়েছিল, এগুলো নিছক কল্পনা। পৃথিবী সূর্যের চার দিকে আবর্তিত হয়, এই বক্তব্য সহ্য করতে রাজি ছিল না গির্জা। কিন্তু এমন বক্তব্য মুসলিম বিজ্ঞানীরা পেশ করতে পেরেছিলেন বহু আগে, নির্বিঘ্নেই। কোপার্নিকাসের চিন্তার পূর্বসূরি ছিলেন তারা। আল বাত্তানি ধরিয়ে দেন টলেমির ভুল। তিনি বলেছিলেন, সূর্য স্থির। বাত্তানি প্রমাণ করেন, সূর্য আবর্তিত হয় আপন কক্ষপথে। পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ গতিশীল সূর্যের চার পাশে। সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলোর আবর্তনে কোপার্নিকাসের প্রদত্ত Heliocentric model এ অন্তর্ভুক্ত ছিল বাত্তানির সংশোধনী। কোপার্নিকাস তার তত্ত্বের জন্য এই ঋণ স্বীকার করেন স্পষ্টভাবে। দুনিয়ার ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার গ্রন্থ ‘দ্য রেভোলিউশনিবাস অরবিয়াম কোলেসটিয়াম’এ আপন মতবাদের গুরু হিসেবে তিনি বাত্তানির উল্লেখ করেন একে একে ২৩ বার।
বাত্তানির বক্তব্যকে অভিনন্দিত করল মুসলিম জ্ঞানমণ্ডল। কিন্তু কোপার্নিকাসের বক্তব্যের ফলাফল উল্টো হলো কেন?
মুসলিম জাহানে তখন বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানচেতনা বিদ্যমান ছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পথে তৈরি করা হয়নি দেয়াল। কিন্তু ইউরোপে প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে যাচাই করা হতো বাইবেল ও তার ব্যাখ্যা দিয়ে। বিজ্ঞানের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করত ধর্ম। বাইবেলবিরোধী আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করা হতো নতুন চিন্তাকে।
অতএব জিওর্দানো ব্রুনো যখন বললেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, পৃথিবী সৌর জগতের তুচ্ছ গ্রহমাত্র, তখন ধর্মদ্রোহী হিসেবে তাকে দেয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নয়, গর্দান কেটে নয়, আগুনে পুড়িয়ে! বিচারক হুকুম করলেন তার রক্তের এক ফোঁটাও যেন পৃথিবীর সঙ্গে না মেশে। আগুনে ভস্ম করা হলো ব্রুনোকে। দিনটি ছিল, ১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।
গ্যালিলিও বলেছিলেন, পৃথিবী ঘুরে সূর্যের চার পাশে। বলেছিলেন, ব্রুনোকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে মূর্খ যাজকেরা। এ জন্য তাকে একবার মাফ চাইতে হয়েছিল। ওয়াদা করতে হয়েছিল, চার্চ ও বাইবেলবিরোধী কিছু বলবেন না। কিন্তু সে কথা রাখতে পারেননি।
কারাগারে পাঠানো হলো তাকে। নির্মম অন্ধকারে ৮ বছর ধরে অসুখ-যাতনায় জর্জরিত হয়ে মরতে হলো তাকে। পাদ্রিরা খুশি। ধর্মের দুশমনের ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে!
হৃদযন্ত্রে রক্ত চলে না, এমন ভ্রান্তি ভেঙে দেন আলা উদ্দীন আবুল হাসান আলি ইবনে আবিল হাসান ইবনুন নাফিস। ১২৪১ ঈসায়িতে প্রকাশিত তার শরহু তাশরিহি কিতাব আল কানুন ফিত তিব্ব গ্রন্থে হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচলের সূত্র বর্ণনা করেন। যে সূত্র আজ পালমোনারি সঞ্চালন নামে পরিচিত। সূত্রটির সারকথা হলো, হৃদযন্ত্রের ডান প্রকোষ্ঠ থেকে শিরার মধ্য দিয়ে ফুসফুসে রক্ত চলাচল করা এবং ফুসফুসে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণের পর শিরার মধ্য দিয়ে হৃদযন্ত্রের বাম প্রকোষ্ঠে পুনরায় রক্ত ফিরে যাওয়া।
ম্যাক্স মেয়ারহেফ লিখেন, ‘ইবনে নাফিসের এনাটমির এ ভাষ্য অসংখ্য পাণ্ডুলিপিতে বিদ্যমান। ইউরোপে মাইকেল সার্ভিটাস পুনরায় এ তত্ত্ব হাজির করার ৩০০ বছর আগে ইবনে নাফিস গ্যালেন ও ইবনে সিনার বিপরীতে এ তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। বোধ হয় মাইকেল সার্ভিটাস ল্যাতিন অনুবাদ পাঠে এ আরব বিজ্ঞানীর সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।’
মেয়ারহেফ ঠিকই বলেছেন। ১৫৪৭ সালে বেলোনোর আন্দ্রিয়া আলগাগো ইবনুন নাফিসের কয়েকটি বই ল্যাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন। স্পেনের পাদ্রি মাইকেল সার্ভিটাস খ্রিষ্টিয়ানিজম বেসটিটিউশন গ্রন্থে এ মতবাদের সমর্থন করেন ইবনুন নাফিসের নাম উল্লেখ ছাড়াই।
আর যান কোথা? পাদ্রিরা চটে গেলেন। বাইবেলবিরোধী মতবাদ হিসেবে একে অভিহিত করা হলো। এর প্রচারের জন্য ঈশ্বরের শত্রু বলে চিহ্নিত হলেন সার্ভিটাস। তার বই নিষিদ্ধ হলো এবং আগুনে পোড়ানো হলো। এতেই সন্তুষ্ট ছিল না পোপতন্ত্র। ১৫৫৩ সালের অক্টোবরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো সার্ভিটাসকে। এরপর আন্দ্রিয়াস ভাসালিয়াস ‘দ্য ফ্রাবিকা’ গ্রন্থে ইবনুন নাফিসের মতবাদ প্রচার করেন এবং পরে আক্রান্ত হয়ে পিছু হটেন। সংশোধন করতে বাধ্য হন নিজের বই। ১৫৫৯ সালে রিয়ালডো কলম্বো ‘দ্য রি এনাটমিকা’ গ্রন্থে এ মতবাদ প্রচার করেন এবং শত্রুতার কবলে পড়েন। ১৬১৮ সালে উইলিয়াম হার্ভে গবেষণাগারে একে প্রমাণ করে যখন প্রচারে নামলেন, লোকেরা তাকে ধর্মের দুশমন আখ্যা দেয়। ক্যাথলিক চার্চ তাকেও পুড়িয়ে মারত। কিন্তু ইংল্যান্ডে তখন ক্ষমতায় ছিল প্রোটেস্টান্টরা। ফলে রক্ষা পান হার্ভে।
ইউরোপে যখন তিন শত বছর পরেও ইবনুন নাফিসের আবিষ্কার প্রতিরোধের সম্মুখীন হলো, তখন প্রশ্ন আসে মুসলিম জাহানে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এ আবিষ্কারের?
প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ইতিবাচক। ইবনুন নাফিসের আবিষ্কার তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। উলামা শ্রেণী যেমন তাকে কবুল করেন, তেমনি একে বরণ করে নেন শাসকরা। সুলতান মালিকুজ্জাহির বাইবার্সের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে মনোনীত হন ইবনুন নাফিস। শায়খ খলিল আস সাকিদি ‘ওয়াদি বিল ওয়াকায়াত’ গ্রন্থে লেখেন ‘ইবনুন নাফিস ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ একজন ইমাম। অত্যন্ত প্রাজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ এক হাকিম।’
নতুন এই মতবাদের জন্য দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া এলো দুই মহাদেশে। খ্রিষ্ট জগত বিজ্ঞানকে ধর্ম দিয়ে শাসন করতে চাইল এবং রুখে দিতে চাইল নতুন উদ্ভাবনকে। মুসলিম জাহান বিজ্ঞানকে তার আপন পথে বিকশিত হতে দিলো এবং স্বাগত জানালো নতুন আবিষ্কারকে।
এমনই নজির আমরা দেখবো মেঘমালা ও বৃষ্টিচক্র সম্পর্কে। নাসিরুদ্দিন তুসি ও ভূগোলবিদ আল বালাখি যখন বাষ্পজাত মেঘ ও বৃষ্টিতত্ত্ব প্রচার করলেন, মেনে নিলো মুসলিম জাহান। পৃথিবী ও জ্যোতির্মণ্ডল সম্পর্কে যখন বানু মুসা প্রচার করলেন নতুন মতবাদ, মুসলিম জাহান মেনে নিলো। তারা বললেন, আকাশ ও জ্যোতির্মণ্ডল পৃথিবীর মতোই পদার্থবিজ্ঞানের একই নিয়মের অধীন। পরবর্তী মুফাসসিরগণ এ বক্তব্যকেই স্থান দিলেন আপন তাফসিরে।
তখনকার প্রেক্ষাপটে মুসলিম জাহানের জ্ঞানমার্গের বাস্তবতা ছিল এমনই। যদিও আজ সম্পূর্ণ উল্টো বাস্তবতা বিরাজমান। কিন্তু এ বিবরণের দাবি এই নয় যে, মুসলিম দুনিয়ায় বিজ্ঞানীরা খুব সুখে ছিলেন। তাদেরকে প্রায়ই আক্রান্ত হতে হতো। প্রতিকূলতা তাদের পেছনে থাকতই। কিন্তু সেটি হতো আকিদাগত কারণে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান চর্চার কারণে নয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণে নয়। তাদের দার্শনিক মতবাদ ও ন্যায়তত্ত্বের বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে প্রথাগত আলেমদের মুখোমুখি করত। কিন্তু ইউরোপে তখন ছিল ভয়াবহ ধর্মান্ধতা। শিক্ষা ও বিজ্ঞান ছিল গির্জার অন্যতম দুশমন। গির্জা যা শেখাবে, কেবল তা-ই শিখতে হবে। অন্য সব জ্ঞান-বিজ্ঞান মানেই ধর্মহীনতা।
বিজ্ঞান ও ধর্মের হাজার বছরের দ্বন্দ্বের বিবরণ আছে জন উইলিয়াম ড্রেপার এর History of the Conflict between Religion and Science (London: Watts & CO., 1873)
গোঁড়া সেক্যুলার লেখক আন্দ্রেও ডিকসন হোওয়াইট এর A History of the Warfare of Science with Theology in Christendom, (New York: D. Appleton & CO.,1896)
পল কুর্তজ (Paul Kurtz) এর Science and Religion: Are the Compatible?, ( Prometheus Books, 2003) ইত্যাদি গ্রন্থে।
গির্জার বর্বরতার রোমহর্ষক বিবরণে কম্পমান গ্রন্থগুলোর একেক পাতা।
এ বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র গ্রন্থ। শুধু একটি বিবরণ থেকে এর ভয়াবহতা আন্দাজ করা যায় যে, শুধু ইনকুইজিশনের নামে ১৪৮১ থেকে ১৪৯৮ এই ১৮ বছরে ১০ হাজার ২২২ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করে পাদ্রিরা। ইনকুইজিশনের হাতে ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষ ধর্মদ্রোহী আখ্যায়িত হয়। এর মধ্যে লাখের বেশি মানুষকে মারা হয় আগুনে পুড়িয়ে।
এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ। ধর্মের নামে পোপতন্ত্রের এই স্বেচ্ছাচার এবং প্রগতি ও বিজ্ঞানবিরোধিতা এক সময় প্রত্যাখ্যাত হয় ইউরোপে। ধর্ম যাতে সব দিকে হাত পা না বাড়ায়, সে জন্য তাকে শেকলাবদ্ধ করা হয় সেকুলারিজমের নামে। আবদ্ধ করা হয় একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে। ইসলামের ইতিহাসে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মুখোমুখি হওয়ার নজির নেই। যদিও প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রভাবে বিজ্ঞানবিমুখ মানসিকতা পরবর্তীতে মুসলিম দুনিয়ায় ভয়াবহ রূপ পেয়েছে। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা ও দর্শন বিজ্ঞানের বিকাশ ও অগ্রগতিকেই শুধু জোগাতে চেয়েছে রক্তজল!
লেখক : কবি, গবেষক