ইতিহাস কথা বলে। ইতিহাস মানবসভ্যতার অগ্রগতির সোপান। প্রতিটি জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সে জাতির প্রকৃত ও অবিমিশ্র ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব তাদেরই অভিভাবক ও নেতাদের ওপর বর্তায়। এ দায়িত্ব পালনে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে বিকৃতি সংঘটন অমার্জনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি কোনো ব্যক্তিপূজারি নই, ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ নই, ‘জিয়ার সৈনিক’ নই। আমি মানবতার সৈনিক, আমি মাতৃভ‚মি বাংলাদেশের সৈনিক, আমি ইসলামের সৈনিক এবং সর্বোপরি আমি মহান সৃষ্টিকর্তার পূজারি ও তারই সৈনিক। আর তাই দেশের সর্বত্র মিথ্যাচারিতায় আচ্ছাদিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযাদ্ধাদের ইতিহাসে কালিমা লেপন হওয়ায়, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে নিশ্চুপ থাকা আমার জন্যও দণ্ডনীয় অপরাধ।
আমি এবং আমার মতো অনেকেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছেড়ে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেছিলাম। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে শহীদ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা শুনে দিকনির্দেশনা পেয়ে নিজে স্বয়ং এবং আমার সাথে আরো কিছু সতীর্থকে নিয়ে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে ১৯৭১ সালে পালিয়ে এসে দেশে ফিরে কালবিলম্ব না করে হেঁটে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় পৌঁছে জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎ পাই।
জেডফোর্সের নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন, প্রথম, তৃতীয় এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মধ্যে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই আমাকে অষ্টম বেঙ্গলের একজন কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেন। আমি নিজে, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মরহুম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুল হক, বীর উত্তম এবং ব্রিগেড অধিনায়ক তদানীন্তন কর্নেল জিয়াউর রহমানের অধীনে সম্মুখসমরে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিজয় অর্জিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করার এক সৌভাগ্যবান মুক্তিযোদ্ধা। আমরা কোনো ভুয়া বাহিনীর অংশ হিসেবে বা কোনো ভুয়া অধিনায়কের নেতৃত্বে যুদ্ধ করিনি। তাই ‘জেডফোর্স’ ও এর অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে ক্ষমতার উচ্চাসনে চেপে বসা কিছু ব্যক্তি যখন প্রশ্ন তোলেন তখন মর্মাহত হই, দু’চোখ হয়ে পড়ে অশ্রুসিক্ত, একই সাথে প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে সর্বাঙ্গ হয় কম্পিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এসব ধ্বজাধারীর চিৎকার ও কুমির কান্নায় লজ্জায় নিজের কাছেই মাথা নত হয়ে যায়।
বলছি, মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, ঐতিহ্য ও পবিত্র ইতিহাস আপনারা ভূলুণ্ঠিত করে এক সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছেন। এ খেলা বন্ধ করুন। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, কোনো পদবির জন্য নয়, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য নয়; হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ার জন্য নয়। ইচ্ছা হলেই এই সবকিছুই অর্জন করা আমাদের পক্ষে মোটেও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আমরা চেয়েছি কেবল এ মাটি ও মানুষকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে। অন্য দিকে, আপনারা ক্ষমতারোহণ এবং তা আঁকড়ে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের করেছেন খণ্ড-বিখণ্ড। মুক্তিযোদ্ধারা দেশরক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু আপনাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে আপনারা আমাদের অনেককেই ব্যবহার করেছেন। আমাদের বানিয়েছেন আওয়ামী, বিনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতি মুক্তিযোদ্ধা।
সৌভাগ্যবশত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিজয়ী বেশে ফিরে এসেছি, বিজয় দেখেছি, স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু আমার লাখ লাখ সহযোদ্ধা ভাই বোনেরা এ বিজয় নিশ্চিত করার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। অগণিত মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আজ আমার দুর্ভাগ্য, একটি পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপবিত্র করার জন্য আপনারা দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। কোথায় ছিলেন আপনারা যখন পুরো দেশের মানুষ আগুনে পুড়ছিল? কখনো ভেবে দেখেছেন, বিজয় অর্জিত না হলে আমাদের কী পরিণতি হতো। আমরা যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তাদের হয় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে হতো অথবা দেশান্তরিত হয়ে অন্য দেশে ঠিকানার খোঁজে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াতে হতো। অন্য দিকে, আপনারা এখন যেমন ভালো আছেন, তখনো তেমনি ভালো থাকতেন।
ভেবে কূল পাই না, কী উদ্দেশ্যে আপনারা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধাদের নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা খেলছেন। আপনাদের লাভটা কী? কেন আপনারা জিয়াউর রহমানের মতো একজন সূর্য সৈনিককে জোর করে নিচে নামিয়ে, ইতঃপূর্বেই সমুচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত আর একজন মহান দেশপ্রেমিক ও বাঙালি জাতির পথিকৃৎ, বঙ্গবন্ধুকে উপরে উঠানোর নিরর্থক অপচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। কেন মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের অবদান ও জেডফোর্সের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে হবে? কার কাছে প্রমাণ দিতে হবে? যারা এর প্রমাণ চাইছেন আপনারা ১৯৭১ মার্চ থেকে ডিসেম্বর অবধি কোথায় ছিলেন? আপনারা প্রমাণ দিন যে, মুক্তিযুদ্ধকালে আপনারা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বা শহীদ জিয়া তাদের জীবদ্দশায় কেউই তো একে অন্যকে খাটো করে দেখেননি। তবে আপনারা কেন এই রশি টানাটানি করছেন? কেন মৃত ব্যক্তিদের লাশ নিয়ে নির্লজ্জ ও অমার্জনীয় অপরাধে নিজেদের কলঙ্কিত করছেন? এই অপরাধের জন্য একসময় কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শাস্তি পেতেই হবে।
গোয়েবলস, চাণৈক্য, হিটলার, মুসোলিনি, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানদের নীতি অবলম্বন করা থেকে বিরত হতে হবে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:, মহামানব নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ জিয়াউর রহমানের সহমর্মিতা ও ভালোবাসার নিদর্শন অবলম্বন করুন। সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলা এবং গ্রহণ করা শিখুন। নোংরা এবং দুর্গন্ধময় রাজনীতির খেলা সবাই বন্ধ করুন। ভাবুন দেশের নবীন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের জন্য আপনারা কী উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন? আর কত দিন কষ্টার্জিত এই দেশ এবং দেশের সাধারণ মানুষদের বিভক্ত করে রাখা হবে? আমি বিশ্বাস করতে চাই, আপনারা সুশিক্ষিত। আর তাই ইতিহাস আপনাদের অজানা নয়। মহৎকে মহৎ, মহানকে মহান বলে স্বীকার করে নিলে প্রকারান্তরে নিজেও মহান বলে আখ্যায়িত হবেন। আর এর ব্যত্যয় হলে হবেন কলঙ্কিত এবং নিক্ষেপিত হবেন আঁস্তাকুড়ে।
আজ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। জীবিত সহমুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রশ্ন, আমরা কি পার্থিব লাভের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? আমরা কি জাতিকে আজকের এই বিভক্ত রূপে দেখতে চেয়েছিলাম? আমরা কি অন্যায়, অত্যাচার, সম্পদের পাহাড় গড়ে, মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? আমাদের কি লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় না, যখন দেখি মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ লুটতরাজ, ক্ষমতারোহণ এবং অন্যায় অত্যাচারে লিপ্ত ব্যক্তি ও বিশেষ গোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তি ও পদলেহন করছেন?
সম্মুখসমরে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আমরা যারা এখনো জীবিত রয়েছি, তাদের সময় হয়তো ফুরিয়ে এসেছে। তবে আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একটি বিশাল ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বুলেট, কামান ও যুদ্ধজাহাজকে যখন ভয় করিনি, তখন আজ এই প্রবীণ বয়সেও আটক হওয়ার, জেল-জুলুম ও মৃত্যুর ভয় করি না। যুদ্ধে মৃত্যুর জন্য প্রতিটি মুহূর্ত তৈরি ছিলাম। আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই আজ পর্যন্ত আমাদের জীবিত রাখার জন্য। বয়সের ভারে শারীরিক শক্তি হ্রাস পেয়েছে, হয়ে গেছি ন্যুব্জ এবং কুব্জ। তবে সত্যের পক্ষে কথা বলা ও মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার সৎ সাহস আজও লোপ পায়নি।
আজ জেডফোর্স এবং তার অধিনায়ককে অস্বীকার ও লাঞ্ছিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির আবরণে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার ও অপমানিত করা হচ্ছে। শহীদ জিয়া তার স্ত্রী-পুত্রদের অজানা ভবিষ্যৎ এবং বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে, একমাত্র দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশ করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। তখন কোথায় ছিলেন? আপনারা সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, ভাসানীসহ দেশের অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে অস্বীকার করেছেন। ইতিহাস থেকে তাদের স্মৃতি মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ও তার অবদানকে আপনারাই রাজনীতির নোংরা খেলা খেলে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন। আপনাদের সহচরেরাই বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে মোশতাক সরকারের সাথে হয় সশরীরে অথবা পেছনে থেকে ফায়দা লুটেছেন। ক্ষমতা আর অর্থের জন্য সবই সম্ভব।
তবে সতর্ক হয়ে যান এবং নিজেদের চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করুন। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অস্বীকার এবং তাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কলঙ্কিত না করে দেশের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ও দেশের বাইরে ওঁৎ পেতে থাকা দেশের শত্রুদের চিহ্নিত করুন এবং তাদের নির্মূল করার পদক্ষেপ নিন।
আমার মতো সহস্র মুক্তিযোদ্ধা যদি জেডফোর্সে ও তার অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের অধীনে যুদ্ধ করে থাকে তাহলে ‘জেডফোর্স’ ভুয়া ছিল না এবং জিয়াউর রহমান একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তাই শহীদ জিয়া ও জেডফোর্সকে যথাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবোজ্জ্বল বাহিনী হিসেবে প্রমাণ দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রমাণ দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের অংশগ্রহণের এবং দেশের পক্ষে কাজ করে প্রকৃত দেশপ্রেমের।