বহু পুরনো কথা—‘কানু বিনে গীত নেই’। আর এখন মাস দুই ধরে বাংলাদেশে এই ধারায় বলতে হচ্ছে : ‘পেঁয়াজ বিনে খবর নেই’। কথাটা পুরোপুরি ঠিক হলো না, কথার কথা বা অর্ধসত্যের মতো। কানু বিনেও গীত আছে, আর পেঁয়াজ বিনেও খবর আছে। তবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা এবং এর কথকতার ব্যাপকতা বিচারেই এ ধরনের কাব্য-পঙিক্তর উদ্ভব, আমাদেরও খবরের শিরোনাম।
পেঁয়াজের বাজারে সত্যি সত্যি এমন আগুনই লেগেছে যে কিছুতেই এর দাম স্বাভাবিক হচ্ছে না। সরকার অনেক চেষ্টায়ও সিন্ডিকেটকে পেঁয়াজের ব্যাপারে বাগে আনতে পারছে না, এমন অসহায়তার প্রকাশ সরকারি মহলেও। এই অসহায়তার প্রকাশ কৃষিমন্ত্রীর বয়ানেও। তিনি বলেছেন : ‘পেঁয়াজ নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার’।
তাঁর উদ্বেগের কারণ অবশ্য একটু ভিন্ন। পেঁয়াজের বাজারে আগুন লেগেছে দেখে কৃষক জমি থেকে কচি কচি পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করে দিচ্ছে, এগুলোকে বড় হওয়ার সময় দিচ্ছে না। স্বভাবতই আগামী দিনগুলোতেও পেঁয়াজের ঘাটতি লেগে থাকবে। তখন পেঁয়াজের বাজার পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে যাবে, এর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে যাবে বৃহৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে। তারাই পেঁয়াজের মূল্য নির্ধারণ করবে, সরকারের আপাতদৃষ্টিতে কিছুই করার থাকবে না।
তাই সবজিবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী উল্লিখিত উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি এমন অসহায় মন্তব্যও করেন : ‘এ অবস্থায় জানুয়ারি মাসে কী উপায় হবে?’ কৃষকের অসহিষ্ণুতা, অত্যধিক দামের আশায় এই যুক্তিহীন আচরণ। সময়মতো বড় হওয়া পেঁয়াজের বাজারও যে ঊর্ধ্বমুখী থাকবে—এমনটা ভরসা করতে পারছে না কৃষক। তাই ভবিষ্যৎ পেঁয়াজ বাজারের জন্য তৈরি হচ্ছে আবার নৈরাজ্যের আশঙ্কা।
দুই.
শুধু শাসনযন্ত্র বা শাসক মহলই নয়, গোটা সংবাদপত্র মহলও পেঁয়াজের দাম নিয়ে দিশাহারা। আড়াই মাস হয়ে গেল, যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, তবু পেঁয়াজের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তদের রান্নাঘরেও আগুন। আশা ছিল, পেঁয়াজ আসছে, নিশ্চয়ই দাম কমবে। কিন্তু সেই যে তিনি আড়াই শ টাকার ডালে চড়ে বসে আছেন, সেখান থেকে কিছুতেই নামছেন না। নামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
তিন.
কিছুদিন আগে যখন শুল্ক বিভাগের গোয়েন্দারা পেঁয়াজ অনুসন্ধানে এবং এর রহস্য উন্মোচনে মাঠে নামেন, তখন দৈনিকগুলোতে ফলাও করে এজাতীয় খবর ছাপা হয়েছে, আমাদের প্রত্যাশা ছিল এবার কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, মূল্যহ্রাস অবশ্যই ঘটবে, বিশেষ করে যখন তাঁরা আমদানিকারকদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন।
কিন্তু না, সব প্রত্যাশায় পানি ঢেলে দিয়ে পেঁয়াজ আগের দামেই স্থির। কী অর্জন করলেন এনবিআরের গোয়েন্দারা, তাঁরাই জানেন। তাঁদের বক্তব্যের ভিত্তিতে দৈনিকের খবরে যে আশাবাদ সঞ্চারিত হয়েছিল, সবই ছাইচাপা পড়ে গেছে।
এখন নতুন করে কাগজের বাণীতে হতাশার সুর : ‘পেঁয়াজ কারসাজিতে ব্যবসায়ীরা’/আমদানি খরচ ৪২, খুচরায় দাম ২৫০ টাকা’। এ কী তুঘলকি নৈরাজ্য। জাপানি আগ্রাসনের ভয়ে দিশাহারা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বঙ্গে ইংরেজ শাসনের নীতির সুযোগে মজুদদার ব্যবসায়ীরা চালের দাম মগডালে চড়িয়ে বাংলায় কয়েক লাখ দরিদ্র গ্রামবাসীর মৃত্যু ঘটিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মৃত্যু না ঘটলেও মূল্যবৃদ্ধির হার তুল্যমূল্য। পেঁয়াজ না খেলে মানুষ মরে না, তবে রান্নাঘরের চাপে অন্যায্যভাবে পকেট খালি হয়।
তাই ওই প্রতিবেদনে (৪.১২.২০১৯) লেখা হয়েছে : ‘স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পেঁয়াজের বাজারে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে। আর নৈরাজ্যের নেপথ্যে খোদ ব্যবসায়ীরা। চাহিদা ও জোগান সমান হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পেঁয়াজের বাজার অস্থির করে তুলেছে ব্যবসায়ীরা।’ চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বজায় থাকলে অর্থনীতির নিয়মে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটার কথা নয়।
কিন্তু বাংলাদেশের পণ্যবাজারে, বিশেষত খাদ্যপণ্যের বাজারে এই অস্বাভাবিক ঘটনাই স্বাভাবিক সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদকের মতে, ‘সরকারের পক্ষে অভিযানের কথা বলা হলেও ব্যবসায়ীরা এর কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না।…দেশি পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।’
অন্যদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ‘আমদানি করা দামের তুলনায় বহুগুণ বেশি দামে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ বিক্রি করছে অতিমাত্রায় মুনাফার লোভে। এরা মানবিক মূল্যবোধহীন।’
এসব দার্শনিক উক্তিতে পেঁয়াজের দাম যেমন কমবে না, তেমনি ভুক্তভোগীদের মানসিক ও আর্থিক যন্ত্রণারও লাঘব হবে না। আশ্চর্য যে শুধু বাণিজ্যমন্ত্রীই নন, এনবিআর চেয়ারম্যান থেকে অনেকে একই ধরনের কথা বলে চলেছেন। সবারই অভিযোগের তীর বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের দিকে। কিন্তু সে তীর ব্যবসায়ীদের বর্মে লেগে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। একটি দৈনিকে লিখছে, ‘বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার’/‘দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই’। ‘টিসিবির মূল্য তালিকার সঙ্গে খোলাবাজারের দামের ব্যাপক পার্থক্য’। এককথায় বলতে গোটা ভোগ্যপণ্যের বাজারে চরম নিয়ন্ত্রণহীন নৈরাজ্য। বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র, সব শ্রেণির ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারে ভোক্তাদের ঠকিয়ে কামিয়ে নিচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো শাসনদণ্ড নেই।
মন্ত্রী থেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সবাই ভোগ্যপণ্য বাজারের বেসামাল অবস্থা নিয়ে হা-হুতাশ করছেন, কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীদের অস্বাভাবিক মুনাফাবাজির বিরুদ্ধে। কেউ বা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হুমকি বা সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন।
যেমন এক অনুষ্ঠানে মহানগর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী পেঁয়াজ নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বলেছেন : ‘যেকোনো মূল্যে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত প্রতিহত করা হবে। তাদের বলছি, দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবেন না’ ইত্যাদি। এসব কথায় ব্যবসায়ীরা কান দিচ্ছে বলে মনে হয় না।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ভিন্নমাত্রায় একই রকম। কারণ তারা এর মধ্যে নিদারুণ অভিজ্ঞতায় বুঝে নিয়েছেন, যে যা-ই বলুন, ভোগ্যপণ্যের বাজার ব্যবসায়ীদেরই নিয়ন্ত্রণে, সরকারের নয়। তাই তারা তাদের মতো করে সমস্যার মোকাবেলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তাতে ভোগান্তির একশেষ। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের।
প্রতিবেদনের দু-একটি ঘটনার দৃশ্যচিত্রে বোঝা যাবে, ভোক্তাসাধারণ মানুষ পেঁয়াজ নিয়ে কী অবস্থায় আছে। টিসিবির ট্রাক কখন আসবে সেই অপেক্ষায় খিলগাঁও-রামপুরা বাজারের সামনে নিম্ন আয়ের মানুষের বিশাল লাইন, অন্তহীন তাদের অপেক্ষা। ট্রাক এলো, হুড়মুড় অবস্থা। এরই মধ্যে পেঁয়াজ শেষ। লাইনে দাঁড়িয়েও দীর্ঘ অপেক্ষার পর পণ্য না পেয়ে হতাশ মানুষের কেউ কেউ খালি হাতে ঘরে ফিরছে।
বিক্ষোভে-আন্দোলনে অভ্যস্ত বাংলাদেশের মানুষ। দুর্বোধ্য কারণে এ দেশের প্রতিবাদী মানুষ এখন ব্যবসায়ীদের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে মনের জ্বালা মেটাচ্ছে, এমনই সংবাদ একটি দৈনিক পত্রিকার পাতায়।
আমাদের প্রশ্ন : পেঁয়াজ নিয়ে এত ‘কারসাজির’ পর কর্তৃপক্ষ বা রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীদের এতসব বক্তব্যের পরও ব্যবসায়ীরা যে পেঁয়াজ নিয়ে অনড় অবস্থানে, সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তির মুখে তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
মুনাফাবাজ মজুদদারদের নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের অসাধু কাজকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কি এতই কঠিন? পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও এর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কমিয়ে আনা কি অসম্ভব ঘটনা? কেন এত অসহায় অবস্থা সরকারের। এ প্রশ্নটিরই জবাব খুঁজে ফিরছি।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী