রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১০ পূর্বাহ্ন

করোনায় স্তব্ধ জীবন, উত্তরণের উপায় কী

মো: মাঈনউদ্দীন
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১
  • ১৬৬ বার

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, শুধু মার্চ-২০২১-এ আক্রান্ত হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৬৩৮ জন। করোনা তার ধরন পাল্টেছে। এখন জ্বর, সর্দি ছাড়াও করোনা শনাক্ত হচ্ছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা বাংলাদেশে। আক্রান্ত বাড়তে থাকায় হাসপাতালে প্রকট হয়ে উঠেছে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যা সঙ্কট। সারা দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৭১১টি।

আইসিইউ রয়েছে ৫৮৬টি যা খুবই অপ্রতুল। আইসিইউর অভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছে অনেক রোগী। হাসপাতালে সাধারণ শয্যাও স্থান পাচ্ছে না রোগীরা। রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সে মারা যাচ্ছে। গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম রোগী আক্রান্ত হয়েছিল ৫১ জন, মারা গেছে পাঁচজন এর পরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। গত বছর আগস্ট মাসে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করলেও এ বছর মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকে হঠাৎ বাড়তে থাকে। আক্রান্ত বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে। বেসরকারি পাঁচতারকা হাসপাতালেও আইসিইউ মিলছে না।

আইসিইউয়ের অভাবে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে রাখা হচ্ছে রোগীদের। অনেক হাসপাতালে সেই ক্যানোলারও বেহাল দশা, অক্সিজেন স্বল্পতায় রোগীদের অবস্থার অবনতি ঘটছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম দফা সংক্রমণের চেয়ে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ বহুগুণে শক্তিশালী। তবে এই দফা সংক্রমণ কোথায় গিয়ে ঠেকে, কত দিন থাকে তা কেউ বলতে পারছে না। দ্বিতীয় দফার এ সংক্রমণকে অবহেলা করলে অনেক বড় ভুল হবে। বিনা চিকিৎসায়, বিনা পরিচর্যায় বহু লোক মারা যাবে। দেশে প্রথম ডোজ টিকা দিলেও সংক্রমণ ঠেকানো যায়নি। টিকার কার্যকারিতাই বা কতটুকু তা-ও ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। আবার ভাইরাসের ধরনও পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক টিকার কার্যকারিতাও কম। মানুষ টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। এ দিকে সরকার করোনা প্রতিরোধে ১৮ দফা নির্দেশনা দিলেও জনগণের মধ্যে তা পালনে শৈথিল্য দেখা গেছে। ঢিলেঢালা লকডাউন শেষে এখন ‘কঠোর’ লকডাউন বলবৎ করা হয়েছে। পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিছুদিন আগের শিথিল লকডাউনের সময় তারা জীবিকার তাগিদে, ক্ষতির ভয়ে মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে কোথাও কোথাও বিক্ষোভ করেছেন। গত এক বছরে করোনার প্রকোপে তারা অনেক কিছু হারিয়েছেন, অনেকে বেকার হয়েছেন, অনেক ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে ব্যবসায়ী-কর্মজীবী ও শ্রমিকেরা জীবনের তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজে নেমে পড়েন, সরকারও বিভিন্ন প্রণোদনা ও আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টা করলেও করোনার চলমান ঢেউ সবার মধ্যে আবার হতাশা সৃষ্টি করেছে। এ দিকে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে গাছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে, যা রীতিমতো হতাশাজনক।

লকডাউন চললেও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, জন সমাগম কমাতে হবে।

করোনার এ ভায়াবহ প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব-অর্থনীতি যখন মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তার ঢেউ ধনী-দরিদ্র সব দেশেই দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপেরও অনেক দেশ জীবন ও অর্থনীতির ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও করোনায় কম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে না, তবে প্রথম দিকে অর্থাৎ গত বছর মানুষের মধ্যে ভয়, জীবনের ঝুঁকি ও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। ফলে গত আগস্টের দিকে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমতে দেখা গেছে। ফলে মানুষ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেমে পড়ে, পাশাপাশি সরকারের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণার মধ্য দিয়ে জীবন ও অর্থনীতি অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তা ছাড়া প্রথম দিকে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে ভালো অবদান রেখেছে। তাতে এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ঊর্ধ্বমুখী লক্ষ করা গেছে। যদিও আমাদের বেকারত্ব, দরিদ্রতা, বৈষম্য, দুর্নীতি বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যদি আরো ভয়াভহ রূপ ধারণ করে তাহলে ব্যাপক হারে যেমন জীবনহানি ঘটবে তেমনি অর্থনীতির ও অধঃগতি দেখা দিতে পারে। মানুষ জীবনের তাগিদে জীবিকার প্রয়োজেনে ঘরে থাকতে পাচ্ছে না। করোনার প্রথম ধাক্কায় বিশেষ করে শহরের ক্ষুদ্রব্যবসায়ী, শ্রমিক, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল তা সামলে ওঠার চেষ্টার মধ্যে করোনার প্রকোপতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি সবাইকে নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে। বর্তমানে ওমানে পরীক্ষামূলক ও পক্রিয়াধীন কিছু টিকার প্রয়োগ ও উদ্ভব-এর ওপরে নির্ভর না করে নিজেদের দেশে টিকা উৎপাদনের জন্য গবেষণা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ব্যাপারে সরকারকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এই ভাইরাস সহজে নির্মূল হচ্ছে না, কারণ সারা বিশ্বের সব মানুষকে টিকার আওতায় আনা আর টিকা দিয়ে ভাইরাস থেকে বাঁচার ব্যবস্থা কম সময়ে হচ্ছে না। তাই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় স্বাস্থ্যবিধি মানা, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত ও সবার মধ্যে সচেতনতা আনার জন্য কমিটি গঠন করা ও তার বাস্তবায়ন করা উচিত কারণ করোনা আমাদের জীবনের সাথে মিশে গেছে, এর থেকে বাঁচতে হলে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। শুধু ঢিলেঢালা লকডাউন দিয়ে, লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে, তা কার্যকর না করে করোনা থামানো যাবে না।

সরকারকেই এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবারহ, বেড সংখ্যা বাড়ানো এবং আইসিউর সংখ্যা বাড়ানো সর্বোপরি স্বাস্থ্যবিষয়ক ও আইসিইউর বিভিন্ন সরঞ্জামাদির খরচ কমাতে হবে, ভ্যাট কমাতে হবে।

আমাদের জীবনও বাঁচাতে হবে, জীবিকাও ধরে রাখতে হবে। তাই জীবন বাঁচানোর তাগিদে, খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা ও কৃষিবিষয়ক অতি প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে চালু রাখা যেতে পারে। কারণ আমাদের অর্থনীতিকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। অর্থনীতির গতি রুদ্ধ করা যাবে না। চলতি অর্থবছর প্রায় শেষ পর্যায়ে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পেশের সময় কাছাকাছি। কয়েক দিন আগে চলমান অর্থবছরে বাজেটের (২০২০-২১) দ্বিতীয় প্রান্তিক (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয় গতিধারা এবং সামাজিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণসংক্রান্ত প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যায় করোনাকালে অর্থবছরে দ্বিতীয় প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কমেছে ৩ দশমিক ১ শতাংশ। এ সময় বাজেট বাস্তবায়ন বা সরকারের ব্যয় কমেছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সামনের সময়ে ব্যয় বাড়ানোর জন্য জোরদার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে রফতানি আয় ১৯.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে, যা বিগত অর্থবছরের চেয়ে ০.৩৬ শতাংশ কম।

আমদানি ৬.৮ শতাংশ কমে হয়েছে ২৫.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মুদ্রাস্ফীতি ২০১৯ এ ছিল ৫.৫৯ (ডিসেম্বর-১৯) সামান্য বেড়ে হয় ৫.৬৯ শতাংশ (ডিসেম্বর-২০) অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আসন্ন বাজেটে দেশীয় শিল্পের উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হবে। অর্থনীতির গতিকে ঘরে রাখতে হলে টিকার ব্যবহার কার্যকর করা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থনীতিবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া উচিত। করোনাকালীন সময়ে যে ব্যাপকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার বিষয়টি সামনে রেখে সরকারকে তার উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষিকে আধুনিকীকরণ, কৃষি সরঞ্জামাদি ও কৃষি উপকরণের দাম কমানোসহ কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে তাদের কৃষি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র ও হতদরিদ্র ও বেকার শ্রমিকদের মধ্যে কার্যকরভাবে প্রয়োজনীয় অর্থসহ চাল, ডাল, আলু, তেলসহ প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সরবরাহ করা উচিত।

অর্থনীতির গতিশীলতা ও উন্নয়নের পেছনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরাট অবদান রয়েছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ফলে ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে সমস্যায় পতিত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়ছে। ব্যাংকের ঋণ আদায়ের হার হ্রাস পেলে বিনিয়োগের গতি মন্থর হবে, উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটাবে, যার প্রভাব জীবনের ওপর আসবে। জীবন ও অর্থনীতির নানা সমস্যা সমাধান ও অগ্রগতির জন্য বর্তমানে করোনার যে ভয়াবহ রূপ তা থেকে মুক্ত হতে হবে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও কার্যকর লকডাউন এবং তার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকা চাই।

ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বৃদ্ধি করা উচিত, বরাদ্দ বাড়ানো উচিত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com