সময় খুবই কঠিন তালেবানের জন্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও রাজনৈতিক সংঘাতের ভেতর আফগানিস্তানে সব থেকে জরুরি বিষয় হচ্ছে সরকার গঠন। কিন্তু ১৫ আগস্টে রাজধানী কাবুলের দখল নেওয়ার পরও তালেবান নেতৃত্ব সরকার গঠন করতে পারেনি। তবে সরকার গঠনের জন্য তারা চেষ্টা করছে। কেবল তালেবানই ক্ষমতায় বসবে- এমন সিদ্ধান্ত যদি নেওয়া হতো, তা হলে বেশি সময় লাগত না তাদের। তারা চায় আফগানিস্তানের সব জাতিগোষ্ঠী, উপজাতির রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণমূলক সরকার কায়েম করতে। কারণ জাতিগত বিরোধ ও বিদ্বেষ এতকাল ধরেই আফগানিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। এ পরস্পরবিদ্বেষী জাতিকে একই রাজনৈতিক ও সরকারি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে তাদের ভেতরকার বিরোধের বিষ নির্মূল করতে চায়। ওই প্রয়াসের ফল হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক চিন্তায় এসে ধরা দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো কায়েমের চিন্তা।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরাকে এক তালেবান নেতা বলেছেন, তারা অংশগ্রহণমূলক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে এক ডজন নেতার নাম আলোচিত হচ্ছে। তবে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘একজন আমিরুল মোমেনিন’ থাকবেন। তিনিই ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের নেতৃত্ব দেবেন। ভবিষ্যৎ সরকার গঠন ও মন্ত্রীদের মনোনয়নের জন্য একটি নীতিনির্ধারণী পরিষদ গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই বিচার, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ ও তথ্যমন্ত্রী এবং কাবুলবিষয়ক বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কে বা কারা হবেন- তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মোল্লাহ মোহাম্মদ ওমরের ছেলে মোল্লাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব এরই মধ্যে কান্দাহার থেকে কাবুলে পৌঁছেছেন। আর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোল্লাহ আবদুল গনি বারাদার (ব্রাদারের পশতুন উচ্চারণ) এখানেই আছেন। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ওই পরিষদই কাজগুলো সম্পন্ন করবে বা করছে।
ঠিক এই পর্যায়ে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) খোরাসান শাখা যে বোমা হামলা করেছে, এর খেসারত কতদিন চলবে- এ ব্যাপারে উদ্বেগের শেষ নেই। আমেরিকার ১৩ সেনাসহ এ পর্যন্ত ওই বোমা হামলায় মারা গেছে ১৭০ নিরীহ বেসামরিক মানুষ। নিষিদ্ধ ঘোষিত আইএস কী কারণে নিরীহ মানুষ হত্যার এমন পরিকল্পনা করেছে, তা কেউ বুঝতে পারছেন না। ওইসব মানুষ জান বাঁচাতেই তো বিমানবন্দরের দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল। কিন্তু তারা বাঁচতে পারেননি। এই হত্যার বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, হামলাকারীদের ক্ষমা করা হবে না। তাদের ওপর মার্কিন হামলাও শুরু হয়েছে ড্রোনের মাধ্যমে। খুবই ক্রুশিয়াল এই সময় যদি পার করেত সমর্থ হয় তালেবান, তা হলেই বোঝা যাবে তাদের মাথা কতটা বুদ্ধি ও বিবেচনায় পূর্ণ।
তবে কাবুলের দখল নেওয়ার পর থেকেই তালেবান নেতারা যে সামরিক সহনশীলতা এবং জনগণের প্রতি উদার ও মানবিক দৃষ্টি দিয়ে তাদের ভীতিকে নিরসন করেছে, তাদের জানমাল রক্ষা এবং সামাজিক পরিবেশ শান্ত করার কৌশল নিয়েছে- এতেই প্রমাণ হয়, তারা পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। সমন্বয়ধর্মী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোর ভেতর দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের শক্তি সংহত করছে তালেবান। সমাজে অস্থিতিশীলতা যাতে না হয়, সব জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের নিয়ে গঠিত সর্বোচ্চ পরিষদ ওই নমুনাই আমাদের দেখিয়েছে। এটি তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রাথমিক বিজয় বলে ধরে নেওয়া যায়।
সবন্বয় চিন্তা ও বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে তালেবানের রাজনৈতিক প্রধান মোল্লাহ আবদুল গনি যে প্রথম থেকেই সজাগ ছিলেন, তা আমরা দেখেছি কাবুল পতনের পর তার বক্তব্য থেকে। তিনি বলেছিলেন, জনগণকে সেবা দিয়েই তালেবানকে প্রমাণ করতে হবে- তারা বিজয় অর্জন করেছেন। বিজয়কে সংহত করতেই যে তিনি তাজিক, উজবেক, তুর্কমেন, আইমাক, বালুচ, পাশাই, নুরস্তিনি, গুজ্জর, আরব, ব্রাহুই, কিজিলবাস, পামিরি, কিরগিজ, সাদাত, হাজারাসহ ছোট-বড় সব আদি জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতির প্রতিনিধিত্ব সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদে রেখেছেন এবং তারা আগামী সরকার কায়েমের কঠিন পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন- সেটি বুঝতে হবে।
প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের এ বিশাল দেশটির প্রতিটি অংশ একই রাজনৈতিক ঐক্যে পৌঁছানোর সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েম। আর ওই কথিত সরকার পরিচালনায় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ যে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সামাজিক দায়িত্ব-কর্তৃত্ব পালনে বুদ্ধি এবং বিবেচনা কাজে লাগাচ্ছে, তাও আমরা দেখতে চাই। প্রথম পদক্ষেপটি ভালো বলা যেতে পারে। কারণ তারা সংকট থেকে উত্তরণে এ প্রয়াসটিকে বিবেচনা করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে চোখ রাখছে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশ থেকে চলে গেছে তাদের সামরিক পাখা গুটিয়ে। কিন্তু অর্থনৈতিক পাখাটি সচল থাকবেই।
রাশিয়া ও চীন রাজনৈতিক পাইপলাইনে আছে দেশ পুনর্গঠনের সহযোগ দেওয়ার জন্য। তাদের সবারই লক্ষ্য আফগানিস্তানের খনিজসম্পদের দিকে। আমেরিকান কোম্পানি ইউনোকল সরাসরি বলেছে, তাদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা পাওয়া যাবে তালেবানের কাছে থেকে। খনিজসম্পদ উত্তোলনে ইউনোকল যে কথা বলেছে, এর পেছনে আছে আমেরিকান প্রশাসনেরই ইঙ্গিত। ওই প্রশাসন ডোনাল্ড ট্রাম্পেরই হোক বা হোক জো বাইডেনের। অন্য শক্তিগুলো যে বাঘের মতো ছপ্পন ধরে আছে, তা বলাই বাহুল্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আফগানিস্তানে তালেবানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিল। যদি সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম হয়, সেটি তো রাজনৈতিক পরিভাষায় গণতান্ত্রিক না হলেও কার্যক্রমে রয়েছে গণতন্ত্রায়নেরই ধারা¯্রােত তা হলে ইইউ ফিরে আসবেই, এটি আমার ধারণা। তবে ইইউয়ের বক্তব্যের জবাব দিয়েছে রাশিয়া এই বলে যে, তালেবান নিজেদের শাসন পদ্ধতি তারাই বিবেচনা করবেন। তারা কারও চাপিয়ে দেওয়া নীতি কায়েম করবেন না। ইইউ চেয়েছে আফগানিস্তানে গণতন্ত্র কায়েম হোক।
বোমা, রক্তপাত, বিদ্বেষ, বিরোধ, মতের মিল-অমিল ইত্যাদি কমবেশি থাকবেই। কারণ মানুষের চাওয়ার যেমন শেষ নেই, তেমনি তাকে কেন্দ্র করে বেরিয়ে আসবে নতুন নতুন চাহিদা। ওই পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোয় আমরা দেখতে পাব। তবে আমরা দেখতে চাই, রক্ত¯œাত আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ যেন আর ওই নগ্ন-নিষ্ঠুর জাতিগত বিরোধের অন্ধকূপে আটকে না থাকে। আজকের পৃথিবীতে যে গতি ও প্রগতির ধারা চলছে, সেটিকে বহন করার দায়িত্ব তো আফগানিস্তানেরও রয়েছে। এই চলমান পৃথিবীর পথে তারাও শামিল হোক-এটিই আমাদের প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, অতীতের মুজাহিদিন এবং পরে পরিবর্তিত নাম তালেবানের ২০ বছরের সামরিক ও রাজনৈতিক জীবনের অবসান হলো। এখন তাদের দায়িত্ব জাতি গঠনের কঠোর ও কঠিন কাজ। ওই কাজে তারা সফল হোকÑ এ প্রত্যাশা শান্তিকামী পৃথিবীর সাধারণ মানুষের।
ড. মাহবুব হাসান : কবি ও সাংবাদিক