করোনার এই ক্রান্তিকালে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা। জেদের বশে স্ত্রী নির্মমভাবে হত্যা করছেন স্বামীকে, স্বামী মেরে ফেলছেন স্ত্রীকে। সবচেয়ে নিরাপদ যে মায়ের কোল, সেই মা হয়ে যাচ্ছেন সন্তানের হন্তারক; সন্তানকে খুন করে পালিয়ে বেড়ান বাবা। ক্ষোভ বা লোভের বশবর্তী হয়ে মা-বাবার রক্তে হাত রঞ্জিত করা সন্তানের সংখ্যা আরও বেশি। ভাই মেরে ফেলছে বোনকে, বোন ভাইকে। মানুষ কেন তার পরিবারের সদস্যদের মতো অতি আপন মানুষের ঘাতক হয়ে উঠছে? এমন প্রশ্নে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ অনেক কারণেই পারিবারিক অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ অশান্তি থেকেই যত বিপত্তি, যত প্রাণঘাত। অশান্তির নেপথ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির লোভ, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, সাংসারিক অনটন, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, বহিরাগত রাষ্ট্রের সংস্কৃতির আগ্রাসন, ভোগ-বিলাসিতার আকাক্সক্ষা, প্রযুক্তির অপব্যবহার ও মাদকাসক্তি ছাড়াও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তারা। গত শুক্রবার গভীর রাতে রাজধানীর কদমতলীর মুরাদপুর এলাকায় ক্ষোভ থেকে পরিবারের সবাইকে ঘুমের ওষুধে অচেতন করে মা-বাবা-বোনকে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর স্বামী ও ছয় বছরের শিশুসন্তানকেও হত্যার চেষ্টা করেন মেহজাবিন ইসলাম মুন নামে এক তরুণী।
এ হত্যাকা-ের পর জাতীয় জরুরি সেবার হটলাইন ৯৯৯-এ ফোন করে ওই তরুণী বলেনÑ ‘তিনজনকে খুন করেছি, তাড়াতাড়ি আসেন, তা না হলে আরও দুইজনকে (স্বামী-সন্তান) খুন করব।’ মুন জানান, পরিবারের প্রতি বাবার উদাসীনতা ও দ্বিতীয় বিয়ে; দেহব্যবসার মতো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করার কারণে মা এবং পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ায় ছোট বোনকে হত্যা করেছেন তিনি। হত্যা করতে চেয়েছিলেন স্বামীকেও।
গত বুধবার সিলেটের গোয়াইনঘাটে নিজ ঘরে দুই সন্তানসহ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করেন হিফজুর রহমান নামে এক পাষ-। হত্যার দায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে এখন কৌশল অবলম্বন করেন হিফজুর। তিনি জানান, ওই রাতে তিনি স্বপ্নে মাছ দেখতে পান, এর পর মাছ মনে করে উপর্যুপরি কুপিয়েছেন তাদের। কিন্তু পুলিশ বলছে, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করে ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে নিজেই নিজের হাত-পা কেটে ক্ষতবিক্ষত করেন হিফজুর।
১০ জুন দিবাগত গভীর রাতে রাজধানীর ভাটারা থানাধীন সোলমাইদের নামাপাড়া এলাকায় পরকীয়া সম্পর্ক্যরে জেরে স্ত্রী জোবেদা খাতুনকে ঘুমন্ত অবস্থায় কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন স্বামী আবুল কাশেম। ৩১ মে রাজধানীর তিন থানা এলাকা থেকে অটোরিকশাচালক ময়না মিয়ার ছয় টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দুদিন অভিযান চালিয়ে ছয় টুকরো লাশ উদ্ধার হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়ে যায় ঘাতকও। জানা যায়, ময়না মিয়ার খুনি তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। ময়না দুটি বিয়ে করেছিলেন। এই নিয়ে এ দম্পতির মনোমালিন্য বাড়তে থাকলে বেশিরভাগ সময় দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছেই থাকতেন ময়না। এমনকি ফাতেমার আয়ের টাকাও নিয়ে যেতেন। সেই টাকা দিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীসহ অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনি আনন্দ-ফুর্তি করে বেড়াতেন। এটা মেনে নিতে না পেরে ময়না মিয়াকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন ফাতেমা। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নিজ হাতে লোমহর্ষক ওই হত্যাকা-ের পর লাশের বিভিন্ন অংশ তিন থানার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ফেলেন তিনি নিজেই।
২৮ মে পাবনার ঈশ্বরদীর রূপনগর মহল্লায় ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া ও বাবার সম্পদ একাই ভোগ করার লোভে পরিকল্পিতভাবে বড় ভাই শাকিল আহমেদ ওরফে ভোলাকে হত্যা করেন ছোট ভাই সাব্বির হোসেন। ভাবি মীম খাতুন দেবরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বামী হত্যায় সরাসরি অংশ নেন। ভোলাকে ঘুমের ওষুধে অচেতন করে মুখে বালিশ চেপে শ্বাসরোধে হত্যা করেন মীম ও সাব্বির।
এখানেই শেষ নয়। সাম্প্রতিককালে এমন খুনোখুনি অনেক বেড়ে গেছে। চলতি বছরের গত সাড়ে পাঁচ মাসে পারিবারিক দ্বন্দ্বে সারাদেশে খুন হয়েছেন অন্তত ৪০ জন নারী, পুরুষ ও শিশু।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছেÑ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ১৬৯ দিনে আর্থিক টানাপড়েন, পরকীয়া, সন্দেহ, মাদক, যৌতুকসহ নানা ধরনের পারিবারিক কলহে স্বামী ও তার স্বজনদের হাতে সারাদেশে খুন হয়েছেন ১৯২ জন নারী। এর মধ্যে স্বামীই হত্যা করেছেন ১১৫ গৃহবধূকে। এই সময়ে পারিবারিক নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন ৭২ জন রমণী। স্বামী ও তার স্বজনের হাতে পারিবারিক ও যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হন ৫৮ জন গৃহবধূ। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে আর্থিক টানাপড়েন, পরকীয়া, সন্দেহ, মাদক, যৌতুকসহ নানা ধরনের পারিবারিক কলহে স্বামী ও তার স্বজনদের হাতে খুন হন ৩৬৬ জন নারী। এর মধ্যে স্বামীই হত্যা করেছেন ২৪০ গৃহবধূকে। এই সময়ে পারিবারিক নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন ৯০ জন রমণী। একই সময়ে শুধু যৌতুকের কারণে খুন হন ৮৯ জন নারী। নির্যাতনের আত্মহত্যা করেন ১৮ জন। আর স্বামী ও তার স্বজনের হাতে পারিবারিক ও যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হন ২০৮ জন গৃহবধূ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপপরিষদের তথ্য বলছেÑ ২০২০ সালে যৌতুকের বলি হয়েছেন ৫২ জন গৃহবধূ; নির্যাতনের শিকার হন ১১৭ জন। এই সময়ে বিভিন্ন কারণে হত্যাকা-ের শিকার হন ৪৬৮ নারী-শিশু। হত্যার চেষ্টা করা হয় ৩৫ জনকে। আর চলতি বছরের গত মে মাসে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয় তিনজনকে; নির্যাতনের শিকার হন ৯ জন। বিভিন্ন কারণে হত্যাকা-ের শিকার হন ৪১ নারী-শিশু। হত্যার চেষ্টা করা হয় ৬ জনকে।
পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ ও তার প্রতিকারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা অনেকটাই বেড়েছে। সহিংসতার ধরনগুলো আগেও ছিল, তবে দেখা যাচ্ছে প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। যে কোনো আপদকালীন সময়ে বা মানুষ যদি দীর্ঘ সময় ধরে মানুষিক অস্থিরতা বা চাপের মধ্যে থাকে কিংবা সংকটকালীন জটিলতার মধ্যে থাকে অথবা পরিবারের কোনো সদস্যের আর্থিক দৈন্য কিংবা প্রত্যাশার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যবধান ঘটলে আচরণগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশে পরিবারের স্বামী কিংবা স্ত্রী অথবা অভিভাবকদের যে ধরনের দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও উপলব্ধি থাকার প্রয়োজন তা মোটা দাগে ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতির পেছনে অন্যতম কারণ হলোÑ বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ পরিবার এক ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে। এতে অর্থনৈতিক টানাপড়েন থাকতেই পারে। একে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তর্ক হয় দ্বন্দ্ব হয়। এই তর্ক একসময় হত্যাযজ্ঞের দিকেও ধাবিত করতে পারে। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত আমাদের যে অগ্রগতি তা অবাধ হওয়ায় বেশ প্রভাব পড়ছে পরিবারের ওপর। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার যে অবাধ ব্যবহার তাতে শিষ্টাচার না মানার কারণে নৈতিক এবং আদর্শিক একটি স্থলন ঘটে। এর ফলে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বা অনৈতিক কর্মকা-ের দিকে ধাবিত হওয়ার একটি সোপান পেয়ে যান শিষ্টাচারবিহীন ব্যবহারকারীরা। এর দরুন পরিবারের অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে; হচ্ছে খুনোখুনির মতো ঘটনাও।
তৌহিদুল হক আরও জানান, কোনো কোনো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মাদকের প্রভাব ও লোভ-লালসার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় তাদের কেউ কেউ ঘাতক হয়ে উঠছে। আবার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউবা বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলার কারণে নৃশংস হয়ে উঠছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের যে বন্ধন, তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সম্পত্তি নিয়ে লোভের বশবর্তী হয়েও নিজ পরিবারের সদস্যকে হত্যা করতে কুণ্ঠা করছে না আপনজন। অপরাধের বিষয়গুলো অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করে। আবার বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি কারণ। দারিদ্র্যের সীমারেখা কমিয়ে আনতে পারলে পারিবারিক সহিংসতাও অনেকাংশে কমবে। সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্র থেকে নিলেই হবে না। পরিবার থেকেও এর দায়িত্ব নিতে হবে। স্কুল-কলেজেও সামাজিক মূল্যবোধ, একে অপরের প্রতি সম্মান, বন্ধুত্বের বন্ধনের গুরুত্বের বিষয়ে পাঠ দান করতে হবে।
হতাশার কারণে পারিবারিক হত্যাকা-ের ঘটনা বাড়ছে
অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেনÑ সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে কয়েকটি পারিবারিক নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো হতাশার কারণে। তিনি বলেন, করোনার কারণে সারা পৃথিবীতে বৈশি^ক মহামারী সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অন্য দেশগুলোয় একটা সিস্টেম কাজ করে কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সিস্টেম নেই, আইনের শাসন নেই। করোনার কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আয় কমে গেছে। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। আর এই হতাশা থেকে পারিবারিক কলহ এবং নৃশংস হত্যাকা- ঘটছে। দেখা যায় পারিবারিক খুনোখুনির অধিকাংশ ঘটনা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে ঘটছে। এ শ্রেণির জনগোষ্ঠীর সন্তানরা প্রায় ক্ষেত্রেই সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। তাই সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। ফলে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় সহজেই জড়িয়ে পড়ে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, পারিবারিক সহিংসতার আরেকটি বড় কারণ মাদক। মাদক সেবনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। মাদকের প্রভাবে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ বাড়ছে। মানসিক রোগের উপসর্গ তৈরি হচ্ছে। আবার মাদকের প্রভাবে সন্তানের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। এটা সমাজকে এমন এক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক চিন্তার জায়গা লোপ পেয়ে যায়। উল্টো নির্মমতা, সহিংসতা ও হিংস্রতা বাড়ায়। এ ছাড়া পরকীয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ বাড়ছে, যার পরিণতিতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। এমনকি অল্পবয়সীরাও পর্নোগ্রাফির দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা বাড়ছে। এ ছাড়া বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক সহিংসতা থেকে উত্তরণে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. নেহাল করিম।