রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৮ অপরাহ্ন

শিক্ষার্থীরা এই ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠবে

শফিকুল ইসলাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০২১
  • ১৪৬ বার

স্কুল-কলেজ এখনই খুলছে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান সাধারণ ছুটি ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু করোনার সংক্রমণ এখন কমতির দিকে। মনে হচ্ছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষপর্যায়ে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার কারণে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের শঙ্কা। কারণ ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে থাকতে এক ধরনের বিষণœ হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা নানাভাবে তাদের জীবন নিয়ে চিন্তিত।

সরকার বলছে সংক্রমণের হার যদি ৫ শতাংশ হয় এবং সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা যায়, তা হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে দুটির কোনোটিই ওই পর্যায়ে নেই। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে বন্ধ থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়। তবে ক্ষতি কাটিয়ে নেওয়ার সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি বাস্তবে কতটুকু কাজে আসে, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমার প্রশ্ন হলো- সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে, কোথাও কোনো সমস্যা নেই মনে হচ্ছে। তা হলে করোনা কি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী বলার পরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে দেরি হচ্ছে। কেন খুলছে না? ধারণা করা হচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। এ বছর এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কপালে কী রয়েছে, কে জানে! কারণ তাদের পরীক্ষা নিয়ে সঠিক কোনো রুটিন এখনো প্রকাশ পায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা আছে, এ বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি এসএসসি এবং ডিসেম্বরের শুরুতে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে।

গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সবপর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড ১৯-এর কারণে বাংলাদেশে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময় ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে একাধিক শিফট করে, দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস ও পরীক্ষা- সবই নেওয়া সম্ভব ছিল। দরকার ছিল সঠিক পরিকল্পনা। কিন্তু তা হয়নি। অনলাইন বা মডিউলভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। অনেক শিক্ষার্থীর ডিভাইস নেই। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের সংযোগ নেই। থাকলেও বিদ্যুৎ ঠিকমতো থাকে না। তাই অনলাইন শিক্ষা সবপর্যায়ে তেমন কার্যকর নয়। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে কিছুটা কার্যকর। অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা শতভাগ পাওয়া যায় না। আর সরাসরি ক্লাস নেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থী ও কম আয়ের পরিবারের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে। কারণ তাদের কোনো ডিভাইস নেই। তারা কোনো রকম অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এ ছাড়া করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক সমস্যা অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব থাকবে আমাদের নানা খাতে। মা, কবে স্কুল খুলবে- এই জাতীয় প্রশ্ন প্রত্যেক অভিভাবককে শুনতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর তারা দিতে পারেন না। সরকার অনেকবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও দেশে মহামারী পরিস্থিতির কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি, বরং দফায় দফায় বন্ধ থাকার মেয়াদ বেড়েছে। দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধির কারণে সবার মনে হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি কোনোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। তাই আর দেরি না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় ভালো। যদি পরিস্থিতি আবার খারাপ হয়, তা হলে প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন। এটিই তো স্বাভাবিক ঘটনা।

দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্কুলপর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঘরবন্দি থাকতে থাকতে শিশুরা মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে খারাপ কাজে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মোবাইল ফোন বা টিভি নিয়ে তারা জীবনের মূল্যবান সময় পার করছে। এতে তারা একগুঁয়ে হয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। শিশুদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। আর শিশুদের মোবাইল ফোন বা টেলিভিশনে কার্টুন না দেখতে দিলে ঘরের মধ্যে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে, মা-বাবা বাধ্য হয়ে শান্ত করতে তাদের হাতে ডিভাইস তুলে দিচ্ছেন। বর্তমানে বিভিন্ন পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র খুলে দেওয়ায় অভিভাবকরা শিশুদের সেখানেও নিয়ে যেতে পারছেন। একটু স্বস্তি মিলছে এখন। স্কুলে শুধু শিশুকে লেখাপড়াই শেখায় না, বরং তাকে সমাজের নানাদিক সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। তা তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে সহযোগিতা করে থাকে। করোনার কারণে অন্য শিশুদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই দিন দিন তারা অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে।

মোবাইল ফোন বা টেলিভিশন দেখে সময় কাটছে শিক্ষার্থীদের। তা এখন রীতিমতো আসক্তিতে পরিণত করছে তাদের। এতে ভবিষ্যতে তারা পড়াশোনা করতে বা মনোনিবেশ করতে চাইবে না। তাদের জোর করে পড়াশোনা করাতে হবে। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অল্পবয়সে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে আবার কারও কারও বাল্যবিয়ে হচ্ছে। তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন- তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে গড়ে ওঠার অভ্যাস নাও তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ সমাজের শিশুদের বিশাল ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই যত দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যায়, ততই দেশের ও দেশের শিশুদেরসহ সব শিক্ষার্থীর জন্য মঙ্গল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় প্রাথমিক স্তরের এক-পঞ্চমাংশ ও মাধ্যমিক স্তরের এক-চতুর্থাংশ স্কুলগামী শিশু শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে নারী ২৬ শতাংশ ও পুরুষ ৩০ শতাংশ ঝুঁকিতে রয়েছে। যারা অতিদরিদ্র, সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থীর কোভিড-সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।

মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্রীরা সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার পর এবং অনেক গরিব পরিবারের মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। আবার অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে সংসারের প্রয়োজনে অনেক শিক্ষার্থী শিশুশ্রমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ অবস্থা নিরসনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করার কোনো বিকল্প নেই। করোনাকালে ১৭ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একদিকে ছাত্রীরা দেদার বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না থাকায় তাদেরও বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় অফলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করা একমাত্র সমাধান। অধিক সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রতিসপ্তাহে অন্তত রোস্টার করে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আনার ব্যবস্থা করতে পারলেই অনেকটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষার্থীসহ তাদের পরিবারও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অভ্যস্ত হবে। দ্রুত শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করে শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।

শফিকুল ইসলাম : শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com