রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৪ অপরাহ্ন

সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিচার

ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৯ আগস্ট, ২০২১
  • ১৫৩ বার

পয়লা আগস্টে মেজর (অব:) সিনহা হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হলো। দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ হত্যাকাণ্ড নাগরিকদের সামনে বেশ কিছু বিষয় উন্মোচন করেছিল। কথিত ক্রসফায়ারের পেছনের ‘ন্যারেটিভ’, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অবৈধ অর্থ-উপার্জনের প্রক্রিয়া, স্বেচ্ছাচারিতা ও নৃশংসতা ইত্যাদি অনেক কিছুই প্রকাশিত হয় টেকনাফ থানায় কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ঘটনার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে সরকার দ্রুত আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে র‌্যাব চার মাস ১০ দিন সময়ের মধ্যেই তদন্ত সম্পন্ন করে গত ১২ ডিসেম্বর চার্জশিট দাখিল করেছে। আদালতে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করি, দ্রুতই ন্যায়বিচার সম্পন্ন হবে। তবে এখানে তৎকালীন ওসি প্রদীপ এবং এসআই লিয়াকত মূল আসামি হলেও তাদের ‘কাটআউট’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। হাই-ভোল্টেজ এ ঘটনার পেছনের শক্তিশালী কুশীলবরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন বলে অনেকেই মনে করছেন।

প্রদীপ কুমার দাশ ও নন্দদুলাল রক্ষিতের পক্ষে কক্সবাজার আদালতে গত ৯ জুন জামিনের আবেদন করা হয়। আসামিপক্ষে দেশের এক প্রথিতযশা আইনজীবী এবং একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা ওই দুই আসামির জামিন আবেদন করেছেন। তিনি দাবি করেন, প্রদীপ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয় এবং ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে’ বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপের জামিন আবেদন করেছেন। তবে আদালত ওই আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। আর ১ নং আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত এই মামলা অবৈধ বলে তা বাতিলের আর্জি করলে তা-ও আদালতে নাকচ হয়ে যায়। এরই মধ্যে মূল আসামি প্রদীপ কুমার দাশকে গত ৮ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার কারাগারে নেয়া হয়। শুরু হলেও এ বিচার কার্যক্রমের গতি অত্যন্ত ধীর বলে মনে হচ্ছে। কেননা, গত ১৩ ডিসেম্বর চার্জশিট দাখিল করা হলেও মূল বিচারকার্যক্রম এখনো তেমন গতি পায়নি। অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারকার্যক্রম শুরুর জন্য ছয়-সাত মাস খুব বেশি সময় না হলেও মামলার স্পর্শকাতরতা ও চাঞ্চল্য এর আরো বেশি গতির দাবি রাখে।

একজন মেধাবী, স্মার্ট ও সজ্জন ব্যক্তি মেজর (অব:) সিনহা তার ‘জাস্ট গো’ নামক প্রামাণ্য ভ্রমণচিত্র তৈরি করতে কয়েকজন সহযোগীসহ মাসখানেক টেকনাফে অবস্থান করার সুবাদে স্থানীয় জনগণের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে। সেখানেই তিনি ওসি প্রদীপের অপরাধ জগতের সন্ধান পান এবং এ ব্যাপারে তথ্যচিত্র তৈরির মানসে প্রদীপের সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রস্তাব দেন। এর পরই মেজর (অব:) সিনহাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। মধ্য জুলাইয়ে থানায় বসে পরিকল্পনা করে সুযোগের অপেক্ষায় থেকে ৩১ জুলাই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। টেকনাফ দেশের সীমান্ত এবং ইয়াবা কালোবাজারিদের সবচেয়ে বড় করিডোর। এখানে প্রদীপের মতো একজন অসৎ অফিসারকে ওসি হিসেবে পদায়ন করা কতটুকু যুক্তিগ্রাহ্য? এর আগে প্রদীপকে একাধিকবার অনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে সাময়িক বরখাস্ত ও স্ট্যান্ড রিলিজের রেকর্ড রয়েছে বলে জানা যায়। তার ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই বছর ওসি থাকার সময়ে ৪৮টি বন্দুকযুদ্ধে মোট ৮৭ জন মানুষ টেকনাফে নিহত হয়েছিল (ডেইলি স্টার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০)। এর আগেও ২০১৭ সালে মহেশখালী থানার ওসি থাকার সময় টাকার বিনিময়ে আবদুস সাত্তার নামক এক লবণচাষিকে হত্যা করেছিলেন বলে তার স্ত্রী হামিদা বেগমের অভিযোগ রয়েছে। আর স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা ওসি প্রদীপের মাদক কারবারের খবর প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ প্রদীপ কর্তৃক রোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

র‌্যাবের দেয়া তথ্য মতে, ‘ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে টেকনাফে ইয়াবাকেন্দ্রিক ব্যবসায় ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আছে। সাধারণ মানুষ তার কাছে ছিল অসহায়। তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ছিল’ (প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০)। জানা যায়, তার সাড়ে সাত লাখ টাকা মূল্যের ব্যক্তিগত ওয়াল্টার পিস্তল তিনি ২০-৩০ বার ক্রসফায়ারে ব্যবহার করেছেন। উপজেলা শহরে তার অলিখিত আইন ছিল, “You pay, you live, you bargain or you don’t pay- you mysteriously die in a gunfight” (ডেইলি স্টার, ৪ অক্টোবর ২০২০)।

র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, মেজর (অব:) সিনহা তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন : ওসি প্রদীপ বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আন্তসীমান্ত ইয়াবা ব্যবসায় ব্যবহার করছিলেন, যার দৈনিক মূল্যমান ছিল প্রায় ৫০ লাখ টাকা (প্রাগুক্ত, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০)। ইতোমধ্যে দুদক ওসি প্রদীপের স্ত্রী চুমকির দুই কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পেয়েছে (প্রথম আলো, ২৮ জুলাই ২০২১)। অন্যদিকে তদন্ত প্রতিবেদনে কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি এ বি এম মাসুদের বিরুদ্ধে ওসি প্রদীপের বিষয়ে উদাসীনতা, তত্ত্ববধান না করা ইত্যাদি দায়িত্বহীনতা এবং পেশাদারিত্ব প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে। তবে এই উদাসীনতা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, তা প্রশ্নাতীত নয়।
ঘটনার পরপরই ওসি প্রদীপের সাথে তার ফাঁসকৃত ফোনালাপ এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড প্রশ্নের উদ্রেক করেছিল। ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই কক্সবাজারের স্থানীয় একটি সংগঠনকে সংবাদ সম্মেলন করে এসপি মাসুদের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা যায়। দেশের দু’টি স্থানে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত সিনহার সহযোগী শিপ্রা দেবনাথের বেশ কিছু ব্যক্তিগত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করেছেন। এমনকি, বাদিপক্ষের আইনজীবী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা এক ব্রিফিংয়ে জানান, ‘এসপি মহোদয় মামলার তদন্তকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেই চলছেন’ (প্রাগুক্ত, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০)। আবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও সিনহা হত্যাকাণ্ডের সাথে এসপি মাসুদের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায় (প্রাগুক্ত, ৮ অক্টোবর ২০২০)। অন্য দিকে রিমান্ডে থাকাবস্থায় ওসি প্রদীপ ফেসবুক লাইভে এসে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। তিনি কিভাবে লাইভে আসার সুযোগ পেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রদীপ কোনো একটি বিদেশী দূতাবাসের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতেন বলে জানা যায়। তাছাড়া প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল তদন্ত কমিটি (প্রাগুক্ত, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)। আসলে সব মিলে প্রশ্ন উঠতেই পারে- ওসি প্রদীপ গং কি শুধুই ‘ফুটসোলজার’ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে নাকি তাদের পেছনে আরো কোনো কুশীলব রয়েছে? ওসি প্রদীপ কি এখানে পুরো ঘটনার ‘কাটআউট’ হিসেবে ভ‚মিকা রেখেছেন? দেশে ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিষয়টি উন্মোচন করা দরকার। আমাদের দেশের মানুষ কক্সবাজারের একজন ইয়াবা সম্রাট সম্পর্কে জানে। স¤প্রতি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইয়াবা করিডোর রৌমারী সীমান্তের ইয়াবা চোরাচালানিদের সাথে কুড়িগ্রামের একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে (ডেইলি স্টার, ১৭ জুলাই ২০২১)।

আমাদের বিশ্বাস, মেজর (অব:) সিনহা হত্যাকাণ্ডের সুবিচার হবে। তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা হতাশাব্যঞ্জক হবে। মেজর (অব:) সিনহা স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এসে দেশের রূপ সৌন্দর্যকে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিতে অন্য এক দেশপ্রেমের যুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা, স্বার্থ আর অর্থবৈভবের নৈরাজ্যের বিষবাষ্পে তিনি নিহত হলেন। তার আত্মদানে দেশে ক্রসফায়ার অপসংস্কৃতির মূলে সজোরে আঘাত লেগেছিল। আর তার কালো সানগ্লাস পরা ছবিটি ‘চে গুয়েভারার’ মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। উঠেছিল অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে। তবে এই বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মাঠপর্যায়ের অপরাধীদের পেছনের অপরাধীদের চেহারা উন্মোচন করতে পারলেই মেজর (অব:) সিনহার আত্মদান সার্থক হতে পারে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com