২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর্থিক সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই বাজেট প্রণয়ন করতে হয়। তবে টানাটানির অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোন অভাবকে প্রাধান্য দিতে হবে, তা আগেই নির্ধারণ করা জরুরি।
আমাদের জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতির এতটা ক্ষতি এত বছরে কেউ করতে পারেনি, যতটা করেছে কোভিড। জীবন-জীবিকার সমন্বয়টা খুবই জরুরি। এবারের বাজেটে রয়েছে মূলত দু’টি চ্যালেঞ্জ। এক. করোনার কারণে অর্থনীতি যে গর্তে পড়েছে, সেখান থেকে তুলে এনে তার গতি বাড়ানো। দুই. দেশ ধনী হচ্ছে, প্রশ্ন বৈষম্য নিয়ে। বর্তমান সময়ে ধনীদের আরো ধনী হওয়ার প্রক্রিয়া কাঠামোগতভাবে প্রতিহত করা।
করোনাকালে কিছু মানুষ অতিধনী হয়েছে। আবার অর্থনীতিতে যে অভিঘাত পড়েছে, তা দরিদ্রকে অতিদরিদ্র অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। নতুন দরিদ্র হওয়া বৈষম্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। নতুন গরিবদের জন্য প্রাথমিক ও দীর্ঘমেয়াদি এই দুই ধরনের পরিকল্পনা করতে হবে।
তাই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে দু’টি লক্ষ্য হওয়া উচিত। করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে সঙ্কোচন হয়েছে, তা যতটা দ্রুত পারা যায় কাটিয়ে ওঠা আর প্রবৃদ্ধির হার যাতে দ্রুততর হয়, সে লক্ষ্যে কর ও প্রণোদনাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো।
যখন অর্থনীতি অনেকটা সঙ্কুচিত, তখন বাজেটের আসল বিবেচনার বিষয় হচ্ছে রাজস্ব ঘাটতি আর বাস্তব চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা। রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধির চাপ সামলে নিয়ে প্রবৃদ্ধির পথে এগোতে হবেই। বেশির ভাগ দেশ যখন মহামারীর শুরুতেই ব্যয় বাড়িয়েছিল, স্বল্প রাজস্ব আয়ের বাংলাদেশ কিন্তু তখনো অনেকটা চিরচেনা পথেই হেঁটেছে। এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কিভাবে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়িয়ে অর্থনীতির গতি বাড়ানো যায়। এতে শুধু করোনাকালীন সঙ্কুচিত অর্থনীতিকে মোকাবেলা করা যাবে তাই নয়, অধিক কর্মসংস্থান করা যাবে। তাই তিনটি খাতে অগ্রাধিকার থাকা দরকার। প্রথমত, গরিব ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা। দ্বিতীয়ত, করোনার বিষয়টি মাথায় রেখে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। চিকিৎসাসেবা আরো উন্নত করা, যাতে করে করোনার পরবর্তী ধাপ আমরা মোকাবেলা করতে পারি। তৃতীয়ত, অবকাঠামো খাতে আরো বরাদ্দ বাড়ানো।
করোনা যেহেতু এখনই যাচ্ছে না, দরিদ্রদের নগদ টাকা বছরে একাধিকবার দেয়া এবং বাজারে প্রকৃত চাহিদা তৈরি হতে পারে সেই কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের সহযোগিতা দেয়া দরকার। কারণ এরাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সরকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা দিয়েছে ঠিকই, তবে এর প্রায় পুরোটাই ব্যাংক ঋণনির্ভর। একের পর এক ব্যাংক খোলা হলেও দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো ব্যাংকের আওতার বাইরে। ফলে প্রণোদনার ঋণের বেশির ভাগই পাচ্ছেন বড় ও প্রভাবশালীরা। বিদ্যমান ব্যাংক মডেলে প্রণোদনা ছাড় হলে সফল হবে না। কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে ব্যাংকে যাওয়ার সামর্থ্য নেই।
করোনার ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি ফেরাতে শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত চাঙা করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ যাবে পরিকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায়। অধিকন্তু, দ্রুত আর্থিক পুনরুদ্ধারের জন্য গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে যেমন পরিকল্পিতভাবে ব্যয় বরাদ্দ প্রয়োজন, অন্য দিকে শহরাঞ্চলেও বিশেষ নজর দিয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, তথা নগর দারিদ্র্য বিমোচনে জোর দেয়া আবশ্যক।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার জন্য আমরা প্রস্তুত নই, যেটা স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত। এই খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ করার উচিত, যাতে স্বাস্থ্য খাতে এখন যেসব দুর্বলতা আছে, সেগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়। অর্থ খরচে একটা গাইডলাইন থাকা উচিত। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দের মাত্র ২২ ভাগ টাকা খরচ হয়েছে। এটা উৎসাহব্যঞ্জক চিত্র নয়।
গ্রামীণ দরিদ্র মানুষেরা বেশ বিপদে আছে। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। সাময়িক কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকার যদি রাস্তাঘাট নির্মাণে আরো বেশি বরাদ্দ দেয়, তখন গ্রামাঞ্চলে অনেকের কর্মসংস্থান হবে। এতে করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।
চ্যালেঞ্জ শিক্ষা খাতেও। শিক্ষার মান উন্নয়ন, গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বাড়েনি। শিক্ষার্থীরা প্রায় দেড় বছর ধরে প্রত্যক্ষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই ঘাটতি পূরণ করাও এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই মনে করছেন, এর প্রভাব এখনই বোঝা না গেলেও ভবিষ্যতে যখন এসব ছাত্রছাত্রী চাকরির বাজারে আসবে, তখন বোঝা যাবে আমরা কী হারিয়েছি।
বাজেট আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়াচ্ছে। একই সাথে বাজেটে প্রান্তিক মানুষের জীবিকা নির্বাহ ও জীবনমান উন্নয়নের দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত। দেশের সব ক্ষেত্রে একই রকম উন্নতি হচ্ছে না। বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে সঠিকভাবে এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন চিত্র হতাশাজনক । ১০ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৪৯ শতাংশ।
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়েনি। ব্যক্তি খাতে ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল যেখানে ১৫ শতাংশ, প্রথম ৮ মাসে তা হয়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। গত এক দশকে যে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রায় স্থবির হয়ে আছে, তার বড় কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় সহায়ক পরিবেশের ঘাটতি। ফলে প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণও অনেক কম।
ঢাকাকেন্দ্রিক না করে সব জেলায় সাশ্রয়ী আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একীভূত উন্নয়নের ফলে অন্য শহরগুলোতে জীবিকা, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জীবনমান হারাচ্ছে। অথচ সমগ্র বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রয়োজন। আঞ্চলিক বৈষম্য কমাতে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোতে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনিয়োগ সুবিধা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা জরুরি।
করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে যখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখনই দ্বিতীয় ঢেউয়ের তীব্র ধাক্কা। সন্দেহ নেই, এতে দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। বিনিয়োগ পরিবেশ ও করকাঠামো নিয়ে ক্ষোভ আগে থেকেই ছিল। তবে প্রত্যাশা ছিল কঠিন এ সময়ে এসব বিষয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু সে রকম কিছু হয়নি।
জিডিপির আকার যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু ব্যয়ের পরিমাণও বাড়বে। আয় কোথা থেকে আসবে, সেই পথনকশা নেই। নতুন কর আরোপ না করে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার বন্ধ করার পদক্ষেপ নিয়ে সম্প্রসারণমূলক বাজেট করা এবং নীতি পরিকল্পনায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির চিন্তা থেকে বেরিয়ে বৈষম্য রোধ ও সুষম বণ্টনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
ব্যাংকে না হয় আপাতত তারল্য আছে, তবে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকবহির্ভূত অন্যান্য খাত থেকে যে বিরাট অঙ্কের টাকা সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের কাছ থেকে তা কিভাবে সংগ্রহ করা হবে, সেটাও অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ।
সরাসরি আয়কর আদায়ের সক্ষমতাও সবচেয়ে কম এনবিআরের। মোট আয়করের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে উৎসে ও অগ্রিম কর হিসেবে। এর মানে, আয়-ব্যয় হিসাব করার আগেই ব্যবসা পরিচালনা পর্যায়ে উৎসে ও অগ্রিম করের নামে বিপুল অর্থ কেটে রাখা হয়, যা ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশ থেকে নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইমের বিজ্ঞাপন থেকে আয় করে, মাসে মাসে গ্রাহক ফি নেয়, বিভিন্ন সেবা বিক্রি করে, তাদের আয়ের মাধ্যম অনেক। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসি গত ১ মে টেক জায়ান্টরা কত আয় করে, তার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে। তাদের হিসাবে, মহামারির মধ্যেও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনের প্রতি মিনিটে আয় ছিল ৮ লাখ ডলারের বেশি। অ্যাপলের আয় সে তুলনায় একটু কম, ৭ লাখ ডলারের মতো ইত্যাদি।
বাংলাদেশে তাদের আয়ের মাধ্যম অনেক যেমন- বিজ্ঞাপন, গ্রাহক ফি, বিভিন্ন সেবা বিক্রি ইত্যাদি। বাংলাদেশে কোনো কোম্পানি এভাবে আয় করলে মুনাফার ওপর সাড়ে ২২ থেকে ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়।
কোনো পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করলে উচ্চ হারে কর দিতে হয়। কিন্তু দেশে উৎপাদন করলে করের হার কম হয়, কর্মসংস্থানের স্বার্থে। কিন্তু নেটফ্লিক্স কোনো ধরনের কর ছাড়াই তার সিনেমা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কোনো আমদানি শুল্ক নেই, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক নেই, অগ্রিম আয়কর কিংবা ভ্যাট নেই। বাংলাদেশে যেসব অনলাইন স্ট্রিমিং উদ্যোগ তৈরি হয়েছে, তারা কিভাবে শত শত কোটি ডলারের কোম্পানি নেটফ্লিক্সের সাথে প্রতিযোগিতায় পারবে! কর আদায়ের ক্ষেত্রে দেশীয়দের মোটামুটি গলা চেপে ধরা হচ্ছে। আর দেশের বাইরে থেকে এ দেশে ব্যবসা করা বহুজাতিক টেক জায়ান্টদের আয়কর দিতে হচ্ছে না। এটা বড় ধরনের বৈষম্য। দেশীয় পণ্যের কাঁচামাল আমদানির সময় অগ্রিম আয়কর কেটে রাখা হয়। লাভ হোক, লোকসান হোক- এই টাকা আয়কর হিসেবেই নিয়ে নেয় সরকার। কিন্তু গুগল, ফেসবুক, নেটফ্লিক্সের কাছ থেকে এনবিআর কিন্তু অগ্রিম আয়কর কেটে রাখে না।
সবাই নানা ফন্দি করে কর ফাঁকি দেন, ধরাও পড়েন না। এসব অর্থের বড় অংশ অন্য দেশে পাচার হয়, আর কালো টাকা অবাধে সাদা করার সুযোগ তো থাকেই। ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয় ও অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মধ্যে পার্থক্য থাকা উচিত। বাংলাদেশের রীতি হচ্ছে, যারা নিয়ম মেনে কর দেন, তাদের ওপর চাপ বাড়তেই থাকে। যারা দেন না, তারা আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়ে দেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো অগ্রাধিকার খাত নেই। পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন কিছু নেই। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির প্রতি ‘আচ্ছন্ন’ না থেকে করোনা সঙ্কট উত্তরণে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষাসহ অগ্রাধিকারভিত্তিক বরাদ্দ দিতে হবে।
বিকাশমান অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে শিল্পকারখানা। এটি প্রায় স্বীকৃত যে সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানই প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা কিভাবে হবে, বাজেটে বলা হয়নি। নানা কারণেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে প্রায় এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে।
এ ছাড়া গত প্রায় দেড় বছরে অনেক সরকারি প্রকল্পে ধীরগতি দেখা গেছে। তাই শুধু টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নেও নজর রাখতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক