পদ্মা সড়ক সেতুর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রেলপথও। এ জন্য পৃথক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সড়ক সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেও রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ উল্টো পিছিয়ে যাচ্ছে। ঠিকাদারকে সময়মতো জমি বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। জমি অধিগ্রহণ ও বিভিন্ন পরিসেবা স্থানান্তর সমস্যার পাশাপাশি রয়ে গেছে নকশা জটিলতা ও বাড়তি অর্থায়নের বিষয়ও।
এ কারণে চীনা অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংকের কাছে নালিশ করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দলের প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এ সংকট থেকে পরিত্রাণ এবং ফার্স্টট্র্যাকভুক্ত বা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পটির কাজ কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ মনে করছে, তা না করে কালক্ষেপণ করা ফার্স্টট্র্যাক ধারণার সঙ্গে অবশ্য সাংঘর্ষিক। এদিকে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত রেল কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭২ কিলোমিটার, যেখানে পরবর্তী সময়ে ডাবল লাইন করার সুযোগ থাকছে। কিন্তু এ ডাবল লাইনের পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে পদ্মা সেতু অংশের রেলপথ। সেতুটির নকশা প্রণয়নের সময় রেলপথের জন্য সিঙ্গেল লাইন রাখা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ডাবল লাইন করার কোনো অবকাশ নেই। অথচ রেলপথটি ভবিষ্যতে ডাবল লাইন করতে পারলে ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো যাবে; সময়ও অনেক বাঁচবে।
রেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, এ সমস্যাটি দফায় দফায় বৈঠক করে জানানো হয়েছিল সেতু কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে জানিয়ে সেতুর নকশায় পরবর্তী সময়ে ডাবল লাইন সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প। সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে পদ্মা সেতুর সড়কপথ ও রেলপথ একই দিন চালু হবে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন মাস থেকে সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। সেতুটির উদ্বোধনের দিনই যেন রেলপথ চালু করা যায়, সে লক্ষ্যে প্রকল্পটির মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ ও পরিসেবা স্থানান্তর সম্পন্ন করতে বিলম্বের কারণে নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পে ১৭৮৬ একর জমি অধিগ্রহণে ৬২৪৯.২৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন সংস্থার পরিসেবা সংযোগ স্থানান্তরে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু এ পরিমাণ অর্থে এগুলো সম্পন্ন করা যাচ্ছে না।
এ কারণে মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৯৬২.৩৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত সংস্থানের প্রস্তাব করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গত জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফা চিঠি চালাচালির পরও এর অনুমোদন মেলেনি। পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে প্রস্তাবটি অনুমোদনের একটি প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখনো সেটি রেল মন্ত্রণালয়ের ‘যাচাই-বাছাই’ ধাপে রয়ে গেছে। জমি বুঝে না পাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩৩.২৫ কোটি টাকা দণ্ডসুদ দাবি করেছে। ভূমি অধিগ্রহণ ও পরিসেবা সংযোগ স্থানান্তরে যত দেরি হবে, দণ্ডসুদের এই অর্থের পরিমাণ তত বাড়বে, যা পরিশোধ করতে হবে সরকারি খাত থেকে। এরই মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছে, কেন সময়মতো সাইট বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না? সবকিছু মিলিয়ে সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এ প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা থেকে গেছে। উপরন্তু প্রকল্পের কিছু অংশের নকশা জটিলতা তো রয়েছেই।
এদিকে মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী নকশা করা হলেও ট্রায়াল পাইলের লোড টেস্ট করতে গিয়ে ত্রুটি ধরা পড়েছে। এর সমাধানে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ ছাড়াও গঠিত প্যানেল অব এক্সপার্টের মতামত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ খাতেও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পাইলের লোড ঠিক রাখতে হলে এরিয়া বাড়াতে হবে বলে যে সিদ্ধান্ত এসেছে, সেটি বাস্তবায়নেও বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থ জোগাড়। কারণ প্রকল্পে প্রভিশনাল সাম হিসেবে যে পরিমাণ অর্থ রাখা হয়েছে, তা দিয়ে এর পুরোপুরি সমাধান করা যাচ্ছে না।
যদিও রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন বলেছেন, পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে।