আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারি নিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন তোলপাড় চলছে, আমরা তখন কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ি। তাও মফস্বলের এক কলেজে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতন বা পচনের যেকোনো খবরেই তখন আমাদের তুমুল আগ্রহ। প্রবল ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পতন ডেকে আনল এই ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারি। তিনি তখন আমেরিকার দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যতিব্যস্ত। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার দুই বাঘা সাংবাদিক কাল বার্নস্টিন ও বব উড ওই পত্রিকায় খবর ছাপলেন যে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার প্রতিপক্ষের ফোনালাপ আড়ি পেতে শুনেছেন এবং ওয়ারটেপে রেকর্ড করেছেন। এরই ফলে মান ইজ্জত সব খুইয়ে নিক্সন ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এক দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবমাননাকর যবনিকাপাত; অন্য দিকে নিজ দেশে বিরুদ্ধ পক্ষের ফোনালাপ আড়ি পেতে শোনা ও রেকর্ড করার মতো অনৈতিক কাজকে আমেরিকানরা সে দিন মেনে নিতে পারেননি। এই সৎ সাহসী সাংবাদিকতার ‘এনাম বাবদ’ বব উড ও কার্ল বার্নস্টিনের জুটেছিল ‘পুলিৎজার পুরস্কার’। তাদের প্রকাশিত বেস্ট-সেলিং বই All the President’s Men বিক্রয় সাফল্যে অতীতের বহু রেকর্ড ভেঙেছিল। ক্ষমতার শিখর থেকে অপমানের অতলে কেবল নিক্সনকেই নামতে হয়নি, তদন্তে ধরা পড়েছিল খোদ ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সহযোগী পরিচালক মার্ক ফেলট ছিলেন এই কেলেঙ্কারি নাটকের অন্যতম হোতা।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে আগ্রাসী, হানাদার। তবে নিজ দেশে ‘ষোলোআনা গণতান্ত্রিক’। তাই সত্য কথা বলতে বা লিখতে গিয়ে কাউকে অপহরণ করা হয় না, হামলা-মামলায় কাউকে সর্বস্বান্তও হতে হয় না। গত প্রায় আড়াই শ’ বছরে কম কেলেঙ্কারি হয়নি আমেরিকায়। শুরু হয়েছে ১৭০৭ সালের ঢণত অভভধরৎ নামের কেলেঙ্কারি দিয়ে। এর পর থেকে একে একে ১৮২৯ সালের কেলেঙ্কারি, ১৮৭৩ সালের মোবিলিয়ার কেলেঙ্কারি, ওয়াটারগেট (১৯৭২), ১৯৮৬ সালের ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি- কোনোটা থেকে কোনোটা কম নয়।
বিল ক্লিনটন-মনিকা লিওনস্কি কেলেঙ্কারির কথা জানে না পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব কম আছে। হারমান কেইন-গিঞ্জার হোয়াইট, সিনেটর গেরিহার্ট-ডোনা রাইস, কেনেডি-মেরিলিন মনরো, ল্যারি ক্রেইগ-মহিলা দারোগা, গভর্নর ইলিয়ট স্পিৎজার-অ্যাশলে ডুপ্রে, সিনেটর জন এনসাইন-ডাফ হ্যামিলটন মামলা, গভর্নর শোয়ার্জনিগার-মারিয়া শ্রিভার মামলা, কংগ্রেসম্যান গেরি কন্ডিট-শান্দ্রা লেভি মামলা, রিপাবলিকান ডেভিড ভিটার-বনাম-জনৈকা পতিতা সমাচার, হাউজ স্পিকার গিনগ্রিচ-ক্যালিসিটা মামলা, ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর-মারিয়া বেলুন শাপার মামলা, ক্যারোলাইনার জন এডওয়ার্ডের অবৈধ বিয়ে মামলা, নিউ জার্সির জেমস ম্যাকগ্রিভি-গোলান সাইপেল মামলা, সর্বশেষ বিল ক্লিনটন-মনিকা লিওনস্কি কেলেঙ্কারি প্রভৃতি রাজনৈতিক যৌন কেলেঙ্কারি মার্কিন গণমাধ্যম সময়ে সময়ে ‘পরীমণি-ধরনের’ ঝড় তোলে। অবাধ যৌনতার দেশ আমেরিকায় ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচার ‘অতি সাধারণ’ ঘটনা হলেও রাজনৈতিক জীবনে যৌন কেলেঙ্কারির ব্যাপারে আমেরিকানরা সব সময়ই অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল। তারা নেতাদের কাছ থেকে ‘সাধারণ’ আমেরিকানের জীবনাচার আশাও করে না; বরদাশতও করতে চায় না। নেতাদের তারা বসিয়েছে শ্রদ্ধার উচ্চাসনে। তাই সেই উচ্চতায় এত বড় অনিয়ম-অনাচার তারা মানতে নারাজ। নেতাদের ব্যক্তিজীবনের কোনো স্খলন বা অনিয়ম রাজনৈতিক জীবনকে কলুষিত করুক, এটি তারা ভাবতেও পারে না। ইতিহাসজুড়েই এর অজস্র নজির রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ইতিহাসবিদ কার যথার্থই বলে গেছেন, “Henry VIII may have been a bad husband and a good king. But the historian is interested in him in the former capacity… only in so far as it affected historical events.” (‘রাজা অষ্টম হেনরি একজন খারাপ স্বামী ছিলেন এবং একই সাথে ছিলেন একজন ভালো রাজা। কিন্তু ঐতিহাসিকরা তার প্রথম পরিচয়ে বেশি আগ্রহী। কেননা মন্দ স্বামী হিসেবে তার ভ‚মিকা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকে বেশি প্রভাবিত করেছিল।’) বোঝা গেল রাজনীতিবিদদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মানুষ কেন এতটা সংবেদনশীল?
কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগের কারণে কেলেঙ্কারি আগের জায়গায় আর নেই। ‘ওয়াটারগেট’-এর ফোনে আড়িপাতা এখন নস্যি। সে দিনের পত্রিকা গোটা আমেরিকাবাসী পড়েছিল। রিপোর্টাররা স্বনামে রিপোর্টগুলো ছেপে ছিলেন। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়কে ছয় আর ছয়কে নয় করা হচ্ছে। তবে ভিডিও বা পোস্টগুলো কারা কোথায় বসে আপলোড করছে, তার কোনো ঠাঁই ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুনিয়াজুড়ে অর্ধ সহস্রাধিক মানুষ হাজার হাজার ফোনালাপ শুনছে বলে জরিপ করেছে ফ্রান্সের Forbidden Stories’ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’। যারা ফোন বা ফোনালাপ করে ধরা খেয়ে বসে আছেন তারা তাদের সমাজের প্রভাবশালী কেউকেটা। এসব প্রভাবশালীর মধ্যে আছেন ১৪ জন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানসহ নামজাদা রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা, আইনজীবী ও ব্যাংকার। তা হলে কত ডজন ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারি এরই মধ্যে ঘটে গেছে! আড়ি পাতার এ নতুন ‘ওয়াটারগেটটি’র দখল নিয়েছে কুখ্যাত ‘পেগাসাস’ কোম্পানি। এখন আর তার-ক্যাবল লাগিয়ে ফোনে আড়ি পাততে হয় না বা লকার ভেঙে রেকর্ড-ডিভাইস লুট করা লাগে না। এখন সব কিছুই ওয়ারলেসে, রিমোটে, মুঠোফোনে, পিসি বা ল্যাপটপ বা ট্যাবে চলে আসে। ‘পেগাসাস’ কোম্পানিটি ইহুদি মালিকানাধীন এবং ইসরাইলে নিবন্ধিত। তা হলে এত মানুষের এত ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস করায় কোনো দেশে ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটাও উচ্চবাচ্য নেই কেন? ভাসুরের নাম? তাই সে নাম মুখে নেয়া যাবে না? হায়রে গণতান্ত্রিক বিশ্ব! হায়রে ভণ্ডামিপূর্ণ পাশ্চাত্য গণতন্ত্র! এই ইসরাইলি গুপ্তপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মরক্কো, ভারত, কাজাখস্তান, বাহরাইন, মেক্সিকো ও রুয়ান্ডার মতো দেশ! বিরোধী দল দমনে পৃথিবী নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারী দেশগুলো পরম মিত্র ইসরাইলের কাছ থেকে গোয়েন্দা ‘ডিভাইস’ কিনেছে এবং তামিল করছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, হ্যাকিং, স্পাইওয়্যার এসব তথ্য সন্ত্রাস রুখে দাঁড়ানোর কোনো বিধিবিধান, নিয়মনীতি নেই। নেই কোথাও, কারো কাছে কোনো ধরনের জবাবদিহির লেশ মাত্র। এই প্রকাশ্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রাইভেসি-বিনাশী ‘ম্যালওয়্যার’ নিয়ে খোদ আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানিতেও কোনো প্রতিবাদ নেই। এরা নাকি মানুষের গোপনীয়তা বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে ‘যক্ষের ধন’ বলে মনে করে!
এক ‘ওয়াটারগেটে’ অপমানিত হয়ে নিক্সনকে ক্ষমতা ছেড়ে রাস্তায় নামতে হয়েছিল। আজকের বরিস জনসন, ম্যাক্রোঁ, ট্রুডো, বাইডেনরা তা হলে মুখ খুলছেন না কেন? ভিন্নমতাবলম্বী দমনে ইসরাইলি টেকনোলজিই শুধু নয়, ইসরাইলের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভেরও আবদার করতে পারে এসব স্বৈরশাসক। এটিও আমাদের দেখে যেতে হলো? ধিক্কার জানানোর ভাষাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! পতিতাদেরও একটি ধর্ম থাকে। স্বৈরতন্ত্রীরা বাজারের দেহপসারিণীদের চেয়েও নিকৃষ্ট। এরা কি জানে ‘পেগাসাস’-এর পাতা ফাঁদে ‘পা’ দিয়ে এরা কী করছে? আর ইজ্জত-সম্মান-সম্ভ্রমের কি কিছু বাকি থাকল রাজা বা রাজপুত্রদের? এখন তো দেখা যাচ্ছে, ‘ওয়াটারগেট’ যুগটা ছিল বর্তমানের চেয়ে ‘সত্যযুগ’ এবং নিক্সন ছিলেন সেই সত্যযুগের সাধক পুরুষ। আজকের মহাচীনের এ মহত্ব ও বিশালতা অর্জনের সত্যিকার রূপকার ছিলেন নিক্সন এবং তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জার। এমনকি বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিওনস্কিও ছিলেন সেই ‘সত্যযুগের’ শেষ রোমিও-জুলিয়েট!