অভিবাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এইডস ঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষ করে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মের সন্ধানে যান তাদের মাধ্যমে বেশি এইডস ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে কোনো মানুষ অন্য দেশে যেতে চাইলে এইচআইভিসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া সে দেশে গমনের প্রবেশাধিকার মেলে না। কিন্তু দেশে ফেরত প্রবাসী ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা নেই। এ প্রেক্ষাপটে আর্ন্তজাতিক অর্থায়ন, সরকারি-বেসরকারি অর্থায়ন বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের এইডস আক্রান্তের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি চিকিৎসা নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সেভ দ্য চিলড্রেন-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দেশে এসে এইডসের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। ফলে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ১৯৬ জনকে এইচআইভি পজেটিভ সনাক্ত করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৫২৬ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করে ১৪৩ জনের পজেটিভ ধরা পড়েছে। যাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৪ জনের এআরভি দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় প্রতিবছর গড়ে ৭ লাখ মানুষের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ রোগ-ব্যাধি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও দেশে ফেরা অভিবাসীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাৎক্ষণিক কোনো পদ্ধতি বা ব্যবস্থা নেই। আবার দেশে ফেরত অভিবাসীদের সম্পর্কে জানতে সরকারিভাবে তথ্য-উপাত্তের কোনো সঠিক ডাটাবেইজ নেই।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে কর্মরত অসংখ্য নারী গৃহকর্মী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছে। নির্যাতিত ওইসব নারীদের অনেকের শরীরেই এইডসের জীবাণু প্রবেশ করলেও সামাজিকতা ও লোক-লজ্জার ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। আবার প্রান্তিক পর্যায়ে এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সিলিং, এআরটি ম্যানেজম্যান্ট, রেকর্ড কিপিং ও রিপোর্টিং বিষয়ক প্রশিক্ষণ নাই। এসব কারণে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে এইচআইভি নির্মূল ঘোষণার বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল এইডস এসটিডি সংশ্লিষ্টদের দাবি বর্তমানে এইডস আক্রান্তদের অনুমিত হিসাব প্রায় ১৪ হাজার হলেও সরকারিভাবে রোগটির সনাক্ত ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া পুরোদমে চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশের মতো রোগী সনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে ৭৫ ভাগ রোগীকে চিকিৎসা আওতার মধ্যে আনা হয়েছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে এইচআইভি নির্মূল করতে ৯০, ৯০, ৯০ পদ্ধতিতে সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা আওতায় আনা হচ্ছে।
এইডস এসটিডির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) ডা. ফুয়াদ আব্দুল হামিদ বলেন, বিদেশ ফেরত কর্মীদেরকে কিভাবে সনাক্ত ও এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে দুটি আলোচনাসভা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত সিলেটের কানাইঘাটে প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প শুরু করা হয়েছে। পাশাপাশি ৬টি এআরটি সেন্টার ১০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। আর বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের ডায়াগনোসি করে ৩০ শতাংশ এইডস আক্রান্তের হার কমে ২৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় এইডস এসটিডির নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক ডা. মো. আমিনুল ইসলাম মিঞা বলেন, বন্দর বা ইমিগ্রেশন সেন্টারে এইচআইভি সনাক্তকরণ করাটা জটিল প্রক্রিয়া। তবে দেশে আসার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে কিভাবে স্ক্রিনিং আওতায় আনা যায় সে ব্যাপারে কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সনাক্তের প্রক্রিয়া চলছে। বিদেশে পাঠানোর পূর্বে গামকা ও জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরো কর্তৃক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সতর্ক করা হচ্ছে।
ন্যাশনাল এইডস এসটিডির লাইন ডিরেক্টর ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, বিশ্বের কোথাও অভিবাসী ও পর্যটকদের এইচআভি সনাক্তে বিমান বা স্থলবন্দরে এ ব্যবস্থা নাই। তবে দেশে জাতিসংঘ মিশন ফেরত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এই পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের মাধ্যমে তাদের পরিবার-পরিজন আক্রান্ত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নানা পদ্ধতিতে তাদের সনাক্তকরণ ও কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। সিলেটের কানাইঘাটে প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা, এন্টিনেটাল চেকআপ, ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষার মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া অভিবাসী জনগোষ্ঠীকে সংক্রমণ ব্যাধিসহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে প্রবাসী কল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র (পাসপোর্ট বিভাগ) ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে এসব রোগের উপর পাঠদান করা হচ্ছে। বিমানবন্দরগুলোতে লিফলেট ব্যানারে মাধ্যমে সতর্ক করা হচ্ছে।