সম্মানিত পাঠক হয়তো লক্ষ করেছেন কখনো কখনো কলাম লিখতে গিয়ে আমি দার্শনিক প্রসঙ্গের অবতারণা করি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সব ধরনের জ্ঞানের ভিত্তি হলো দর্শন। কোনো ব্যক্তিবিশেষ যখন কোনো একটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন, তখন এর মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে তার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, যদিও তিনি দর্শন একেবারেই পছন্দ করেন না।
খ্রিষ্টের জন্মপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গ্রিক চিন্তার জগত নতুন এক ধরনের মোড় নেয়। এ মোড় নেওয়ার পেছনে রয়েছে সফিস্ট নামে পরিচিত দার্শনিকদের উত্থান। সফিস্ট শব্দটি এসেছে সফিযেস্টহাই ক্রিয়া পদটি থেকে। এর অর্থ হলো একটি পেশাকে আবিষ্ক্রিয়ামূলক এবং ধূর্ত করে তোলা। সফিস্টরা তাদের বক্তৃতার জন্য টাকা-পয়সা আদায় করত।
অথচ অন্য ধরনের দার্শনিকরা অর্থের জন্য কোনো আগ্রহই দেখাত না। দার্শনিকভাবে সফিস্টরা পূর্ববর্তী দর্শন বিদ্যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এ দার্শনিকরা মনে করতেন, বাস্তব পৃথিবী ঘটনা ঘটার এ পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সফিস্টরা প্রশ্ন তুলল, এমন ধারণার পেছনে কী আছে। তারা বললেন, তথাকথিত বাস্তব পৃথিবীতে কেউ বাস করে না। এটা প্রোটাগোরাসের ঘোষণা থেকে বোঝা যায়।
প্রোটাগোরাস বলেছিলেন, মানুষই হলো সব কিছুর পরিমাপক। এ পরিমাপ তারা যেমন আছে তার পরিমাপ এবং তারা যেমন নেই তারও পরিমাপ। মানুষের জন্য পৃথিবীকে যেমন মনে হয়, সেটিই পৃথিবী, অন্য কিছু নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, একজন মানুষকে গরম লাগার কথা বলা, যখন সে শীতে ঠকঠক করছে। তার জন্য শীতেরই অস্তিত্ব আছে, উষ্ণতার কোনো অস্তিত্ব নেই। তার অনুজ একজন সমসাময়িক তরুণ দার্শনিক লিওনতিনির জর্জিয়াস খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ভালো বক্তৃতা দেওয়ার কায়দা-কৌশল সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করে।
তিনি দার্শনিকদের নিয়ে মজা করার জন্য আরেকটি বই লিখেছিলেন। এতে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন- ১. কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই, ২. যদি কিছু থেকেও থাকে তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না এবং ৩. যদি কেউ জানে যে কিছু আছে যার অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সে অন্যদের কাছে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারে না।
সফিস্টরা ছিল সংশয়বাদী। তাদের এ চিন্তাভাবনা এক সময় দর্শনের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়। সর্বোপরি অন্যান্য বিষয়ের ঐতিহ্যের মধ্যেও এরা স্থান করে নেয়। চোখের দেখা বিষয় হিসাবে দেখা যায় বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন আচার-আচরণ সংক্রান্ত নিয়মবিধি চালু আছে। এসব জাতি গোষ্ঠী নর-নারীর সম্পর্ক, বিবাহ এবং দাফন-কাফন সম্পর্কে পবিত্রতার একটা ধারা গড়ে তুলেছে।
সফিস্টরা আচার-আচরণের এসব নিয়মবিধিকে কনভেনশন বা অতীত থেকে বয়ে থাকা প্রচলিত রীতি মনে করত। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কী, জীবনে কীভাবে সফল হওয়া যায় এবং কীভাবে অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা যায়, এগুলোই ছিল সফিস্টদের আলোচ্য বিষয়। এগুলো শিক্ষা দেওয়ার জন্য তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
জর্জিয়াস চিকিৎসাশাস্ত্রে কোনো জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বড়াই করে বলত, আমি সফলভাবে একজন রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় শল্যচিকিৎসা করতে সক্ষম। অথচ তার ভাই যিনি একজন চিকিৎসাবিদ, তিনি জানতেন কখন শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হবে। পুরোনো আমলের সফিস্টরা খোলামেলাভাবে অনৈতিকতা প্রচার করত না। এসব সত্ত্বেও ধীরে ধীরে তারাও মানুষের সন্দেহের মধ্যে পড়েছিল। কারণ তারা ধূর্ততার সঙ্গে তর্ক করত।
পরে একজন সফিস্ট, যিনি সালচিডনের থ্রাসিমাকাস বলে পরিচিত তিনি সরাসরি সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন ‘অধিকার হলো শক্তিমানদের জন্য অথবা অবস্থাপন্নদের জন্য সুবিধাজনক।’ এর কারণ হলো অধিকারকে এ রকম খারাপ অর্থে সংজ্ঞায়িত করা। এখন দেখছি বাংলাদেশও থ্রাসিমাকাসের যুক্তি অনুসারে চলছে।
এ দেশে অনৈতিক ও বেআইনি কাজ করার জন্য কোনোরকম লজ্জা ভোগ করতে হয় না। এ দেশটা এখন চোরের মার বড় গলার দেশ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের কাজ হলো দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। এটাই সুশাসনের সংজ্ঞা। সংবাদপত্রে মাঝে মাঝে ক্ষমতার বলয়ে অবস্থানকারীদের রাতারাতি ধনাঢ্য হওয়ার গল্প ছাপানো হয়।
একটি সংবাদপত্রে দেখলাম একজন এমপি কয়েক বছরের মধ্যে দেশে ও বিদেশে আলিশান বাড়ির মালিক হয়েছেন। সংবাদপত্রের শিরোনামে ‘এমপির বাড়িবিলাস’ কথাগুলো স্থান পেয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে চাঁদাবাজি করে বাড়িবিলাসী হওয়ার শখ মিটেছে। এলাকার লোকজন ভালো করেই জানে কয়েক বছর আগেও এ এমপি বাহাদুরের বিষয়-সম্পত্তি কী ছিল। তিনি কোথা থেকে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের খোঁজ পেয়েছেন, যার গুণে দৈত্য এসে এসব করে দিয়ে গেছে।
এ এমপি নিঃসন্দেহে থ্রাসিমাকাসের তত্ত্ব পড়েননি। তারপরও থ্রাসিমাকাসের প্রচারিত দর্শন এ এমপি বাহাদুরের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রভাব অনুভব করি। যুগে যুগে মানুষের সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। এসব পরিবর্তনের মধ্যে একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতার অপব্যবহার। কিছুদিন আগে একটি কলামে জন কেনেথ গলব্রেথের ক্ষমতা সম্পর্কিত তত্ত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলাম। এমপি সাহেব গলব্রেথের কনডাইন পাওয়ারের সুবাদে বিশাল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। আবারও বলতে পারি, এ এমপি সাহেব গলব্রেথ পড়েননি, গলব্রেথের নামও হয়তো তিনি জানেন না।
বাংলাদেশে এখন আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং অশালীন উক্তির ঝড় বইছে। এ দেশের সাধারণ মানুষ কতটুকুই বা অধিকার ভোগ করে। এরা নির্দিষ্ট সময়-অন্তরে ভোট দিয়ে মনে মনে গর্ব অনুভব করে। একদিনের জন্য হলেও তারা নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবত। এখন এর কোনো বালাই নেই।
বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক তত্ত্ববিশারদদের ‘একদিনের গণতন্ত্রও’ হারিয়ে গেছে। এ নিখোঁজ গণতন্ত্রকে উদ্ধার করবে কে? অভিমান, দুঃখ ও ক্ষোভের ফলে মানুষ একদিনের গণতন্ত্র ভোগ করার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে চাইছে না। অহেতুক দুর্ভোগ তারা এড়াতে চায়। এ পলায়নী মনোবৃত্তিকে পরিবর্তন করা সহজসাধ্য নয়। কারণ জনসভা ও মিছিল করে জনমত গঠনের সুযোগ অতি সংকুচিত হয়ে গেছে। এসব করার জন্য পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। এসব সভা ও মিছিল বিরোধী দলের হলে তো কথাই নেই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ