সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৮ পূর্বাহ্ন

মহানবীর ক্ষমাশীলতা ও উদারতা

প্রফেসর কর্নেল (অব:) ডা: জেহাদ খান
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১০ নভেম্বর, ২০২১
  • ২৩৩ বার

‘যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধকে দমন করে রাখে আর মানুষকে ক্ষমা করে দেয়। * আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (আল কুরআন ৩:১৩৪)

কুরআনের এ শিক্ষাকে রাসূল সা: বাস্তব জীবনে অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রয়োগ করেছিলেন।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে :

আনাস রা: প্রায় ১০ বছর রাসূল সা:-এর সাহচর্যে কাটিয়েছেন। তিনি কোনোদিন আনাস রা:কে বলেননি, কেন তিনি এ কাজটি করেছেন। একদিন তিনি তাকে একজন লোককে ডেকে আনতে বললেন। অল্প বয়স্ক আনাস রা: বললেন ‘পারব না’। রাসূল সা: কিছু বললেন না। কিছু সময় পর তিনি তাকে বললেন, হে আনাস, তুমি কি এখনো পারবে না? আনাস রা:-এর মনে অনুশোচনা হলো এবং ওই কাজটি স্বচ্ছন্দচিত্তে করলেন। রাসূল সা: একদিন ঘরে এসে জিজ্ঞেসা করলেন, ঘরে খাবার আছে কি? জবাব এলো, কোনো খাবার নেই। তিনি বললেন, তাহলে আজ আমি রোজা রাখলাম। একজন আমেরিকান নওমুসলিম বলেন, এরকম হলে আমরা কত কথা বলি, কেন ঘরে খাবার নেই, আগে কেন বলোনি ইত্যাদি। একদিন রাসূল সা: রুটি খাওয়ার জন্য একটু তরকারি চাইলেন। বলা হলো- ‘ঘরে সিরকা ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি সিরকা দিয়েই রুটি খেলেন আর বললেন, সিরকা কতই না উত্তম তরকারি।’ অথচ সিরকা দিয়ে রুটি খাওয়ার কথা আমরা কদাচিৎ চিন্তা করতে পারি।

পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যস্ততম এ মহামানব ঘরে এসে নিজের হাতে ঘর ঝাড়ু দিতেন; জুতা সেলাই করতেন এবং ঘরের অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করতেন।

একদিন আয়েশা রা:-এর ঘরে অবস্থানকালে অন্য একজন উম্মুল মুমিনিন কিছু খাবার পাঠালেন। এতে তিনি মনোক্ষুণœ হলেন, কারণ তারই আজকে রাসূল সা:কে আপ্যায়ন করার কথা। খাবারের পাত্রটি হাতের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। রাসূল সা: কয়েকজন সাহাবি নিয়ে মাটি থেকেই খাবার তুলে খেতে লাগলেন আর বললেন, ‘তোমাদের মায়ের আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে।’ কিন্তু তাকে রাসূল সা: কিছু বললেন না।

এক যুদ্ধাভিযানে আয়েশা রা:-এর গলার হারটি হারিয়ে গেল। পুরো সেনাবাহিনীকে রাসূল সা: থামালেন এবং তার হারটি খোঁজার জন্য লোক পাঠালেন। তাকে তিনি কিছুই বললেন না। অথচ আবু বকর রা: যখন এ সমস্যার জন্য তার মেয়েকে মারতে এলেন, রাসূল সা: তখন তাকে রক্ষা করেন।

‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলো।’ (আল-কুরআন ৭:১৯৯)
জীবনের ৪০ বছর পর্যন্ত রাসূল সা: ছিলেন সমাজের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি। অত্যন্ত সৎ ব্যবসায়ী, আল আমিন বা বিশ্বাসী, সত্যবাদী, পরোপকারী, বিধবা ও ইয়াতিমদের সাহায্যকারী, আত্মীয়বৎসল, সমাজসেবক, উত্তম মীমাংসাকারী, কঠোর ওয়াদা পালনকারী ও বিশ্বস্ত আমানতদার। এক কথায়, আরবের জাহেলিয়াতের অন্ধকারে যেন একটি উজ্জ্বল হীরক খণ্ড। অথচ তিনি যখন মহান আল্লাহর একত্ববাদের বা সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে সমাজকে পরিবর্তন করতে চাইলেন তখন তিনি হয়ে গেলেন (নাউজুবিল্লাহ) কবি, জাদুকর, গণক, মিথ্যুক, জিনে আক্রান্ত বা পাগল, আবু কাবশা (আরবের সবচেয়ে খারাপ লোক), আবতার (নির্বংশ)। তাদের এসব মিথ্যা অপবাদের তিনি কোনো জবাব দিতেন না।

‘আফসোস, বান্দাদের জন্য! যখনই তাদের কাছে কোনো রাসূল এসেছে তখনই তারা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেছে।’ (আল কুরআন ৩৬:৩০)

রাসূল সা:-এর বাড়ির আঙিনায় এবং খাবারের পাত্রে ময়লা ফেলা হতো। সেজদারত অবস্থায় তাঁর ওপর উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়া হতো। এসব কোনো কিছুই তাঁকে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারত না। এক ইহুদি তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করল, যাওয়ার সময় বিছানায় পায়খানা করে চলে গেল। কিন্তু তার ফেলে যাওয়া তলোয়ার নিতে এলে তার সাথে তিনি উত্তম আচরণ করলেন; বললেন- নিশ্চয়ই তার রাতে কষ্ট হয়েছে। এক বেদুইন মসজিদে তার সামনেই পেশাব করতে লাগল। তিনি তাকে বাধা দিলেন না। তাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘মসজিদ হচ্ছে পবিত্র জায়গা।’ কতই না উত্তম শিক্ষক তিনি ছিলেন!

রাসূল সা: তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনো প্রতিশোধ নিতেন না। তিনি শুধু আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এবং যুদ্ধের ময়দানে কঠোর হতেন।

রাসূল সা: অধীনস্থদের প্রতি ছিলেন খুব স্নেহশীল ও উদার। বদরের যুদ্ধে যাওয়ার সময় তিনি সঙ্গীদের সাথে পালাক্রমে উটের দড়ি টেনেছেন। মসজিদে নববী তৈরির সময় ও খন্দকের যুদ্ধে সঙ্গীদের সাথে মিলে পাথর বহন করেন, মাটি কাটেন। তিনি যেকোনো উপকারীকে উত্তম বিনিময় দিতেন। তাঁর দুধমা হালিমা মদিনায় এলে তাকে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানান এবং জোরে জোরে বলেন, ‘আমার মা’ ‘আমার মা’ এবং নিজের গায়ের চাদর মাটিতে বিছিয়ে দেন তার বসার জন্য। আবু তালিবের স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আসাদ রা: রাসূল সা:কে নিজের সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন এবং দীর্ঘ দিন তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব পালন করেন। রাসূল সা: তাঁর নামানুসারে নিজের মেয়ের নাম ফাতেমা রাখেন; তাঁর চাচীর সন্তান আলী রা:কে লালন পালনের দায়িত্ব পালন করেন। মদিনায় ওই মহিলা সাহাবির মৃত্যু হলে রাসূল সা: নিজ হাতে তার কবর খনন করেন, তার কবরে শুয়ে গড়াগড়ি খান এবং তার নিজের জামা ওই কবরের উপর বিছিয়ে দেন।

তাবুকের যুদ্ধে একজন অসুস্থ সাহাবি মৃত্যুবরণ করলে রাসূল সা: নিজ হাতে আবু বকর ও ওমর রা:সহ ওই সাহাবির লাশ কবরস্থ করেন।

দাসদের প্রতি
তৎকালীন আরবে দাসরা ছিল বর্তমান সময়ের নমঃশূদ্র বা হরিজনদের মতো। জায়েদ রা: ছিলেন তাঁর দাস। তাকে তিনি এত স্নেহ করতেন যে, জায়েদ রা: তার নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে অস্বীকার করলেন। রাসূল সা: তাকে মুক্ত করে নিজের পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। মুতার যুদ্ধে তাঁর চাচাত ভাই জাফর রা:-এর মৃদু আপত্তি সত্তে¡ও মুক্ত দাস জায়েদ রা:কে প্রধান সেনাপতি হিসেবে মনোনীত করেন। তারই সন্তান ১৭ বছর বয়স্ক উসামা রা:কেও রাসূল সা: তাঁর মৃত্যুর আগে এক অভিযানে প্রধান সেনাপতি নিয়োজিত করেন যার অধীনস্থ করে দেয়া হয়েছিল আবু বকর রা:, ওমর রা:-এর মতো বড় বড় সাহাবিদের। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের জন্য যদি হাবশি (কৃষ্ণকায়) নাককাটা গোলামকে শাসনকর্তা মনোনীত করা হয় আর তিনি যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী তোমাদের পরিচালনা করেন তাহলে তার শাসন মেনে নাও।’

মুসলিমরাই একমাত্র জাতি যারা একসময়ের দাসদের পরে তাদের শাসনকর্তা হিসেবে মেনে নিয়েছে (মিসরে, ভারতে)। আধুনিক সভ্যতার দাবিদার ইউরোপিয়ানরা আফ্রিকার মুক্ত মানুষদেরকে দাস করে তাদের প্রতি কেমন নৃশংস আচরণ করেছি, ইতিহাস সাক্ষী। ১৮০ মিলিয়ন আফ্রিকান কালো মানুষকে ক্রীতদাস করে অ্যামেরিকায় নেয়া হয়েছিল, যাদের ৮৮ ভাগ সমুদ্রপথেই মারা গিয়েছিল। আজো তাদেরই বংশধর জর্জ ফ্লয়েডকে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ অকারণে হত্যা করে।

বেলাল রা: ছিলেন আরেক দাস। তাকে রাসূল সা: (তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক), রাষ্ট্রপতির অভাবের সংসারের কঠিন দায়িত্ব দেন। ‘জগৎগুরু’ , ‘কলকি অবতার’ রাসূল সা: একদিন এই ক্রীতদাসের কাছেই জানতে চাইলেন, কি ইবাদত তিনি করছেন যে, তার পদধ্বনি মেরাজের রাতে তিনি শুনতে পেয়েছেন? বেলাল রা: ইসলামের তিনটি পবিত্রতম মসজিদ মক্কা, মদিনা ও জেরুসালেমের প্রথম মোয়াজ্জিনের বিরল সম্মানের অধিকারী। তিনি রাসূল সা:-এর নির্দেশে কাবার উপর উঠে আজান দেন যা দেখে মক্কার মুশরিকরা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ ও রাসূলের দৃষ্টিতে এই হচ্ছে দাসদের মর্যাদা।

দাসদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা তাদের রবকে দিন-রাত ডাকতে থাকে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টারত থাকে তাদেরকে তোমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়ো না।’ (আল-কুরআন ৬:৫২)

শত্রুর প্রতি ও যুদ্ধক্ষেত্রে
রাসূল সা:কে জাদু করা হয়েছে, বিষ খাওয়ানো হয়েছে, তাঁর জীবনে সাত-আটবার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁর সহধর্মিণীকে জঘন্যতম মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে, কিন্তু ওইসব অপরাধীকে হাতের কাছে পেয়েও তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাঁর প্রিয় চাচা হামজা রা: কে হত্যা করে লাশ বিকৃত করা হয়েছে। তাঁর কলিজা চিবিয়ে খাওয়া হয়েছে। তার হত্যাকারীদেরকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন।

রাসূল সা:-এর জীবনে প্রায় ২৭টি যুদ্ধ/সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছিল। তাতে উভয় পক্ষের নিহতের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র এক হাজার ৪০০। সম্রাট অশোক কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রায় এক লাখ লোক হত্যা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বোমা হামলায় হিরোশিমায় এক দিনে নিহত হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার বেসামরিক নাগরিক। আধিপত্য বিস্তারের জন্য স¤প্রতি ইরাক ও আফগানিস্তানে ২০-২৫ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

প্রফেসর কে এস রামকৃষ্ণ রাও বলেন, ‘মোহাম্মদ সা: যুদ্ধক্ষেত্রকেও মানবিক করেছেন। তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন কারো তহবিল হস্তগত করা, ধোঁকা দেয়া, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, অঙ্গচ্ছেদ করা, শিশু-মহিলা-বৃদ্ধ হত্যা করা, ফলবান বৃক্ষ কাটা, উপাসনাকারী কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা।’ অথচ শান্তির সময়ে মসজিদুল আকসায় নামাজরত কয়েক শ’ মুসল্লিকে যখন আহত করা হয় আধুনিক সভ্যতার মানবতাবোধ তখনো জাগ্রত হয় না।

রাসূল সা:-এর মক্কা বিজয় পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে আছে। মক্কার কোরাইশরা দীর্ঘ ২১ বছর ধরে রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবিদের অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছে, তাদের দীর্ঘ তিন বছর বয়কট করে গাছের পাতা পর্যন্ত খেতে বাধ্য করেছে, একটার পর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে রাসূল সা:-এর চাচাসহ অনেক সাহাবিকে হত্যা করা হয়েছে। এত কিছুর পরও তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন। এমনকি শত্রুবাহিনীর প্রধানকে তিনি সম্মানিত করেছেন। ঘোষণা করা হলো, যে আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে, সেও নিরাপত্তা লাভ করবে।

যুদ্ধবন্দীদের সাথে রাসূল সা:-এর মানবিক আচরণ পৃথিবীর আরেক নজিরবিহীন ঘটনা। তাদেরকে ঘোড়া আর উটের পিঠে করে স্থানান্তর করা হয়েছে আর সাহাবিরা গিয়েছেন পায়ে হেঁটে। তাদেরকে রুটি খেতে দেয়া হয়েছে আর নিজেরা খেয়েছেন শুকনো খেজুর। অথচ কয়েক বছর আগে আট শ’ তালেবান যুদ্ধবন্দীকে ওয়াগনের মধ্যে ভরে খাবার, পানি, আলো, বাতাসহীন অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। দুঃখজনক যে, এরকম অমানবিক হত্যাকাণ্ডকেও তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা যুদ্ধাপরাধ রূপে গণ্য করে না।

লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com