বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২৮ পূর্বাহ্ন

আমি বিজয় দেখেছি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯
  • ৬০১ বার

বাঙালি গর্জে উঠেছিল ১৯৭১ সালে। একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বাঙালি জাতি। এ বিজয়-ইতিহাস যেন সহস্র গল্পের সমাহার, যার পরতে পরতে আছে রক্তঝরা ৯ মাসের ইতিবৃত্ত। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর কেমন ছিল বিজয়বার্তা পাওয়ার ক্ষণটি? জানিয়েছেন কয়েকজন তারকাশিল্পী

আলী যাকের

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের হয়ে কাজ করি। আমার কাজ ছিল বিভিন্ন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা আর তাদের বিভিন্ন এলাকায় অপারেশনের সাফল্যের কথা সংগ্রহ করা। আমি যে অনুষ্ঠানের জন্য এগুলো ধারণ করতাম, সেগুলোতে সেক্টর কমান্ডারদের পাশাপাশি একেবারেই গ্রামের কৃষক-ক্ষেতমজুর মুক্তিযোদ্ধাদেরও কথা ছিল। অনুষ্ঠানটি ইংরেজিতে প্রচার হতো। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে একটি টেপ রেকর্ডার দিয়ে আলমগীর কবির ভাই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন যশোরের বিভিন্ন এলাকায়, যেখানে মিত্রবাহিনী আর মুক্তিবাহিনী মিলে স্বাধীনতার পতাকা তুলেছে, তাদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারেরও নিতে হবে। এভাবেই আমি সেখান থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিনিয়ত রেডিওতে পাঠাচ্ছি। মনে আছে, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; বিকেল ৪টা। যশোর থেকে খুলনার দিকে যাচ্ছিলাম। পথে কোনো গাড়ি ছিল না। তবুও পথের ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, যদি কোনো একটি গাড়ি পেয়ে যাই, এ আশায়। তখন একটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জিপ আমাকে পেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ইংরেজিতে চিৎকার করে আমাকে বলছিল- ‘ইউ আর নাউ ফ্রি’। মানে আমরা এখন মুক্ত, স্বাধীন!’ এই আনন্দের সংবাদ শুনে তৎক্ষণাৎ মাটিতে বসে পড়লাম। তখন বিকেল সাড়ে ৪টা বাজে। মনে আছে, আমি এর পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে ক্ষেতের পাশ দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ি। সেই অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার নয়; মুক্ত দেশের সোঁদা মাটির ধূলিকণা ছিল পরম আপন।

কবরী

আমার বয়স যখন ১২ বছর তখন আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করি। ১৯৭১ সালে আমি পুরোদস্তুর অভিনেত্রী। তখন আমি অনেকটাই পরিচিত। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ডিসেম্বরের শুরুর দিকে আমরা বুঝতে পারছিলাম, বিজয় অতি সন্নিকটে। প্রতিটি দিনই শুরু হতো একেকটি বিজয়ের খবর দিয়ে। একদিন দেখা যেত দিনাজপুর মুক্ত হয়ে গেছে। আবার অন্যদিন হয়তো অন্য কোনো জেলা। এমনি করে ডিসেম্বরের প্রতিটি দিনই যেন ছিল বিজয়ের দিন।

শাহীন সামাদ

তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ঠিক সেই সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এক মাস সীমান্তে ঘুরেছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিনটি আমার দেখা স্মরণীয় একটি দিন। মানুষের ভেতরে এত আনন্দ, এত উল্লাস আর দেখিনি। রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ চলছে, ছেলেরা কোলাকুলি করছে, পটকা ফোটাচ্ছে, রং ছোড়াছুড়ি চলছে। আরও কত কী! ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে এক পলক সেই স্মৃতি দেখে বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়।

রাইসুল ইসলাম আসাদ

১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সকালের রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা ছিল। মালিবাগ মোড়ে গিয়ে দেখি, মাঝেমধ্যে একেকটা আর্মির গাড়ি বা ট্রাক আস্তে ধীরে চলে যাচ্ছে। মেইন রোডের কাছাকাছি চলে আসার পর দেখি অদ্ভুত কিছু মানুষ। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যাদের আটকে রেখেছিল, টর্চার করেছিল, তারা বেরিয়ে এসেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে মাইকে ঘোষণা হচ্ছিল- দেশ স্বাধীন হচ্ছে। মানুষজন রাস্তায় বের হতে থাকল। আমাদের একটা ক্যাম্প ছিল নবরত্ন কলোনিতে, এখন যেটা বেইলি রোড। দুপুরের মধ্যে জানা গেল, পাকিস্তানি আর্মি সারেন্ডার করবে রেসকোর্স ময়দানে। বিকেলের দিকে গেলাম পল্টনে, আমার বাড়িতে। রাতে খবর এলো- আমাদের কমান্ডার নাসির উদ্দীন ইউসুফ দল নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। তখন রাত ৯টা কিংবা সাড়ে ৯টা হবে। ৫২ জনের টিম ছিল আমাদের। পরে আমরা চারটা টিমে ভাগ হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ভাগ হয়ে আবার লোকাল লোক রিক্রুট করতাম। ওদের সবাইকে ঢাকায় আনা হবে। সেই রাতেই গাড়ি বা যানবাহন জোগাড় করতে থাকলাম- যারা ঢাকায় ছিলাম। আমাদের সঙ্গের অনেকেই শহীদ হয়েছে। তাদের কথা সেদিন খুব মনে পড়েছিল।

ফকির আলমগীর

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গিয়েছিলাম নকশাল অধ্যুষিত এলাকা মেদিনীপুরের মহিশাদল। সাংস্কৃৃতিক আয়োজনে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন সন্তোষ গুপ্ত, রণেশ দাশগুপ্ত, আবদুল গাফফার চৌধুরী, এমআর আখতার মুকুলসহ আরও কয়েকজন। এর পর ইন্দ্রমোহন রাজবংশী ও সুরেন্দ্র মাইতির পর মঞ্চে উঠি আমি। তিনটি গানের পর চারপাশে কোলাহল শুরু হলো। শুনলাম, বহু কাক্ষিত সেই খবর- ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে।’ তখন সত্যিই উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যশোর রোড পেরুনো, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়া, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশ নেওয়া, বালিগঞ্জ আসা, শব্দসৈনিক হয়ে লড়াই করার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছিল মনের পর্দায়।

লুবনা মারিয়াম

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামক সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটি দলের একজন সদস্য হিসেবে আমারও কাজের সৌভাগ্য হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আমাদের এসব কাজ আরও বেশি করে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সারাদিন ও রাতের বেলাতেও বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে বেড়িয়েছি। ডিসেম্বরের শুরুতেই বোঝা যাচ্ছিল, বিজয় সন্নিকটে। সেই দিনগুলো আজও মনের ভেতরে আনন্দের দোলা দেয়।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com