২০ বছর পর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানের ফিরে আসার মধ্যে কিছুটা নাটকীয়তা ছিল। এ মাসের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আভাস ছিল, আগামী ৯০ দিনের মধ্যে তালেবানরা কাবুলের দখল নিতে পারে। সেই ৯০ দিনের ঘটনা ঘটল মাত্র ৩ দিনে। পালিয়ে গেলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট; পালিয়ে গেলেন দেশটির প্রধান সেনাপতি। তালেবানরা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। বরং তালেবানের ভয়ে মানুষের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ২০ বছরের শাসনব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রতিরোধে। তালেবানের এ সাফল্যকে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা ভাবা ঠিক হবে না। ২০০১ সালে মার্কিন ও মিত্রদের আক্রমণের মুখে তালেবান সরকার ও তাদের নেতা মোল্লা ওমরের পতন ঘটেছিল বটে; কিন্তু তালেবানকে নির্মূল করা যায়নি। রাজধানীর বাইরে একটি বড় মাত্রায় তাদের উপস্থিতি ছিল।
আফগানিস্তানের তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১০ বছর পর ২০১১ সালের এক তথ্যে দেখা যায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল আফগানিস্তানের ১২১ জেলার মধ্যে মাত্র ২৯টি। এর মানে হলো, প্রায় ৬৫ শতাংশ জেলাই ছিল তালেবানের দখলে। সাধারণ মানুষের বাইরে কেবল মার্কিন সৈন্য দ্বারা টিকে থাকতে চেয়েছিল কাবুল সরকার। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু সরকারের আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় এবং হয়েছেও তাই। অনেক বিশ্লেষক, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট রাজনীতিকরাও মনে করেন, এত তড়িঘড়ি সৈন্য প্রত্যাহার করে জো বাইডেন ঠিক করেননি। আরেকটু সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। এর বিপরীতে জো বাইডেন সরাসরিই বলেছেন, মার্কিন সেনারা আরও ৫ বছর আফগানিস্তানে থাকলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হতো না। আফগান সেনাবাহিনী বেতনের বিনিময়ে মার্কিনিদের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে লড়াই করার মতো মানসিকতা তারা অর্জন করতে পারেনি।
বাইডেনের কথার যুক্তিটি উপেক্ষা করার মতো নয়। যুদ্ধে জড়িয়ে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থ। আফগান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি ডলার (১ ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরলে বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা দাঁড়ায় প্রায় ৬৮ লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের চলতি বাজেটের ১০ গুণেরও বেশি)। বিপরীতে কী পেয়েছে তারা, তা বিশ্ব জানে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি নিষ্ফল যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট আফগান সরকারগুলো কখনোই জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করেনি; রাজনীতিতে কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ আনতে পারেনি। তাই পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
২০ বছর আগের কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। সে সময় মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন সরকারকে আমরা অনেকেই একটি রক্ষণশীল কিংবা বলা চলে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল শাসন পদ্ধতি হিসাবে চিহ্নিত করেছিলাম। সে কারণে মানবাধিকারের প্রশ্নে তালেবানদের অনেকে পছন্দ করতেন না, বিশেষ করে নারী অধিকার রক্ষা ও বিকাশের স্বার্থে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আফগান দখলদারিত্ব মূলত এই রক্ষণশীল মানসিকতার বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল আল কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেন ও তার সংগঠনের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে একটি ঘৃণ্য হামলার জন্য লাদেন ও আল কায়দাকে দায়ী করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে ৯/১১ নামে পরিচিতি পায়। তখন লাদেনের অবস্থান ছিল আফগানিস্তানে; তিনি ছিলেন মোল্লা ওমরের বিশেষ অতিথি। আফগানিস্তানে থেকেই লাদেন বিশ্বব্যাপী তার কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ হিসাবে লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মোল্লা ওমরকে অনুরোধ করে। কিন্তু মোল্লা ওমর তাতে রাজি না হওয়ায় আফগানিস্তানে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং তালেবানদের রাজনৈতিক দর্শনভিত্তি কী তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা ছিল না, ছিল আল কায়দার নেটওয়ার্ক নিয়ে। সেটা যেহেতু তারা ধ্বংস করতে পেরেছে, তাই আর আফগানিস্তান নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই এবং এটাকে একটি প্রতিদানহীন ব্যয় বলে ভাবছে। তবে হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের আফগান সিদ্ধান্তের একটি বড় নেতিবাচক প্রভাব হলো আস্থাহীনতা। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তা পালনের সক্ষমতা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা বাড়বে।
তালেবানদের পুনরায় ক্ষমতা দখল যে প্রশ্নটিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে তা হলো, তাদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীর অতীতে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল তার পরিবর্তন হবে কিনা কিংবা হলে কতটা পরিবর্তন হবে? সোজাসুজি যে মন্তব্য করা যায় তা হলো, সারা বিশ্বে ইসলামী জঙ্গিবাদ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আবারও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৌলবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। এই সোজাসুজি উত্তরের পেছনে কাজ করছে আল কায়দা ও তালেবানদের অভিন্ন চোখে দেখা। কিন্তু এভাবে দেখাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। মতাদর্শগত দিক দিয়ে বা ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে তালেবান ও আল কায়দা অভিন্ন হলেও প্রায়োগিক দিক থেকে তাদের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে। তালেবানরা চায় একটি ইসলামি শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম করতে। এ লক্ষ্যটি শুধুই আফগানিস্তানকে ঘিরে এবং তা আফগান সীমানার বাইরে সম্প্রসারিত করার কোনো অভিলাষ তাদের নেই। অন্যদিকে আল কায়দার কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী। যে কোনো দেশ কিংবা সম্প্রদায়কে তারা নিজেদের শত্রু জ্ঞান করে এবং সে অনুযায়ী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। তাদের কোনো জাতীয়তার প্রশ্ন নেই, ভৌগোলিক সীমানা নেই, সীমান্তবিহীন একটি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সে অর্থে বলা যায়, তালেবানদের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো দেশের ক্ষুদ্র জঙ্গিগোষ্ঠী উৎসাহিত হলেও তা কোনো ফলদায়ক প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে তালেবানরা তাদের সন্ত্রাসী তকমা ঘুচাতে পারবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক ফাওয়াজ এ জর্জেসের বক্তব্য হলো-‘এখন আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সূতিকাগার হতে পারে এমন ধারণাকে বিশ্বের একেবারে অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না। আবার তালেবানের ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে এমন আশঙ্কায় স্থির থাকাও উচিত হবে না। আফগানিস্তান থেকে পালাতে সাধারণ আফগান নাগরিকরা যেভাবে মরিয়া হয়ে বিমানে উঠেছে এবং সেই ছবি যেভাবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তা দেখে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের সহযোগী সাধারণ আফগানদের বিপদের মুখে ফেলে চলে গেছে। এ অবস্থায় তালেবানরা যদি সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা দেখিয়ে সর্বস্তরের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে, তাহলে হয়তো তাদের গা থেকে সন্ত্রাসী তকমা মুছতে পারে।’ তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, যে সংগঠনটি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি বিশ্বাস ও সংস্কৃতি লালন করে এসেছে এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে, তারা রাতারাতি কোনো বড় মাপে পরিবর্তিত হতে পারবে কিনা কিংবা হবে কিনা।
গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে চলেছে ক্ষমতা দখলের লড়াই। কখনো বিদেশিদের বিরুদ্ধে, কখনোবা দেশি শাসকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কথা কেউ ভাবার ফুরসত পায়নি। তাই আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিক থেকে দেশটি পৃথিবীর মাপকাঠিতে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়াতেও অনেকখানি পিছিয়ে। মানব উন্নয়ন সূচকের যে কয়টি নির্দেশক আছে তার সব কটিতেই দেশটির অবস্থা দুর্বল। মাথাপিছু আয় মাত্র ৫৮৮ ডলার, বাংলাদেশে যা ২২০০ ডলারেরও বেশি। শিক্ষার অবস্থা আরও খারাপ। সার্বিক সাক্ষরতার হার মাত্র ৫৩ শতাংশ। নারীদের বেলায় তা আরও নাজুক। মোট নারীর মাত্র ২৯ শতাংশের সাক্ষরজ্ঞান আছে, যে হার বাংলাদেশে প্রায় ৭২ শতাংশ। প্রত্যাশিত গড় আয়ুও তুলনামূলক কম, মাত্র ৬৪ বছর; বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭৩ বছর। এই আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তালেবানদের মতো রক্ষণশীল মানসিকতার একটি সংগঠন কতখানি সফল হবে, তা নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই। প্রশ্ন আছে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে তালেবানদের সক্ষমতা নিয়েও। তাই বলা যায়, আফগান সাধারণ নাগরিকদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যেই থেকে গেল।
বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত? এ দেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয় ২০ বছর আগে। অর্থাৎ মোল্লা ওমরের পতনের পর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বর্তমান সময়ে আফগানিস্তানে আমাদের দেশের এনজিও ব্র্যাকের একটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। আমাদের দেখতে হবে এর প্রতি তালেবানদের দৃষ্টিভঙ্গি কী। কারণ আমাদের যেসব নাগরিক সেখানে কাজ করছেন, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের একটি ক্ষুদ্র অংশই আফগানিস্তানের সঙ্গে হয়। বাংলাদেশ তুলনামূলক কম দামে মানসম্পন্ন ওষুধ রপ্তানি করে থাকে। এর একটি বাজার হলো আফগানিস্তান। সুতরাং বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবকিছু বিবেচনা করে বলা যায়, তালেবানদের স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করা উচিত।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়