আরেকটি ভয়ঙ্কর অপরাধ ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এবার উত্তর ভারতের উন্নাওতে ধর্ষণের শিকার ২৩ বছর বয়সী এক নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। গত মার্চ মাসে উত্তর প্রদেশে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন সেই নারী। সে মামলার শুনানিতে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন।
সেই নারী একটি হাসপাতালে সংকটজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকার সময় শুক্রবার মারা যান। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ পাঁচজনকে আটক করেছে, যাদের মধ্যে দুজন মেয়েটিকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত।
ঠিক এক সপ্তাহ আগে আরেক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। সে ঘটনা পুরো ভারতজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে। দক্ষিণের হায়দ্রাবাদ শহরে ২৭ বছর বয়সী এক প্রাণী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।
তার পুড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধারের পর বিচারের দাবিতে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হয়। এ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করা হয়। কিন্তু অভিযুক্তদের যখন ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তারা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র চুরির চেষ্টা করে বলে পুলিশ বলছে। ফলে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় কর্মকর্তারা বলছেন।
কিন্তু ধর্ষণের এই দুটো ঘটনা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। গত এক সপ্তাহে আরো পাঁচটি ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ভয়ের মধ্যে বসবাস
ভারতে নারী ধর্ষণ এবং নারীদের প্রতি সহিংসতা এখনো অনেক বেশি। ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীরা বলছেন, তারা একটি ভয়ের পরিবেশে বসবাস করছেন।
এছাড়া বাস্তবতার সাথে তাদের আপোষ করতে হয়। তাদের সবসময় শুনতে হয় – নিজেকে রক্ষা করে চলো, ঠিকমতো পোশাক পরিধান কর, একা ঘরের বাইরে যাবেনা অথবা বাসায় থাকো।
ভারতের সমাজ গভীরভাবে পিতৃতান্ত্রিক। ধর্ষণ কিংবা যৌন সহিংসতার জন্য নারীদের দায়ী করার বিষয়টি ভারতের সমাজে নতুন কোন বিষয় নয়। খাটো স্কার্ট কিংবা জিন্স পরা, ছেলে-বন্ধু থাকা, রাতে দেরিতে বাসায় ফেরা অথবা মোবাইল ফোনে কথা বলা – এসব বিষয়ের জন্য ঘটনার শিকার নারীদের লজ্জা দেয়া হয়।
ভারতের আইনে ধর্ষণের শাস্তি কী?
২০১২ সালে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়। এর ফলে ধর্ষণ বিরোধী কঠিন আইন প্রণয়ন করতে সরকার বাধ্য হয়। অ্যাসিড আক্রমণ এবং রাস্তায় উত্যক্ত করার মতো ঘটনার জন্য শাস্তি বাড়ানো হয়।
নতুন আইনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি বাড়িয়েছে। তবে ধর্ষণের অভিযোগে একাধিকবার অভিযুক্ত হওয়া অথবা ধর্ষণের কারণে কোমায় চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আইন তাদের কতটা সাহায্য করছে?
ভালো খবর হচ্ছে , যৌন সহিংসতার বিষয়ে মামলা করার জন্য নারীরা আগের চেয়ে বেশি এগিয়ে আসছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বলছে, ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ২১,৪৬৭, কিন্তু ২০১৬ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮০০০।
কিন্তু নারীরা এখনো এসব ঘটনার মামলা করতে গিয়ে এবং বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মামলা করতে থানায় গেলে কিংবা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে গেলে এখনো তারা অবমাননার মুখে পড়েন।
মামলা নথিবদ্ধ হলে তার কি বিচার পান?
ভারতের বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব আছে। কিছু-কিছু হাই প্রোফাইল মামলায় আসামীরা অবাধে ঘুরছে। বিচারের ক্ষেত্রে দেরি হয়। প্রতি চারটি ধর্ষণ মামলার একটিতে সাজা হয়। যেসব মামলা সমাপ্তির দিকে যায় সেখানে এই হার রয়েছে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে পুলিশের কাছে ধর্ষণের যত অভিযোগ এসেছে তার মধ্যে ১২% থেকে ২০% মামলা সমাপ্তির দিকে গেছে।
ধর্ষণের শিকার অনেক নারী এখনো বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে। গত বছর সরকার জানিয়েছে যে জমে থাকা ধর্ষণের মামলার বিচার শেষ করার জন্য ভারতজুড়ে ১০০০ দ্রুত বিচার আদালত স্থাপন করা হবে।
যৌন সহিংসতার হার কি কমছে?
ভারতে নারীদের প্রতি সহিংসতা কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গত বছর থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন এক রিপোর্টে বলেছে যে নারীদের জন্য ভারত সবচেয়ে বিপদজনক দেশ।
এক্ষেত্রে আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং সৌদি আরবের চেয়েও ভারত এগিয়ে। সদ্য প্রকাশিত সরকারের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে ভারতে ৩৩,৬৫৮ টি ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে, প্রতিদিন ৯২টি। তবে একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে ভারতে ধর্ষণের বহু ঘটনা থানা পর্যন্ত আসেনা।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতা বাড়ছে। সরকারের অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতা দ্বিগুণ হয়েছে।
অনেক মনে করেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং নারী-পুরুষ অনুপাতের বৈষম্যের কারণে নারীদের প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।
ছেলে শিশুর আশায় গর্ভপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, ১১২টি ছেলে শিশুর বিপরীতে ১০০টি মেয়ে শিশু জন্ম নিচ্ছে। উত্তরের হরিয়ানা রাজ্যে সবচেয়ে বেশি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এখানে নারী-পুরুষ অনুপাত ভারতের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে।
অনেকে মনে করেন, ভারতের চলচ্চিত্রে নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে নারীদের সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মে।
ভারতে বিবিসির নারী বিষয়ক সংবাদদাতা দিভিয়া আরিয়া বলেন, বলিউড এবং আঞ্চলিক সিনেমায় নারী উত্যক্তকারীদের ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া বিষাক্ত পুরুষত্বকে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়ে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ভিকটিমরা কি বিচার পায়?
শুক্রবার মারা যাওয়া ২৩ বছর বয়সী সে নারীর শরীর ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। পুলিশ কর্মকর্তা প্রাভিন কুমার বলেন, এই ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং বিচার হবে।
এর পরদিন হায়দ্রাবাদ শহরে একটি আন্ডার পাসে আরেক নারীর লাশ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার বিচারের দাবিতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে।
ইতোমধ্যে, অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জনের মা বলেছেন, তাদের সন্তান যদি দোষী হয় তাহলে তাদের বিচার হোক।
কিন্তু এখন আপাতত ভিকটিমের পরিবার নিজেদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছে। বাড়ির সামনে একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে, ‘কোন রাজনীতিবিদ নয়, মিডিয়া নয়, পুলিশ নয়, বহিরাগত নয়।’
এর পরিবর্তে তারা চান অপরাধীদের শাস্তি। বিবিসি।