করোনা ভাইরাস মহামারীতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে গত এক বছরে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার ২৩টি আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সর্বশেষ গত ঈদুল আজহার আগে আরও ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার পাঁচটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। দুই প্যাকেজে ১ লাখ ৩১ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার ২৮টি প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে বড় উদ্যোক্তাদের জন্য প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রার শতভাগই পূরণ করেছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে অনীহা দেখা গেছে। অথচ ইতিহাস বলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিলে তার বেশিরভাগই আদায় হয়, বিপরীত চিত্র বড় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে।
জানা গেছে, ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও বেশিরভাগ বড় গ্রাহক তা পরিশোধ করতে পারছেন না। উল্টো এখন ব্যাংকের কাছে বাড়তি সময় চাইছেন তারা। এতে উভয় সংকটে পড়েছে ব্যাংক। একদিকে সময় বাড়িয়ে না দিলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে, এতে বাড়তি প্রভিশন রাখতে গিয়ে কমে যাবে আয়। অপরদিকে, বাড়তি সময় দিলে ঋণ আদায়ের হার কমে যাবে। এতে প্রভাব পড়বে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতার ওপর।
এর পরেও গ্রাহকদের চাপে বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলো এক বছর সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নন অনেক ঋণগ্রহীতা। তারা ঋণ পরিশোধে আরও দুই বছর সময় চাইছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার বাধ্যবাধকতায় এক বছরের বেশি সময় বাড়ানো যাবে না। সব মিলে এখন প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, কিছু কিছু বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঋণ পরিশোধে তাদের অনেকেই তিন বছর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন। তাদের ভাষ্য, ব্যবসা সচল না হওয়ায় তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী এক বছরের বেশি সময় দেওয়া যাবে না। কিন্তু অনেকেই দুই বছর সময় চাইছেন। কোভিড পরিস্থিতি ভালো হলে এ সমস্যা থাকবে না। তবে কোভিড পরিস্থিতি খারাপ হলে এ ক্ষেত্রে চাপ বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বছর এবং চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে শিথিলতা ছিল। করোনার কারণে ব্যবসা মন্দায় সব শ্রেণির ঋণে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপি করা হয়নি। এ সুযোগ পরবর্তীতে জুন মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরেও অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বকেয়া কিস্তির ওপর ২০ শতাংশ এককালীন কেউ পরিশোধ করলে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ওই গ্রাহককে খেলাপি করা হবে না।
এদিকে প্রণোদনার প্যাকেজের নীতিমালা অনুযায়ী চলতি মূলধন জোগান দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ ঋণ এক বছরের জন্য গ্রাহক নিতে পারবেন। আবার এক বছরের মধ্যেই তাকে ফেরত দিতে হবে। এতে গ্রাহক যেমন সুদহারের ওপর ছাড় পাবেন, তেমনি ব্যাংক ছাড়ের অংশটুকু সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পাবে। যেমন- বৃহৎ ও সেবা খাতে গ্রাহক এক বছরের জন্য ঋণ নিলে সুদ হারের ওপর সাড়ে ৪ শতাংশ ছাড় পাবেন। অর্থাৎ ৯ শতাংশ সুদের মধ্যে গ্রাহককে পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ এবং গ্রাহকের পক্ষে সরকার পরিশোধ করবে সাড়ে ৪ শতাংশ। তেমনি ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি ঋণের জন্য গ্রাহককে ৯ শতাংশ সুদের মধ্যে ৪ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে, বাকি ৫ শতাংশ সরকার পরিশোধ করবে। এ সুযোগ এক বছরের জন্য। এক বছরের মধ্যে গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে আর এক বছর সময় বাড়িয়ে দিতে পারবে ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহক সুদের হারের ওপর কোনো ভর্তুকি পাবেন না। এসব বাধ্যবাধকতায় ব্যাংক এক বছরের বেশি সময় বাড়াতে পারছে না।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩১ আগস্টের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতা না থাকলে ব্যাংকগুলোতে আবারও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। সামনে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণ ঠেকাতে অনেক ব্যাংক স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্রাহকদের ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এ থেকে সহসাই মুক্তি মিলবে না বলে ব্যাংকারদের কেউ কেউ জানিয়েছেন। কারণ প্রণোদনার ঋণ নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও।
জানা গেছে, ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণও ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ঋণের সদ্ব্যবহার করেনি কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ, উপরন্তু জালজালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তা ভিন্ন খাতে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। প্রণোদনার ঋণে জালিয়াতি করার অভিযোগ পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়ে ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে নির্দেশ দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল সরকার। এর মধ্যে পাঁচটি প্যাকেজের অগ্রগতি সন্তোষজনক হলেও অপর পাঁচটির অবস্থা নাজুক। তবে এই ১০টি বাদে অন্য ১৩ প্যাকেজের বাস্তবায়ন হার মাঝামাঝি অবস্থায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ৩০ জুনের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে প্রতিবেদনটি। এতে বলা হয়েছে, নাজুক প্যাকেজগুলোর সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, তৈরি পোশাক ও চামড়া শিল্পের দুস্থ শ্রমিক, রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষিজীবী এবং করোনা প্রতিরোধে নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীরা। অপরদিকে, শতভাগ বাস্তবায়নকারী প্যাকেজগুলোর উপকারভোগীরা হলো : রপ্তানিমুখী শিল্প শ্রমিক, রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, করোনায় চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
জানা গেছে, বাস্তবায়নের দিক থেকে নাজুক পাঁচটি প্যাকেজে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত এসব তহবিল থেকে খরচ হয়েছে মাত্র ৮০৪ কোটি টাকা, যা শতকরা হারে গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের বেশি সময় ধরে উল্লিখিত প্যাকেজগুলোর আওতায় বরাদ্দের সিংহভাগ টাকাই খরচ হয়নি। তবে অন্য পাঁচ প্যাকেজ বাস্তবায়নের চিত্র ভিন্ন। এগুলোর বাস্তবায়নের হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতভাগ ছাড়িয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাস্তবায়নের দিক থেকে যে পাঁচটি প্যাকেজের অবস্থা নাজুক, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রপ্তানিমুখী শিল্পকে সহায়তা দিতে প্রাকজাহাজীকরণ পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি। এর আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত এপ্রিল থেকে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ২৯১ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার মাত্র ৫.৮২ শতাংশ।
এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ২ হাজার কোটি টাকার ‘এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম’ প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। জুন পর্যন্ত এ প্যাকেজ থেকে খরচ হয়েছে মাত্র ২৯ কোটি টাকা। পড়ে আছে ১ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার প্রায় দেড় শতাংশ। ‘কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্যাকেজে বরাদ্দ ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত এ থেকে খরচ হয়েছে ৪০৮ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। করোনা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যবীমা এবং জীবনবীমা খাতে বরাদ্দ আছে ৭৫০ কোটি টাকা। এ থেকে জুন পর্যন্ত খরচ হয় ৭০ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অর্থনীতি গতিশীল করতে সরকার এসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। কিন্তু কেন এসব প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে গতি নেই সেগুলো চিহ্নিত করতে শিগগির একটি বৈঠক করা হবে।