বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক কিছু আছে। আবার অনেক কিছু নেই! ক্রিকেট ঘিরে মাতামাতি আছে। আছে উৎসাহ-উদ্দীপনা। কারণ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে যখন সাফল্য খরা, তখন মাঝে মধ্যে ক্রিকেটে কিছু সাফল্য আসে। তাই ক্রিকেট পরিচালনার সঙ্গে জড়িত হতে চান উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষগুলো। ক্রিকেটে বিপুল অর্থ, যশ, সম্মানসহ অনেক কিছু আছে। যা তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে একটু উঁচুস্তরে প্রতিষ্ঠা করে।
আবার বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্র্যান্ডভেল্যু বাড়ায় অর্থের প্রবাহও বেড়েছে। সম্প্রচারস্বত্ব, বিজ্ঞাপন সব মিলিয়ে ক্রিকেটে টাকার কমতি নেই। ক্রিকেটারদের বেতন কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সেই সংখ্যাটা সীমিত। মানবিকতার বিষয়টাও সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। অনেক ক্রিকেটার-কর্মকর্তাদের দিকেও মাঝে মধ্যে বিসিবি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। যেটা ধন্যবাদযোগ্য। তা ছাড়া অন্য খেলায় সফল প্রাক্তন ক্রীড়াবিদদের দুর্দশাচিত্র হতাশার অন্য স্রােতে জীবন ভাসে, সেখানে ক্রিকেট কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম। তাই ক্রিকেটের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় নেই।
তবে সংশয়ের চাদরে মোড়া আমাদের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনা। ক্রিকেটীয় পরিকাঠামোর চেহারাটা খুবই হতাশার। টেস্ট প্লেয়িং একটা দেশ। একুশ বছর ধরে টেস্ট খেলছে। সেই ক্রিকেট বোর্ডের নিজস্ব একটা ক্রিকেট মাঠ নেই। নেই নিজস্ব কোনো ক্রিকেট একাডেমি! উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ক্রিকেট প্রতিভার পরিচর্যা করতে না পারলে ভালো ক্রিকেটার উঠে আসবে কীভাবে! বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের লোগো-গঠনতন্ত্রে একাধিকবার পরিবর্তন হয়েছে। গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন যতটা ক্রিকেটের জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি যারা যখন ক্রিকেট পরিচালনার দায়িত্বে আসেন তাদের জন্য। যা আগামী দিনের পদ-পদবি টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়! ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড থেকে ‘কন্ট্রোল’ শব্দটা বাদ দেওয়া হয়েছিল খানিকটা উদার এবং গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে। কিন্তু রূঢ এবং কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, বোর্ডের গায়ে কন্ট্রোল না থাকলেও বোর্ড পরিচালিত হয় রিমোট কন্ট্রোলে! ব্যক্তিকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন বেশি। যে কারণে ক্রিকেটীয় অবকাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এর সবকিছুই কয়েক দশক ধরে শুধু মুখের বুলি হয়ে আছে।
দায়টা ক্রিকেট বোর্ডের পাশাপাশি সরকারকেও নিতে হবে। এখনো দেশজ ক্রীড়াক্ষেত্রে অর্থ থেকে পরিকাঠামো সবকিছুরই নিয়ামক ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত ক্রিকেট বোর্ড গড়ার কোনো উদ্যোগই নেয়নি সরকার তথা মন্ত্রণালয়। কারণ এ দেশে কেউ কারও ক্ষমতা আর কর্তৃত্বে ছাড় দিতে চায় না। আবার প্রতিভা অন্বেষণ, প্রশিক্ষণ, লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে চান না। বরং দায় এড়াতে চান। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচন হলো। সভাপতিও পুনরায় দায়িত্ব নিলেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করায় সুযোগ পেলে কাজের ধারাবাহিকতাও ধরে রাখা সহজ। কিন্তু কাজটা হচ্ছে কোথায়?
ক্রিকেট অবকাঠামোর উন্নতি হলো কোথায়? গত শতাব্দীর শেষভাগে নারায়ণঞ্জের ফতুল্লায় যে ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছিল, যেখানে বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলেছে, ভারত খেলেছে, এখন সেই স্টেডিয়াম থাকে পানির নিচে! খেলা নয়, চলে মাছ ধরা! তা হলে বিসিবির যে গ্রাউন্ডস কমিটি আছে, তারা যে শুধু কাগজ-কলমে, বাজেটনির্ভর হয়ে আছেন, সেটা কী অস্বীকার করতে পারবেন? গত শতাব্দীতে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। স্টেডিয়াম একটা তৈরি হয়েছে, তবে সেটা কোন অর্থে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, সেটা শুধু সেই কমিটিই বলতে পারবে! কারণ সেখানে আজ পর্যন্ত কোনো টেস্ট, ওয়ানডে এমনকি বিপিএলের কোনো ম্যাচও আয়োজন করা সম্ভব হয়নি! অথচ বিশ্বের অন্যতম ইকোফ্রেন্ডলি স্টেডিয়াম হতে পারত। জাতীয় ক্রিকেট একাডেমির জন্য সেরা জায়গাও হতে পারে কক্সবাজার। ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া ক্রিকেটের সূত্র ধরে দেশের পর্যটনে ব্রিটিশসহ বিশ্ববাসীকে আকর্ষণ করা যেত। কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। ক্রিকেটের প্রচার-প্রসারে সেই কক্সবাজারকে ব্যবহার করার আগ্রহের ঘাটতি ভয়াবহ। যা আমাদের ক্রিকেটের আগামী দিনের স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। পূর্বাচলে শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কাজ দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা বোর্ড সভাপতির। আরও একটা ভালো ক্রিকেট স্টেডিয়াম হবে, সেটা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য আনন্দদায়ক খবর। কিন্তু ঢাকার বাইরের স্টেডিয়ামগুলোর কী চেহারা, তার কোনো তথ্য কি বোর্ডের কাছে আছে! ভোটের আগে যারা পরিচালক হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ দেন, তারা গেল চার বছরে নিজেদের এলাকা বা বিভাগে ক্রিকেট উন্নয়নে কী ভূমিকা রেখেছেন, তার কোনো ব্যালান্সশিট কি কাউন্সিলরদের কাছে দিতে পেরেছেন! চট্টগ্রাম-খুলনা-বরিশাল-সিলেট বিভাগের পরিচালকরা নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কিন্তু সেই বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গত চার বছরে কটা ক্রিকেট লিগ হয়েছে? কটা মাঠকে ক্রিকেটের জন্য বিশেষায়িত মাঠ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন! রাজশাহী বিভাগ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে, বিশেষ করে ঢাকার লিগে ক্রিকেটার সরবরাহের অন্যতম পাইপলাইনের ভূমিকা রেখে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সেই বিভাগে একটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ নেই! বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছে এক সময়। কিন্তু রহস্যজনক কোনো এক কারণে সেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ বন্ধ! ক্রিকেট প্রসারের রাস্তায় যদি রাজনৈতিক ব্যারিকেড তৈরি করা হয়, তা হলে দেশের ক্রিকেট একদিন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের মতো অবস্থায় পড়তে পারে। যা আগামী দিনের জন্য অশনিসঙ্কেত।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের অবদান অস্বীকার করা মানে নিজেদের ক্রিকেটীয় সত্তাকে গলাটিপে হত্যার নামান্তর। ঢাকার ক্রিকেটের একটা ঐতিহ্য ছিল। সেই ঐতিহ্য ধারণ এবং বহন করেছে ক্লাবগুলো। কিন্তু সেই ক্লাবগুলো কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ জানেন না! আদৌ বেঁচে আছে কিনা সেটাও অজানা। ক্রিকেট শুধু খেলা নয়। ক্রিকেট সংস্কৃতির অংশ। একটা জীবনদর্শনও বটে। ঢাকার নিরেট ক্রিকেট ক্লাবগুলো হারিয়ে গেছে এই ভোটের খেলার কাছে। নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠকরা এখন বিরল এক প্রজাতি। ঢাকার ক্রিকেট লিগ নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল, সেটা বুড়িগঙ্গার স্রোতে ভেসে গেছে। এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন ক্লাব থেকে যারা পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে আবাহনী-মোহামেডান বাদ দিলে আর কোনো ক্লাবের ক্রিকেট ঐতিহ্য আছে! অনেক ক্লাবের প্যাড আছে, কিন্তু সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না! কোথায় কীভাবে ক্রিকেট খেলে তারা কাউন্সিলরশিপ নিশ্চিত করেছেন, তা শুধু কাগজের স্কোরকার্ড ছাড়া কেউ জানেন না! ক্রিকেটে পুঁজির আগমন হয়েছে ভালো কথা। আধুনিক পৃথিবীতে অর্থ ছাড়া কোনো খেলার বেঁচে থাকা কঠিন। কিন্তু যাদের হাত ধরে খেলাটা বেঁচে থাকবে, তারা কতটা ক্রিকেটের লোক সেটাই বিবেচ্য। টাকার বেশি ছড়াছড়িতে কী হয়, সেটাও জানা থাকা ভালো। ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং শব্দটা ঢুকে পড়েছে টাকাওয়ালাদের জন্য। টাকা আছে, বিপিএলে দল কিনুন। কিন্তু ক্লাব ক্রিকেটে কেন? বরং ক্লাব ক্রিকেট যখন লিমিটেড ‘কোম্পানির লিগ’-এ পরিণত হয়েছে তখনই উঠতি ক্রিকেটারদের ‘আত্মবিশ্বাসকে হত্যা করা হচ্ছে অন্যভাবে। তারা নিজেরাও জানেন না এবং বুঝে উঠতে পারেন না, কেন, কীভাবে জিতছেন বা হেরেছেন! বুঝবেন কীভাবে, একই গ্রুপের একাধিক ক্লাব! একই ব্যক্তি একাধিক ক্লাবের কোচ! একই ব্যক্তি বিসিবি পরিচালক আবার নিজে ক্রিকেট একাডেমি চালাচ্ছেন! ‘স্বার্থদ্বন্দ্ব’ বলে কোনো শব্দ তাদের অভিধানে নেই। অনেকে বলবেন, তার পরও তো আমরা ম্যাচ জিতছি? হ্যাঁ জিতছি। কোথায়, কোন উইকেটে, কত রান তাড়া করে, সেটা এক সময় জটিল অঙ্ক হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঘরোয়া ক্রিকেট মানে শুধু বিপিএল আর ঢাকার লিগ হতে পারে না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে এক সময় বলা হতো ‘পিকনিক ক্রিকেট’, সেই বদনাম ঘোচানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বিভিন্ন বিভাগ থেকে নির্বাচিত পরিচালকদের। তারা যদি নিজেরা জাতীয় লিগে নিজের বিভাগের দলটাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারেন, তা হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিচালনায় ভূমিকা রাখবেন কীভাবে?
ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের কারণে বিশ্বে কিছুটা মর্যাদা পান ক্রিকেট কর্তারা। সেই ক্রিকেটারদের অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত নতুন পরিচালনা পর্ষদের। নতুন বলতে শুধু তাদের মেয়াদটা নতুন করে শুরু হলো। বাকি সবই পুরনো। তাই পুরনো চিন্তা-ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে ক্রিকেট কর্তাদের। তার জন্য দরকার পেশাদারি মানসিকতা। বিশ্বের সব পেশাদার বোর্ডে কথা বলেন, তাদের মুখপাত্র, যিনি পেশাদার লোক। বাংলাদেশে কথা বলেন সব পরিচালক। সাধারণ মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, কার কথা কে বলছেন! ক্রিকেটবিশ্বে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান কোথায়, সেটা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় সংগঠনে পরিচালক মাত্র ১০ জন। সেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে পরিচালকের সংখ্যা ২৫! ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার পরিচালনা পর্ষদে ১০ জনের ৫ জন নারী। ক্রিকেট নিউজিল্যান্ডেও পরিচালক ১০ জন। তাদের মধ্যে নারী ৩ জন। আর বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা গর্ব করি, কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডে ২৫ জন পরিচালকের মধ্যে একজনও নারী পরিচালক নেই! অথচ নারীরাই বাংলাদেশকে প্রথম এশিয়া কাপ এনে দিয়েছেন। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে ব্যাটসম্যান শব্দটাকে- ‘ব্যাটার’-এ রূপ দেওয়া কঠিন হবে।
অঘোর মন্ডল : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক