প্রযুক্তির অনেক নেতিবাচক দিক থাকলেও চূড়ান্ত বিচারে তা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এখন আমাদের প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে ইন্টারনেট ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইন্টারনেটের ব্যবহার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ই-কমার্স বা ইলেক্ট্রনিক বাণিজ্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষ এক কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। পেশাগত উন্নয়ন ও উৎকর্ষের স্বার্থে তাদের এই বিনোদনহীন অবিরাম ছুটে চলা। কোনো ধরনের কথা বলার ফুরসত নেই। এ প্রতিযোগিতার শেষ কবে ও কোথায় মানুষ তা জানে না। মানুষের এখন আর পাতার পর পাতা অসাধারণ সব চিঠি লেখার সময় নেই, ই-মেইল বা এসএমএসের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। যে কোনো পেশাদার অভিভাবককে কিছু বলতে গেলেই এখন বলেন, ‘তোমার কথা শোনার সময় নেই।’ কথাই যদি শোনার সময় না থাকে, তাহলে বাজার-সদাই করবেন কখন? মানুষের এই ছুটে চলাকে অধিকতর কার্যকর করতে চাই ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’।
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তার বিরাট ভূমিকা থাকে। অর্থনীতির যে তিনটি মৌলিক সমস্যা- কী উৎপাদন, কীভাবে উৎপাদন এবং কার জন্য উৎপাদন- এ তিনটিরই সমাধান করে থাকে ব্যক্তি। মানুষ যে নিজ নিজ কাজে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তা কেউ কেউ খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন। তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন, কোনো পণ্য ও সেবা ক্রয়ের জন্য প্রচলিত যে বাজারব্যবস্থা তা যথেষ্ট নয়। প্রচলিত বাজার বা শপিংমলে গিয়ে পণ্য ক্রয় করা অনেকের কাছেই বিড়ম্বনা মনে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবহণ ও যোগাযোগব্যবস্থা। কর্মব্যস্ত মানুষের এ সমস্যাটা কোনো কোনো উদ্যোক্তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন এবং এর সমাধান হিসাবে উদ্ভাবন করেছেন ই-কমার্স। পৃথিবীকে মুঠোর মধ্যে এনে দিয়েছে আমাজন, আলিবাবা, দারাজের মতো অনলাইন বাণিজ্যিক কোম্পানি। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই পণ্য যার যার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে প্রস্তুতকৃত যে কোনো পণ্য নির্ধারিত দামে অর্ডার করলে তা ঘরে বসেই পাওয়া যায়। জীবনকে গতিশীল করা কিংবা গতিশীল জীবনকে অধিকতর গতি দেওয়ার জন্যই ই-কমার্স। লাখ লাখ কর্মী এখন এই উপখাতটিতে কাজ করছেন, এক ধরনের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
কর্মসংস্থানের কথাই যখন এলো তখন বলতে হয়, বাংলাদেশে মোট কর্মজীবীর সংখ্যা ৬ কোটি ৮০ লাখ (করোনা-পূর্ব সময়ে)। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১৩ লাখ ৭৫ হাজার। যেসব সরকারি পদ শূন্য আছে তা ধরা হলেও ১৬ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি নয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সরকারিভাবে আমাদের কর্মনিয়োজন মোট কর্মজীবীর একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আমরা যতই সরকারের কাছে কর্ম দাবি করি না কেন, সরকার সেদিকে খুব একটা গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না। আমাদের চাওয়া, তা যত সাংবিধানিকই হোক না কেন, তার সঙ্গে সরকারের ধরন-বৈশিষ্ট্যের একটা পার্থক্য আছে। আমাদের শাসকগোষ্ঠীর মূল পরামর্শক হলো বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি, যারা সব সময়ই সরকারি কার্যপরিধিকে সীমিত করতে পরামর্শ দিয়ে থাকে। কর্মসংস্থানের একটি কার্যকর ক্ষেত্র হলো বিনিয়োগ। আমাদের মোট দেশজ বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। এর ৭৬ শতাংশই হলো বেসরকারি। আর যদি এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মানি, তাহলে মানতেই হবে যে এদেশে কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের বিষয়টি এখন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে। সুতরাং সরকার যে কোনো ব্যক্তিগত উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে চায়। ই-কমার্স তেমনই একটি উপখাত।
ই-কমার্সকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে অনলাইনে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা চালু করেছে। এই সুবিধাকে পুঁজি করে দেশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আগেই বলেছি, মানুষের অতিকর্মময় জীবনের চাহিদার নিরিখেই এ অনলাইন বাণিজ্যের অবতারণা। খুব সাধারণভাবেই এর একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি। দেশে করোনা মহামারিকালে অনলাইন বাণিজ্য অনেকটাই বেড়েছে। করোনা-পূর্বকালে এর ৮০ শতাংশ কাজই পরিচালিত হতো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে। কিন্তু তা এখন দেশের প্রায় সব শহরেই ছড়িয়ে পড়েছে। ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই অনলাইন কার্যক্রম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে ই-কমার্স খাতের আকার ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। উদ্যোক্তারা বলছেন, এ খাতের প্রবৃদ্ধি ৭৫ শতাংশেরও বেশি। এ কারণে তারা আশা করছেন, এই প্রবৃদ্ধির হার বজায় থাকলে ২০২৩ সাল নাগাদ এ খাতের আকার দাঁড়াবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এটা অমূলক ধারণা নয়। কারণ কম্পিউটার, সেলফোন, মুদিপণ্য, ল্যাপটপ, প্রসাধনী, পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছুরই জোগান দিচ্ছে এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে দেশে প্রায় ২ হাজার ৫০০টি ই-কমার্স সাইট তৈরি হয়েছে এবং প্রায় দেড় লাখ ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোগ রয়েছে। সুতরাং এর অগ্রযাত্রা প্রত্যাশা করাই যেতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ই-কমার্সের বেলায় ক্রেতা-বিক্রেতার পরিচয়ের একমাত্র মাধ্যম হলো ইন্টারনেট, এখানে সরাসরি কারও সঙ্গে কারও কোনো পরিচয় নেই। সব ধরনের পেমেন্ট হয় অনলাইনে। সেক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাস হলো একমাত্র পুঁজি। এর কোনো ধরনের ব্যত্যয় এ ধরনের বাণিজ্যকে ক্ষতি করবে। সাম্প্রতিক একটি অপ্রত্যাশিত খবর আমাদের ই-কমার্সের প্রতি আস্থা হারানোর কারণ হতে পারে। একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুদক প্রায় ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যেহেতু অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটির তদন্তকাজ চলছে, তাই প্রতিষ্ঠানটির নাম উল্লেখ করলাম না।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতি অভিযোগ তুলেছেন ভোক্তা এবং প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলো। ভোক্তারা বলছেন, পণ্যের টাকা পরিশোধ করা সত্ত্বেও তারা নির্ধারিত পণ্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য সরবরাহকারীরা বলছে, কোম্পানি তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করছে না। অর্থাৎ দুদিক থেকেই অভিযোগ- প্রতিষ্ঠানটি অর্থ আত্মসাৎ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের ১৪ মে নিবন্ধন পেয়ে কার্যক্রম শুরু করে একই বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে। পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ মাত্র ৫০ হাজার টাকা আর অনুমোদিত মূলধন মাত্র ৫ লাখ টাকা। খুব অল্প সাধ্য নিয়ে, অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা বিক্রয় মূল্যের বিপরীতে সরকারকে কর দিয়েছে মাত্র ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যে পণ্য তারা বিক্রি করে তার অর্ডার পায় গড়ে প্রতি মাসে ১০ লাখ। দেখা গেছে, প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। তাদের প্রধান প্রধান পণ্যের মধ্যে আছে- মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন ইত্যাদি। কেন এত অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠানটি এতটা সফলতা পেল, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রথমত ও প্রধানত চোখে পড়ে আকর্ষণীয় অফার। তারা এক ধরনের ‘ভাউচার’ নামক পদ্ধতি চালু করে, যা দিয়ে পণ্য সংগ্রহ করা যেত। সেখানে ৩০০ শতাংশ থেকে ১৫০ শতাংশ, তা থেকে ১০০ শতাংশ এবং সর্বশেষ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতারা বিপুলভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। কোনো ক্রেতাই ভাবেনি এই ক্যাশব্যাক দিতে হলে অন্যের পকেট হাতড়ে দিতে হবে। আবার অপরকে দেওয়ার বেলাতেও পকেট কেটেই দিতে হবে। তাদের অফারে ক্রেতারা হামলে পড়েছে। দেখা গেছে, পণ্য আছে মাত্র ১০টি, কিন্তু ক্রেতার কাছে এই সংখ্যার সঠিক তথ্য না থাকায় সেই পণ্যের জন্য অর্থ জমা দিয়েছেন ১ হাজার জন। ব্যস ১০ জনকে ১০টি দেওয়ার পর বাদবাকি ৯৯০ জনের টাকা প্রতিষ্ঠানের হাতে জমা থাকল, কেউ কেউ বলেন ‘ফরএভার’। এ টাকার বিনিময়ে আদৌ ঘোষিত পণ্য পাবেন কিনা তা তাদের জানা নেই। ভোক্তাদের যন্ত্রণা ও বঞ্চনাটা এখানেই। সমস্যাটা গুরুতর হওয়ার আগে থেকেই মনিটর করা উচিত ছিল। সরকারের উপর মহল থেকে অনেক কঠোর বাণী শুনি, কিন্তু কোনো কোনো খাতে কার্যত কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, তারা ভোক্তাদের এক পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য সরবরাহ করে। আবার পণ্যের অর্ডার করে প্রতারণার শিকারও হয়েছেন অনেকে। আমরা যখনই কোনো আলোর মুখ দেখি, সঙ্গে সঙ্গেই তা অন্ধকারে ঢেকে যায়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, প্রশাসন কোথাও কোনো সুখবর নেই। দুর্নীতি আর অর্থ আত্মসাৎকারীরা যেন আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এই চক্র থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। এক পদ্মা সেতুর গর্বেই আমাদের বুকফাটা অবস্থা। কয়েক ডজন পদ্মা সেতু যে আমাদের কালো টাকার মালিক ও অর্থ পাচারকারীরা গিলে ফেলেছে, তা নিয়ে এক মুহূর্তও ভাবি না। ই-কমার্স আমাদের জীবনে সচল রাখতেই প্রচলিত হয়েছে। এর উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা অনেক। এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করেছে, এখন থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহের পর দাম পাবে। গ্রাহক থেকে সংগ্রহ করা অর্থে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো মার্চেন্টের দায় পরিশোধ ছাড়া অন্য কাজে খাটাতে পারবে না। এই লেনদেন নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতা করবে ব্যাংক, এমএফএস বা ই-ওয়ালেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতেও পণ্য বেচাকেনা অব্যাহত থাকবে। বাড়তি চার্জ ছাড়াই এসব সেবা দিতে হবে। এমন নির্দেশনা আগে দেওয়া হলে অনেক ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেত।
ই-কমার্সের জটিলতা নিরসনকল্পে গত ৪ জুলাই একটি নির্দেশিকা জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে বাস করলে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে এবং ভিন্ন শহর হলে এ সময়সীমা অনধিক ১০ দিন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিক্রেতা তার প্রতিশ্রুতি না রাখলে সেক্ষেত্রে কী হবে? আশা করি, সরকার বিষয়টি অধিকতর মনোযোগের সঙ্গে দেখবে। মানুষের সময় বাঁচাতে, বিড়ম্বনা এড়াতে এবং কর্মসংস্থানের তাগিদে ই-কমার্সকে রক্ষা করতে হবে।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়