কয়েক মাস ধরে দেশে করোনার প্রকোপ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। কোরবানির ঈদ পালনের সুবিধার্থে ১৫ থেকে ২২ জুলাই এই আট দিন বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। ঈদ-উত্তর ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় গোটা দেশ। উদ্দেশ্য করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা। তবে করোনা নিয়ন্ত্রণের মোক্ষম দাওয়াই এখন টিকা দেয়া। কিন্তু আমরা এখনো সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে পারিনি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও মন্দাভাব চলছে। তারপরও জীবন-জীবিকার প্রশ্নে জীবনের প্রাধান্য অগ্রাধিকার পাবে, এটিই স্বাভাবিক। এ বিবেচনায় দেশে ফের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। ৫ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কঠোর বিধিনিষেধ আরো বাড়াতে চায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। সব কিছুর পরও বিবেচনায় নেয়া জরুরি, করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও কিভাবে দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখা যায় এবং কম ক্ষতি হয়। মানুষের জীবিকা কিভাবে টিকে থাকে। খেটেখাওয়া মানুষ কাজ হারিয়ে যাতে উপার্জনহীন হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন না করে। খেয়াল রাখতে হবে, দেশের উন্নয়নের গতি যেন শ্লথ হয়ে না পড়ে। বিশেষ করে চলমান বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যাতে গতি না হারায়।
আজ সকাল ৬টা থেকে পোশাকসহ সব রফতানিমুখী শিল্পকারখানাকে বিধিনিষেধের আওতামুক্ত ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত শুক্রবার বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো: জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল ব্যবসায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সাথে বৈঠক করে যত দ্রুত সম্ভব শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার অনুরোধ জানান। তার এক দিন পরই রফতানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দিলো সরকার।
সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক, এবারের বিধিনিষেধে বেশির ভাগ শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ১৩ জুলাই সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি জানানো হয়। তবে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঈদের বন্ধ শুরু আগের দিন অর্থাৎ ১৯ জুলাই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট ও সরকারি অর্থায়নে চলমান গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরই সরবরাহকারীদের নির্মাণ উপকরণ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে চিঠি দেয়া শুরু হয় বিভিন্ন প্রকল্প কার্যালয় থেকে। মুশকিল হচ্ছে, ভারী শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় প্রকল্পের কাজের নির্মাণ উপকরণ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়া। বিশেষ করে সিমেন্টের মতো নির্মাণ উপকরণ উৎপাদনের পর দ্রুত ব্যবহার করতে হয়। বর্তমানে সিমেন্ট কারখানা বন্ধ থাকায় প্রকল্পে দ্রুত সরবরাহ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় সিমেন্ট সরবরাহ বিঘœ হলে বড় প্রকল্প কাজের গতি কমবে।
বড় প্রকল্পগুলো নির্মাণকাজে পাথর, ইস্পাত, সিমেন্টসহ নানা উপকরণ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে পাথর আমদানি করেই প্রকল্পে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে রড ও সিমেন্ট দেশে উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সিমেন্ট ব্যবহারের সুফল পেতে উৎপাদনের এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা হয়। এখন সিমেন্টসহ প্রকল্পের প্রয়োজনীয় নির্মাণ উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে কারখানা চালু রাখতে হবে।
সিমেন্ট ও ইস্পাত খাতের মালিকপক্ষ সূত্রে জানা যায়, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজ চালু রাখার কথা বলা হলেও সেসব প্রকল্পে উপকরণ সরবরাহকারী কারখানা চালু রাখার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। অথচ বিভিন্ন প্রকল্প কার্যালয় থেকে পণ্য সরবরাহের তাগিদ দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, গত ২৪ জুলাই থেকেই পণ্য সরবরাহকারীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দেয়া আরম্ভ করেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদাররা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের আলাদা আলাদা চিঠিতে এসব প্রকল্পের উপকরণ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বলা হয়। এই দুই শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করেন, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখতে একটি নীতিমালা দরকার, যাতে কঠোর বিধিনিষেধেও প্রকল্পের কাজ ব্যাহত না হয়। কারণ প্রকল্প কাজের গতি হারালে তা বাস্তবায়নে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। আবার কারখানা বন্ধ করলে ফের চালু করতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
সরকার বৃহৎ প্রকল্পের কাজ চালু রেখে এক দিকে সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রী উৎপাদনকারীদের যথাযথভাবে সরবরাহের জন্য বলবে, অন্য দিকে কারখানা চালু না রেখে বন্ধের নির্দেশ দেবে, এটি বৈপরীত্য এবং স্ববিরোধী। রফতানিমুখী কারখানার মতো সঙ্গত কারণে লকডাউনের মধ্যে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত অর্থাৎ গতি ঠিক রাখতে বাস্তবতার আলোকে সিমেন্টসহ ভারী শিল্পকারখানাগুলো কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি থাকতে হবে; যাতে কোনো কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মানার বেলায় গাফিলতি না করে।
tafazzalh59@gmail.com