মহামারী করোনা ভাইরাসের কশাঘাতে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। আঘাত লেগেছে দেশের অর্থনীতিতেও। কিন্তু এই দুঃসময়ে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রপ্তানির পালে হাওয়া দিয়েছে তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে রপ্তানি আয় বেড়েছে। লকডাউনের মধ্যে পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্তই রপ্তানি বাড়ার মূল কারণ বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের অনেকটাই ছিল দেশে লকডাউন। শুরুতে কিছুটা এদিক-সেদিক হলেও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ফলে সাহস নিয়ে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা কারখানা চালু রাখেন। পাশাপাশি ক্রেতাদের ভেড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেন। ফলে পোশাক রপ্তানি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে থাকে। এর সুফল পেয়েছে দেশের পুরো অর্থনীতি।
২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়ই কেটেছে করোনা ভাইরাসের কশাঘাতে। তার পরও রপ্তানি খাত থেকে ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৩ লাখ (৩৮.৭৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার। তবে এ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বছরটিতে ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসাবেই প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এদিকে একক মাস হিসেবে সদ্য সমাপ্ত জুনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে ৩৫৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার আয় করে। মে মাসে এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩১১ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৪৬ কোটি ডলার।
রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ৬৭ লাখ (৩১.৪৫ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
গেল অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৬৯৬ কোটি ডলারের। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ২১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৪৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। এ খাতে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা কমেছে।
বাংলাদেশের রপ্তানিকারক শিল্পমালিকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, লকডাউনের সময়ে পোশাক কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানির ধারা অব্যাহত রয়েছে। শুধু লকডাউনের সময়ে কারখানা খোলা রাখার ফসল। অর্থনীতি সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোয় করোনার প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করায় চাহিদা বেড়ে রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইপিবির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করে বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের এই খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। একই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
করোনাকালে পাট রপ্তানিতে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ ছাড়া ওষুধ রপ্তানিতে ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তবে অন্য খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ধস নেমেছে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি খাতে। গত অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার আয় করে। রপ্তানির এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৩৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার।
এদিকে কৃষিপণ্য রপ্তানিও বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন কৃষিপণ্য রপ্তানি করে ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি।