লম্বা বিরতি আর অনিশ্চয়তার কারণে অনেকেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে রোজগারে নেমে গেছে। মেয়েদের কেউ কেউ সহপাঠী ছেলেদের মতো মিল-কলকারখানায় ঠাঁই পেলেও তাদের একটা বড় অংশের ঠিকানা হয়েছে শ্বশুরবাড়ি। স্কুলে অনুপস্থিতির মধ্যে এদের হার বেশি। চাকরি ছেড়ে, শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে তাদের পক্ষে ¯ু‹লে আসা সম্ভব হয়নি। বিয়ে হয়ে যাওয়া ছাত্রীদের মধ্যে কেউ এর মধ্যেই মা হয়েছে, অনেকে মা হবে তাড়াতাড়ি। তার পরও বিবাহিতদের সবাই যে অনুপস্থিত থাকছে এমন বলা যাবে না। দু-একজন আগ্রহ নিয়েই আসছে। যেমন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের পাঠানপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যে ১৫ জন নাবালিকা করোনাকালে বিবাহ নামের নিগ্রহের শিকার হয়েছে তাদের মধ্যে ছয়জন বিদ্যালয়ে আসছে। তাদেরই একজন ¯ু‹ল দেখতে আসা সংবাদকর্মীদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘বিয়েতে আমাদের মত ছিল না। লেখাপড়া করে অনেক দূরে যেতে চাই। শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির লোকজন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার শর্ত মেনে নিলে আমরা বিয়েতে মত দিই। কোনো কারণে স্বামী বা শ্বশুর যদি আমাকে পড়াতে না চান, তা হলে আমি স্বামীর সংসার ছেড়ে দেব। তবু লেখাপড়া ছাড়ব না।’ এই সাহসী উচ্চারণের জন্য নাবালিকাকে আমাদের শুধু অভিনন্দন জানালেই চলবে না, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সংবাদমাধ্যমে ছাত্রীটির নাম প্রকাশ করা হয়নি কিন্তু পনেরো জনের মধ্যে কোন ছয়জন আসছে আর তাদের মধ্যে কে তাদের মনের কথাটি প্রকাশ করেছে তা জানতে কেজিবি, সিআইএ লাগে না। সাহসিকতাকে চিহ্নিত করে তাকে ঢিড করতে সময় লাগবে না।
ইংরেজি সংবাদপত্র তাদের বাংলা সংস্করণে নাম-ঠিকানা আর ছবিসহ অদম্য নার্গিস নাহারের খবর ছাপে। সে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার নদীবিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন হলোখানা। সেখানকার সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির সব মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। অদম্য নার্গিস নাহার বিয়ে না করে ক্লাসের একমাত্র মেয়ে শিক্ষার্থী হয়ে ¯ু‹লে আসছে, পড়াশোনা করছে। তার ছেলে সতীর্থদেরও সবাই আসছে না। কাগজ-কলমে অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে ‘সরকারি প্রমোশন’ (অটো প্রমোশনের চলতি নাম) পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা ২৭ কিন্তু উপস্থিত থাকছে ৮ থেকে ১০ জন। বাকিরা কোথায় গেল। এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে নানা মিল-কলকারখানা, গ্যারেজ আর দোকান, আড়ত কিংবা ভাটা অথবা ঘেরে বা ডেলিভারি বয়ের চাকায়। ভোলা সদরের শিবপুরের শান্তিরহাট মেঘনা নদীর পারে অবস্থিত হাফিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে দুই হাজার টাকা মাসিক বেতনে শ্রমিকের কাজ শুরু করেছে ¯ু‹ল ছেড়ে আসা একদল নাবালক। ভোলার শিবপুর ইউনিয়নের রতনপুর এলাকায় গড়ে ওঠা মিনার প্লাস্টিকের কারখানায় ৪-৫ জন শিশু কাজ পেয়েছে। এদের সবাই করোনা ভাইরাসের কারণে ¯ু‹ল-মাদ্রাসা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। কেউ পেটে-ভাতে কাজ শিখছে, কারও বেতন ঠিক হয়েছে মাস গেলে দুই হাজার, তবে সাত দিনে সপ্তাহ আঠারো ঘণ্টায় দিন।
নার্গিসরা পারবে কি?
নার্গিসের একাগ্রতা আর সংগ্রামের গল্প ছাপা হওয়ার পর আশা ছিল সে মানুষের সহযোগিতা পাবে, সবাই তার সংগ্রামী মনোভাবকে স্বাগত জানাবে। খবরটি রাষ্ট্র হওয়ার পর বেশিরভাগ মন্তব্য নব্বইয়ের আফগান তালেবানদের হার মানাবে। এসব মন্তব্য-মতামতে এক ধরনের সামাজিক নিগ্রহের আলামত ইতোমধ্যেই নানাভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। হাসিঠাট্টা, মড়কে অসম্মান, উৎপীড়ন, যৌন হেনস্তার প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য হুমকি আছে তাদের ইচ্ছায়। অন্য সহপাঠীদের মতো ¯ু‹ল বন্ধের সময় তাদের বাড়িতেও ঘটকদের ঘোরাফেরা ছিল। প্রস্তাব নিয়ে তারা এসেছিলেন। সব শুনে নার্গিস তার বাবা-মাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, সে এখন বিয়ে করবে না। আগে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হবে তার পর বিয়ে। নার্গিস একদম ভাবেননি যে, তাদের ক্লাসে আর একটা মেয়েও থাকবে না। বিয়েগুলো সব হয়েছে গোপনে, এতটা গোপনে যে, ¯ু‹ল খোলার সিদ্ধান্ত পাক্কা হওয়ার পর সহপাঠী বান্ধবীদের বাড়িতে যাওয়ার পর কেবলই বিয়েশাদির কথা জানতে পেরেছে নার্গিস। এসব খবরে তার কষ্ট হয়েছে। তার যুদ্ধটা আরও জটিল হয়েছে। ‘ক্লাসে ছাত্রী হিসেবে আমি একা। খুব খারাপ লাগে। কথা বলার মতো কোনো বান্ধবী নেই। জানি না ছাত্রী হিসেবে একাই ক্লাসে উপস্থিত থেকে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব কিনা, তবে চেষ্টা করছি।’ এসব কথা নার্গিস অকপটে বলেছে সাংবাদকর্মীদের।
গোপনে বিয়ে! নিবন্ধন হচ্ছে কি
নাবালিকাদের বিয়ের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকায় কিংবা বিষয়টা ঠিক হচ্ছে না বিবেচনায় অভিভাবকরা কোনো ঝুঁকি নিচ্ছেন না। নার্গিস তার আট সহপাঠীর একজনেরও বিয়ের খবর আগে থেকে জানতে পারেনি। এলাকার বাইরে মামা-খালার বাড়িতে নিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কলমা পড়লেই আর কবুল বললে বিয়ে সিদ্ধ। তাই নিষিদ্ধ বিয়ে শোরগোলের দরকার কী? রংপুরের বদরগঞ্জ থেকে জানা গেছে, প্রকৃত নিবন্ধকের নিবন্ধন বই অন্য কেউ ব্যবহার করে নিবন্ধনের কাগুজে কাজ সেরে নিয়েছেন। গোপীনাথপুর ইউনিয়নের নিকাহ নিবন্ধক শহীদুল ইসলাম তার হাওলায় থাকা নিবন্ধন বই জনৈক সুমনকে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সে ক্ষেত্রে তার অজুহাত হচ্ছে তার এলাকার বিয়েগুলো অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার কারণে লালদীঘি গ্রামের জনৈক সুমনকে নিকাহ নিবন্ধন বই দিয়েছিলেন। তবে তার দাবি কোনো নাবালিকার বিয়ে তারা নিবন্ধন করেননি।
বদরগঞ্জের গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার, এক এলাকার মেয়েকে অন্য এলাকায় নিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর ভুয়া বয়স দেখিয়ে নিবন্ধনও হচ্ছে কোথাও কোথাও। আইন থাকলেও প্রশাসন অভিযোগ না পাওয়ায় পদক্ষেপ নিচ্ছে না বা নিতে উৎসাহ পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) যেমন বলেছেন, ‘কেউ অভিযোগ না দেওয়ায় এই এলাকায় বাল্যবিবাহের বিষয়ে আমরা অবহিত নই।’
কী করা যায়?
সবার গায়ে যেমন একই মাপের জামা বা ফ্রক চলে না, তেমনি এই জটিল সমস্যার একক কোনো ফর্মুলা সমাধান নেই। সবার আগে প্রয়োজন একটা নির্ভরযোগ্য কিন্তু চটজলদি জরিপ ও চাহিদা নিরূপণ।
প্রথমেই ভাবতে হবে, যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের সঠিক নিবন্ধন হয়েছে কিনা। না হলে সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা এসব নাবালিকার সুরক্ষার একটা বাতাবরণ তৈরি করবে।
বিয়ের শর্তে যাই থাকুক না কেন, লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না। বিয়ের পর বর্তমান ¯ু‹লের আওতার বাইরের এলাকায় চলে গেলেও সেখানকার ¯ু‹লে তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঝরে পড়াদের জন্য সরকারি কর্মসূচিকে নতুন বাস্তবতার নিরিখে ঢেলে সাজাতে হবে।
বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে জীবনে বড় হওয়ার, শিক্ষিত হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়, সেটা জানাতে হবে জোরেশোরে।
ছেলে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার রাস্তা খুঁজতে হবে। ভোলার এক কলেজের অধ্যক্ষ যেমন বলেছেন, ‘শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না। প্রান্তিক এলাকার অনেক শিক্ষার্থী গরিব ও অসহায়। দীর্ঘ সময় ¯ু‹ল বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ¯ু‹ল থেকে দূরে সরে গেছে। অনেকে কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এসব শিক্ষার্থীকে ¯ু‹লে ফেরাতে হলে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ¯ু‹লে ফেরানোর কর্মসূচি নিতে হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগগুলোও শিশুদের ¯ু‹লে ফেরাতে বিভিন্নভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে।’
কর্মজীবী শিশুদের নিয়ে শিক্ষার অনেক মডেল নিয়ে এ দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাস্তবায়িত হয়েছে। সেগুলো অভিজ্ঞতা নিয়ে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, জোর করে বিয়ে দেওয়া নাবালিকাদের এ কথা বলার মতো বুকের পাটা আছে যে, ‘পড়াতে না চাইলে সংসার ছেড়ে দেব।’ মনের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের অদম্য বাসনা না থাকলে একজন নাবালিকার পক্ষে এমন সাহসের কথা উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের উচিত, সমাজের উচিত শিক্ষার জন্য অগ্নিশপথ নেওয়া, এসব আগুনের টুকরার পাশে দাঁড়ানো। তাদের অব্যাহত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করা। এটা তাদের অধিকার।
গওহার নঈম ওয়ারা : লেখক ও গবেষক