শুরু হওয়ার ২৬ দিনের মাথায় ক্ষোভ ও হতাশা সঙ্গী করে শেষ হলো এ বছরের অমর একুশে বইমেলা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল সোমবার স্টল গুটিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রকাশকরা। এবার মেলার শুরু থেকেই সময় নির্ধারণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সরকারি বিধিনিষেধ জারি, পরিচালনায় প্রকাশকদের মতামতকে প্রাধান্য না দেওয়াসহ নানা কারণে আয়োজক বাংলা একাডেমির সঙ্গে মনোমালিন্য ছিল প্রকাশকদের। তাদের ভাষ্য, পুরোপুরি প্রতিকূল পরিবেশে বইমেলা হওয়ায় লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, এবার বিনিয়োগই উঠে আসেনি। এ নিয়ে গতকাল বিকালে মেলা প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সমিতি। এতে সমিতির সহ-সভাপতি ও বইমেলা স্ট্যান্ডিং কমিটির
আহ্বায়ক শ্যামল পাল ক্ষোভ, হতাশা তুলে ধরে তাদের প্রস্তাবনা পেশ করেন। এ সময় অনিন্দ্য প্রকাশনীর আফজাল হোসেন, ভাষাচিত্রের খন্দকার সোহেলসহ সমিতির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা উপস্থিত ছিলেন।
শ্যামল পাল বলেন, এবারের মেলায় সরকারি, বেসরকারি ও শায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া শুধু সৃজনশীল প্রকাশকদের বিক্রি হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৮ টাকা। অন্যান্য বছর বাংলা একাডেমি এই হিসাবটি দিয়ে থাকে। তবে বাংলা একাডেমির এই হিসাব যুক্তিযুক্ত নয়।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রকাশকরা সব সময় বলে থাকেন, একাডেমি বিক্রির পরিমাণ যা বলে তা মিথ্যা। বাস্তবে এইবার আমরা যে পরিস্থিতি দেখছি তাতে স্টলে গিয়ে বিক্রির পরিমাণ জানানো সম্ভব নয়। কারণ কেউ সত্য কথা বলছেন না। যে কারণে আমরা এবার বই বিক্রির পরিমাণ গণমাধ্যমকে জানাতে পারিনি।
বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মেলায় বাংলা একাডেমিসহ সব প্রকাশকের পুরো মাসে বিক্রি হয়েছিল ৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে একাডেমির বিক্রি ছিল ২ কোটি ৩৩ লাখ। গত বছর নতুন বই এসেছিল ৪ হাজার ৯১৯টি। এবার নতুন বই এসেছে ২ হাজার ৬৪০টি।
বিক্রেতা সমিতির সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, এবারের মেলায় প্রকাশকদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহে দুপুরে মেলার সময় নির্ধারণ, স্টলের অসম বিন্যাস, ২৬ দিনে তিনবার মেলা খোলা রাখার সময় পরিবর্তনসহ নানা কারণে এবারের মেলা সত্যিকার অর্থে পাঠকের অনুকূলে ছিল না। ফলে যা বিক্রি হয়েছে তাতে বিনিয়োগের এক ভাগও উঠে আসেনি। এই পরিস্থিতিতে প্রকাশকরা সরকারের কাছে ন্যূনতম ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান। যা বরাদ্দ দেওয়া হলে পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সমিতি এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি এই অর্থ সমন্বয় করবে।
এর আগে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর একটি খোলা চিঠি লেখেন। চিঠিতে করোনাকালে বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি দুটি প্রস্তাবনা দেন। এগুলো হলো- বইকে জরুরি পণ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে লকডাউনের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বইয়ের দোকান খোলা রাখা। এবারের মেলা যেসব প্রকাশক ক্ষয়ক্ষতি মেনে মেলায় স্টল দিয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন, তাদের সবার ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারের ১০০ কোটি টাকার বই ক্রয়।
এদিকে গতকাল মেলার শেষদিনেও ৬৪টি নতুন বই প্রকাশ হয়েছে। যদিও শেষদিনে বেচাকেনার দৃশ্য থেকে বাড়ি ফেরার তাগিদেই ছিল বেশি। দুপুর ১২টায় মেলার প্রবেশদ্বার খোলার পর থেকে বিকাল ৫টায় বন্ধ হওয়া পর্যন্ত স্টলে স্টলে বই বিক্রি বাদ দিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার গল্পই বেশি করতে দেখা গেছে।
অন্যান্য বছরের মতো এবার মেলার শেষ আনুষ্ঠানিকতাও ছিল না। বাংলা একাডেমি তাদের নিজস্ব স্টলে বিক্রির বিষয়টিও জানায়নি। তবে বিজ্ঞপ্তিতে নতুন বইয়ের সংখ্যা এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২১ ঘোষণা করে। ২০২১ সালে অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হচ্ছে। প্যাভিলিয়ন ক্যাটাগরিতে কথাপ্রকাশ, ২-৪ ইউনিটে সংবেদ ও ১ ইউনিটে উড়কি এই পুরস্কার পেয়েছে।