আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় অর্থ যে দায়িত্বহীনভাবে খরচ করা হয়, তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণ প্রকল্প। আট বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন বাস্তবায়নাধীন পুরো প্রকল্পই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অথচ সমীক্ষা ও বিশদ নকশা প্রণয়ন এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বাবদ ইতোমধ্যে প্রায় ১০০ কোটি (৯৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা) ব্যয় হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আগামী বৈঠকে প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে। প্রকল্প বাতিলের কারণ, সড়কের উভয় পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেন রাখা হয়নি। কৌতূহলোদ্দীপক হলো- যারা এ কাজের জন্য সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়ন করেছিলেন, তারা সরকারের কাছে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি।
গতকাল নয়া দিগন্তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে বলা হয়, ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ ‘অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র প্রকল্পটি নীতিগত অনুমোদনের পর পিপিপি কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ দেয়। পরবর্তী সময়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ফর ডিটেইল্ড স্টাডি অ্যান্ড ডিজাইন অব ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে অন পিপিপি বেসিস’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিশদ সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মাল্টিক্রাইটেরিয়া অ্যানালাইসিস পদ্ধতিতে তিনটি অ্যালাইনমেন্ট ও পাঁচটি অপশনের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে টেকনিক্যাল, ফিন্যান্সিয়াল, ইকোনমিক, সোস্যাল ও এনভায়রনমেন্টাল সমীক্ষা শেষে ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। বিস্তারিত সমীক্ষা ও প্রণীত নকশা অনুযায়ী, প্রধানত ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের বিদ্যমান অ্যালাইনমেন্ট ধরে ঢাকা-কুমিল্লা, কুমিল্লা-ফেনী ও ফেনী-চট্টগ্রাম তিনটি প্যাকেজে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সুপারিশ করেছিল। এগুলো হলো- প্যাকেজ-১-এর আওতায় ঢাকা-কুমিল্লা ৮৪ কিলোমিটার (এলিভেটেড ২ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার); প্যাকেজ-২-এর আওতায় কুমিল্লা-ফেনী ৫২ কিলোমিটার (এলিভেটেড ৩ দশমিক ১৫ কিলোমিটার) এবং প্যাকেজ ৩-এর আওতায় ফেনী-চট্টগ্রাম ৮৫ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার (এলিভেটেড ৮ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার)।
ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ক্রমাগত যানবাহন চলাচলের আধিক্য এবং ভবিষ্যৎ গুরুত্ব বিবেচনায় এই মহাসড়ক সম্প্রসারণের আবশ্যকতা রয়েছে বলে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়। ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর এ বিষয়ে শীর্ষ পর্যায় থেকে সম্মতি ও নির্দেশনা পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কার্যক্রম বাতিল, বিদ্যমান চার লেন বিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক প্রশস্তকরণ এবং এ মহাসড়কের উভয় পাশে পৃথক সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রশস্তকরণসহ মহাসড়কের উভয় পাশে পৃথক সার্ভিস লেন নির্মাণে বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে। বলা হয়, ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক সার্ভিস লেন নির্মাণসহ বিদ্যমান সড়ক প্রশস্ত করা হলে মূল মহাসড়কে উচ্চগতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ফলে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে এবং নিরাপদে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করা সম্ভব হবে।
সবার মতো আমাদের জিজ্ঞাসা, আগের প্রকল্পটি উপযোগিতার কথা না ভেবে কেন সমীক্ষা ছাড়াই গ্রহণ ও অনুমোদন করা হলো? তখন কেন সব কিছু যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়নি? এর জন্য রাষ্ট্রের যে শত কোটি টাকা পানিতে গেল, তার দায় কে নেবে? এমন অপচয় রোধে সঙ্গত কারণেই এ অর্থ অপচয়ের জন্য যারা দায়ী তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা অত্যাবশ্যক। তা না হলে এমন অপচয় হতেই থাকবে। কোনোভাবেই তা রোধ করা যাবে না।