ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় দুটি উৎসবকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা বলা হলেও আমরা বাঙালিরা এ দুটো উৎসবকে রোজার ঈদ ও কুরবানির ঈদ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ছোটবেলায় কোনো কিছু না বুঝেই রোজা ও কুরবানি ঈদের মধ্যে কোন ঈদে বেশি আনন্দ, তা তুলনা করার চেষ্টা করতাম।
এ নিয়ে ওইটুকুন বয়সে ভাইবোন এবং বন্ধুদের সঙ্গে তর্কেও জড়িয়ে যেতাম। এক মাস কষ্ট করে রোজা রাখার পর যখন ঈদ আসে, তখন রোজার ঈদেই আনন্দ বেশি বলে অনেকে যুক্তি দিতাম। আবার কেউ কেউ গরু কুরবানি হয় বলে কুরবানি ঈদেই বেশি আনন্দ বলে দাবি করতাম। এসবই ছিল আমাদের অপরিপক্ব বয়সের এক ধরনের ছেলেমানুষি।
তবে ব্যক্তিগতভাবে কুরবানি ঈদই ছিল আমার বেশি পছন্দের। এর মূল কারণ ছিল ‘লাল্লু’ ও ‘কাল্লু’। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এ আবার কী? লাল্লু ও কাল্লু আর কিছু নয়-কুরবানির গরুর নাম। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি-হাট থেকে আমাদের বাড়িতে এক ঈদে লাল রঙের গরু কিনে আনছে; তো পরের ঈদে কালো রঙের গরু আসছে। তারও পরের ঈদে হয়তো কাকতালীয়ভাবে লাল গরু কেনা হচ্ছে। লাল গরুকে লাল্লু বলে ডাকতাম আর কালোকে কাল্লু।
জন্ম থেকে ঢাকার আরামবাগে বড় হয়েছি। বাসার সবচেয়ে নিকটবর্তী গরুর হাট ছিল তখন কমলাপুর। আমাদের বাসা থেকে পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটা পথ। আরামবাগ-কমলাপুর এলাকায় তখনো বেশ গ্রাম্য পরিবেশ ছিল। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা বেশ প্রশস্ত ও প্রচুর গাছপালায় ভরা ছিল। এখনকার মতো ইট-সুরকির কঠিন জীবন তখন ছিল না।
আরামবাগের পাশে এখন যে ক্লাবপাড়া, সেখানে ছিল বেশ চওড়া ঝিল। সারা বছর পানিতে টলমল করত। আরামবাগ-ফকিরাপুলের পাশ দিয়ে যে কালভার্ট রোড চলে গেছে, সেটি ছিল বেশ বড় খাল, যা কমলাপুরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে মিশেছিল। ছোটবেলায় এ ঝিলেই আমরা সাঁতার শিখেছি। আমার মনে আছে, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার নানাবাড়ি থেকে আম-কাঁঠালের মৌসুমে অনেক আম-কাঁঠাল, বস্তা ভরা মুড়ি ও পিঠা নিয়ে আরামবাগের বাড়ির পশ্চিমে খালে বাঁধানো ঘাটে নৌকা এসে ভিড়ত। নৌ চলাচল সহজ ছিল বলেই গ্রামাঞ্চল থেকে বড় বড় নৌকায় প্রচুর গরু আসত তখন কমলাপুর গরুর হাটে।
বড়রা যখন কুরবানির গরু কিনতে যেতেন, আমরাও তাদের সঙ্গে গরুর হাটে যেতাম। একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমাদের এলাকায় তখন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল খুব কম পরিবারই ছিল। কাজেই এককভাবে গরু কুরবানি দেওয়ার মতো পরিবারের সংখ্যাও ছিল কম। অধিকাংশ পরিবারই যৌথভাবে কুরবানি দিত। এভাবে কুরবানি দেওয়াকে আমরা শরিকে কুরবানি দেওয়া বলতাম। এ কাতারে আমাদের পরিবারও ছিল। আমাদের শরিকের অন্যরাও গরু কিনতে সঙ্গে যেতেন। গরু কেনা হয়ে গেলে সেকি আনন্দ-হৈচৈ। বড়রা গরু কিনেই এলাকায় চলে আসতেন; আর আমরা ছোটরা রীতিমতো মিছিলের মতো হৈচৈ করে গরু নিয়ে মহল্লায় ঢুকতাম।
গরু কেনা হয়ে গেলে হাট থেকে রঙিন কাগজের মালা কিনে গরুর গলায় পরিয়ে দেওয়া হতো। গরুর শিং ঘিরেও পাটের তৈরি নানা রঙের ছোট্ট মালা পরানো হতো। আমাদের চেয়ে বয়সে বড় যারা, তারা হাট থেকে গরুর দড়ি ধরে মহল্লায় রওনা হতেন; আর আমরা ছোটরা পেছনে পেছনে স্লোগান দিতে দিতে তাদের অনুসরণ করতাম। গরুর গায়ের রং লাল হোক, কী কালো হোক-আমাদের স্লোগান হতো, ‘লাল্লু কাল্লু আ গিয়া, ঈদ মোবাররক হো গিয়া’। মহল্লায় ঢুকে গরু নিয়ে মহল্লার এক মাথা থেকে হেঁটে হেঁটে অন্য মাথা পর্যন্ত মিছিল করে যেতাম। পাড়ার সবাইকে দেখানো হয়ে গেলে তারপর আমাদের শরিকের কারও বাসার উঠানে গরুটিকে বেঁধে রাখা হতো।
এরপর কুরবানির শরিক পরিবারের মহিলাদের গরু দেখার পালা। তখন মনে হতো, আমাদের কুরবানির পাঁচ-সাতটি শরিক পরিবারের মিলনমেলা বসেছে। এভাবেই আনন্দঘন পরিবেশে কুরবানির ঈদ উদযাপন করতাম। ছোটবেলার ঈদের সেই আনন্দময় মুহূর্তগুলো আজও যেন আমাকে তাড়িত করে। কুরবানি এ ঈদ উৎসব আমাদের জীবনে একটি বড় উৎসব। এ উৎসব শুধু ধর্মীয় নির্দেশ পালনের জন্যই নয়; এটি এখন আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে গেছে।
সেই ছোটবেলায় কুরবানির গরু নিয়ে যখন মেতে থাকতাম, তখন কুরবানির মাহাত্ম্য কী-তা জানা ছিল না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা সম্পর্কে যত জেনেছি, ততই যেন অবাক হয়েছি। কুরবানির পেছনে যে এত বড় আত্মত্যাগ ও বিসর্জন সম্পৃক্ত, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তখন। ওই বয়সে ধর্মের অনেক প্রসঙ্গ সম্পর্কেই আমাদের জ্ঞানের সীমা নির্দিষ্ট ছিল। একদিন আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমরা কুরবানি দেই কেন?
উত্তরে তিনি বেশ সহজ ও সুন্দর করে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য হজরত ইব্রাহীম (আ.) তার সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)কে বিসর্জনের ঘটনা বুঝিয়ে বলেছিলেন। উল্লেখ্য, আমার পিতা মরহুম মো. মফিজুদ্দীন ইসলাম ধর্ম নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন এবং ধর্ম সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখতেন। তখন বেশি কিছু না বুঝলেও পরে অনুভব করেছি-আল্লাহ্কে দেওয়া পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ওয়াদা রক্ষার জন্য চৌদ্দ বছরের তরুণ হজরত ইসমাঈল (আ.) নিজেকে সমর্পণ করে ঈমান ও আত্মত্যাগের যে মহান উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন, তা সত্যিই অতুলনীয়।
আমরা এককভাবে কুরবানি না দিয়ে সাত শরিকে কুরবানি দিচ্ছি কেন-জিজ্ঞেস করায় আমার পিতা সহিহ মুসলিম শরিফের একটি হাদিস উল্লেখ করে বলেছিলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাত ভাগে কুরবানি করেছেন। হজরত জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহুতায়ালা বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সঙ্গে হজ সমাপন করি। আমরা সাত শরিকে একটি করে উট কুরবানি করেছি। (মুসলিম শরিফ, হাদিস-৩০৭৮)।
আমার বাবা তার অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কথা না বললেও সাত শরিকে কুরবানি দেওয়ার মাহাত্ম্য হিসাবে বলেছিলেন, সাতজনে মিলে কেনাকাটা থেকে শুরু করে কুরবানির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। তিনি আরও বলেছিলেন, এভাবেই আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা ও তার সন্তুষ্টির জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ওই সময় শরিকে কুরবানি দেওয়া আমি বেশ উপভোগ করতাম। কারণ, সাত শরিকের সমবয়সিরা হৈচৈ করে যে রকমভাবে আনন্দ ভাগাভাগি করে ঈদ উদযাপন করেছি; পরে এককভাবে কুরবানি দিলেও ছোটবেলার সেই আনন্দ আর অনুভব করিনি।
কুরবানি একটি আরবি শব্দ। আরবি ‘কুরবানুন কুরবুন’ শব্দ থেকে কুরবানি শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ উৎসর্গ, বিসর্জন, ত্যাগ ইত্যাদি। কুরবানি আমাদের ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য তারই নামে নিয়মমাফিক হালাল পশু জবেহ করাই হলো কুরবানি। এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহীম (আ.) তার প্রিয়তম সন্তান ইসমাঈলকে কুরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন।
মহান আল্লাহর কৃপায় ইসমাঈলের পরিবর্তে একটি পশু কুরবানি হয়ে গেলেও হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর এই সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমা তুলে ধরাই কুরবানি ঈদের প্রধান মর্মবাণী। কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার একত্ববাদকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কুরবানির মাধ্যমে মানুষের ভেতর বিরাজমান পশুত্বকেও কুরবানি দেওয়া হয়। কুরবানি পালনের মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে আত্মসমর্পণের স্পৃহা জাগ্রত হয় এবং মানুষ আত্মোৎসর্গের চেতনায় উজ্জীবিত হয়।
কুরবানির মধ্য দিয়ে ত্যাগ ও বিসর্জনের যে কথা বলা হয়েছে, বর্তমানে আমরা সেই ত্যাগের আদর্শে কতটুকু উদ্বুদ্ধ? মানুষের অর্থবল ও ভোগবাদী মানসিকতার কাছে কুরবানির বিধান কতটা পালিত হচ্ছে? সমাজের পয়সাওয়ালা আমরা অনেকেই ত্যাগের সেই আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে শুধু পশুকেই বেছে নিয়েছি। বর্তমানে কে কত বড় গরু কুরবানি দিল, সেটিই যেন আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এ ধরনের বাহাদুরি জাহির করার মানসিকতা নিয়ে গরু কুরবানি দিলে তা কুরবানি হিসাবে কবুল হবে না; নিছক পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা হবে মাত্র।
আবার শরিকে যখন কুরবানি দেওয়া হয়, তখন অনেককেই দেখা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত একজনকে কুরবানির ভাগের অর্থ দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করেন এবং কুরবানি শেষে মাংস সংগ্রহ করে বিতরণের মাঝেই কুরবানি শেষ করেন। কুরবানি ঈদ শুধু আত্মত্যাগ ও বিসর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ঈদ উৎসবও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কারণ, কুরবানি ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো-পশু কুরবানির মাংস আল্লাহর বিধান অনুযায়ী গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণের মাধ্যমে সবাই মিলে একসঙ্গে ঈদ উদযাপন করা। ঈদ উৎসবের এটিই হলো অন্যতম বিধান।
আমাদের বাল্যকালে কুরবানি ঈদ ঘিরে যে আনন্দ-উৎসব দেখেছি, মানুষের মধ্যে কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর বিধান পালনের যে চেষ্টা দেখেছি, বর্তমানে অনেকের মাঝে তার উপস্থিতি কম দেখি। আগেই বলেছি, কুরবানির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, নিজের ভেতরে যে পশুশক্তি লুকিয়ে আছে, তা বিসর্জন দিয়ে আত্মঅহংকার বা আত্মগরিমা বর্জন করা।
কুরবানির পশু জবাই দিতে গিয়ে আমিত্বকে জাহির না করে কুরবানির আত্মত্যাগ ও আত্মনিবেদনের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে কুরবানির কোনো বিধিবিধানই পালন হবে না।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা