বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১৪ পূর্বাহ্ন

নিউইয়র্কের বাঙালি যেখানে এগিয়ে

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৯
  • ২৮৫ বার

বাংলা সংস্কৃতি চর্চার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জায়গা এখন নিউইয়র্ক! এটা আমার কথা নয়। রোববার সংগীত পরিষদের আয়োজনে লোক গানের আসরে গিয়েছিলাম। সেখানে এক বক্তা বলছিলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আগের মতো সংস্কৃতিকর্মী ও অনুরাগী মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বীকৃতির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে যোগ্য সংগঠকেরাও। আর পশ্চিমবঙ্গে? সেখানে তো এখন বাংলা গান বাদ দিয়ে সবাই হিন্দি গান শুনছে। হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসন সর্বত্র। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাদের নিজেদের গায়ক-গায়িকাকেই চেনে না।
সেদিক থেকে নিউইয়র্ক অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। এখানকার বাঙালিরা নিজেদের শিল্পীদের তো চেনেই, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির খবরও রাখে। বিজয়ের মাসে ভিনদেশের মাটিতে এটাই বাঙালির প্রকৃত বিজয়। শুধু যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তা তো নয়; পড়াশোনা, রাজনীতি, করপোরেট জবÍসবক্ষেত্রেই এখন বাঙালির জয়জয়কার! ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে পাওয়া একটি স্বাধীন দেশের এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে! ভিনদেশের মাটিতে এ যে বাঙালির বড় বিজয়।
নাচে-গানে তুখোড় শিল্পী জারিন মাইশা কিংবা গিফটেড ট্যালেন্টেড স্কুলের শিশু ছাত্র ফাসির কবির কাব্য কিংবা হার্ভার্ডের ছাত্রী সোফিয়া চৌধুরীÍএরাই আমেরিকার মাটিতে এখন বাংলাদেশের সাফল্যের বিজ্ঞাপন। সোফিয়াকে দিয়ে শুরু করি না কেন! কজন এই খবরটা রাখেন? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক্সিকিউটিভ এমবিএর সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষার্থী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সোফিয়া চৌধুরী। টিডিএস ইনস্যুরেন্স ব্রোকার কোম্পানির পরিচালক সাইদ চৌধুরী ও শাহানা আখতারের তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে সবার বড় সোফিয়া। সোফিয়া চৌধুরী। ডাক নাম তৃথা। জন্ম ১৯৮৭ সালে ঢাকায়। ব্রুকলিনের পিএস ২৩০ এলিমেন্টারি, মিডল স্কুল ডেভিড এ বুড্ডি। হাই স্কুল এডওয়ার্ড মুরো। ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টিং নিয়ে ২০০৯ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন।
সাইদ দম্পতির বাকি দুই মেয়ের মধ্যে হিয়া চৌধুরী বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছেন। আর সবার ছোট সিলভিয়া চৌধুরী এভারগ্রিন স্টেট কলেজে লিবারেল আর্টস নিয়ে পড়ছেন। কেপিএমজি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করতে গিয়ে পরে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। কেপিএমজিতে কাজ করেন ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত। ২০১২ সাল থেকে গোল্ডমেন শেকসে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত। এই কোম্পানি থেকেই তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ এমবিএ পড়তে যান। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এত কম বয়সে কেউ ওখানে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করতে যাননি ইতিপূর্বে।
ফাসির কবির কাব্য। ওর এখন বয়স ১০ বছর। দুই বছর বয়স থেকে গান-নাচ-আবৃত্তি, গিটার শেখা। যেটা ভালো লাগে সেটাই বাসায় এসে করার চেষ্টা করে কাব্য। নানা মীর মুজতবা আলীকে বরিশাল শহরে সবাই সংস্কৃতি অনুরাগী হিসেবে জানে। কাব্য তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। খুব আদরের। এ জন্য বাবা-মায়ের প্রশ্রয় বেশি পায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার কোরিওগ্রাফি কাব্যের উল্লেখযোগ্য কাজ। প্রতিবাদী, বিদ্রোহী ও স্বাধীনতার কবিতা ভালো লাগে তার। দেশাত্মবোধক গান পছন্দ করে। পুরোনো দিনের গান শোনে। সংস্কৃতি চর্চা না, যেন ধ্যানে থাকে ও। কাব্য যেন স্বভাবশিল্পী। কিছু না দেখে, নিজে চিন্তা করে করে আর্ট করে। বাংলাদেশ সোসাইটি বাংলা স্কুলে বাংলা শিখছে। ভাষাটা শেখা থাকলে নিজের সংস্কৃতিকে জানার সুযোগ ঘটে।
ছেলেকে নিয়ে নিজের পরিকল্পনা জানাতে মা ফারজিন রাকিবা বললেন, কাব্যের বাবা হোসাইন কবির বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশে থাকেন। আমি এখানে চাকরি করি। কাব্যকে সন্ধ্যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে ছোটাছুটি করা আমার জন্য কঠিন হয়ে যায়। তবু এখানকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে নানা ধরনের রাজনীতি আছে। কাব্যকে আমি গিফটেড ট্যালেন্টড স্কুলে পরীক্ষায় অংশ নিতে দিয়েছি। একটা ছিল কণ্ঠের জন্য, আরেকটা নাচের জন্য। ৮০ নম্বর পেলেই সুযোগ পেত। কিন্তু ৯৮ নম্বর পেয়ে সেখানে সুযোগ পেয়েছে ও। কাব্য এখন ওখানে যাচ্ছে। ওর স্কুল ব্রুকলিনে। সংগীত ও নৃত্যে কাব্য এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাচ্ছে। ভবিষ্যতে সে নিউইয়র্কের মূলধারার একজন শিল্পী হিসেবে নিজেকে বিকশিত করতে পারবে।
জারিন মাইশার জন্ম নিউইয়র্কে, ২০০০ সালে। মা নার্গিস রহমান ও বাবা সৈয়দ মিজানুর রহমান বাঙালি কমিউনিটিতে সবার প্রিয় মুখ। মাইশার বেড়ে ওঠা আমেরিকায় হলেও বাংলা শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে নিজের পরিচয় খুঁজে বেড়ায় সে। মাত্র চার বছর বয়সে বিপায় গান শেখা শুরু করে। শুরুতে গানের শিক্ষক ছিলেন নিলুফার জাহান, এখন শিখছেন সেলিম আশরাফের কাছে। শুধু কি তাই! মাইশা নাচ শিখেছেন অ্যানি ফেরদৌসের কাছে, আবৃত্তি বিষয়ক কোর্স করেছেন ইভান চৌধুরীর কর্মশালায়, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের হয়ে জামালুদ্দিন হোসেনের নির্দেশনায় পাঁচটি মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করেছেন। মাইশা মাত্র চার বছর বয়সে প্রি–স্কুলে আর বিপায় ভর্তি হয় একই সময়ে। যখন আমেরিকার মূলধারায় বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পারে, ওই মুহূর্তে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হয় মাইশার। নানা বিষয়ে, বিভিন্ন সংগঠনের একাধিক পুরস্কার পেয়েছে মাইশা।
সে জানায়, ‘যেকোনো স্বীকৃতি বা পুরস্কার কাজের ইচ্ছাটাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এখানকার কঠিন স্কুল পদ্ধতির মধ্যে সংস্কৃতি চর্চা খুব সহজ না। তাই স্টেজ থেকে নামার পরে কেউ যদি প্রশংসা করে, খুব ভালো লাগে। কোনো ছোট্ট শিশু এসে যখন বলে, মাইশা আপু, আমি আপনার মতো নাচতে চাই, তখন এত ভালো লাগে যে, বলার নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, ৯ মাসের সংগ্রাম, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়-সবকিছু মাইশাকে আন্দোলিত করে।
মাইশা জানায়, ‘যদি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তবে আজ আমরা পরাধীন থাকতাম এবং পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হতে হতো।’
নতুন প্রজন্মের এই ছেলেমেয়েরা এভাবে তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতা দিয়ে রোপণ করেছে নিজস্বতার বীজ, নতুনত্বের বীজ। তাদের বিবেচনাবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও নেতৃত্বের ক্ষমতা নিঃসন্দেহে অনুসরণীয়। অটুট সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবন্ধকতা সমন্বিত উদ্যোগে একের পর এক মোকাবিলা করেছে, বিজয়ী হয়েছে। দিক নির্দেশকের হৃদয়ভরা স্বপ্নের, বিস্ময়ভরা দৃষ্টির, আবেগাপ্লুত কণ্ঠস্বরের ও বাস্তবতার নিরিখের দাবি-সন্ধান মিলেছে পরবর্তী প্রজন্মের পথিকৃৎদের।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com