বিশ^বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনের দিনগুলোয় জ্বালানি তেলের দাম আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম আরও কমতে থাকলে বাংলাদেশেও কমানো হতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কাজ করছে বলেও জানান দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেই পরিবহন ভাড়া, নিত্যপণ্যের দাম কমবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দেশে কোনো জিনিসের দাম বাড়লে কমার নজির খুব একটা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বাজারে পণ্যমূল্য একবার বাড়লে তা স্থির হয়ে যায়। আর সহজে কমে না। বিশেষ করে পরিবহন ভাড়া একবার বাড়লে আর কমে না। সরকারের উচিত হবে- জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ভাড়া কমানোর ঘোষণা দেওয়া, যেন বিশ^বাজারে তেলের দাম
কমার সুফল সাধারণ মানুষ পায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা আরও কিছু সময় অপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণের পক্ষে মতো দিয়েছেন। একই সঙ্গে বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমলে কী প্রক্রিয়ায় দেশের বাজারে দাম কমানো যায় তা নিয়ে কাজ করছেন।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রচলিত জ্বালানি তেলের মধ্যে কিছু তেলের দাম সরাসরি বিপিসি নিয়মিত বৈঠক করে সমন্বয় করে। ডিজেল-অকটেনসহ কিছু জ্বালানির দাম সরাসরি মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে। বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দামের কী অবস্থা সামগ্রিক তথ্য প্রতিনিয়ত মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। এখন তেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি মন্ত্রণালয় ঠিক করবে।
তবে বিপিসির কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। সেই কমার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়তে কিছুটা সময় লাগবে। যুক্তি হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের বাজারে যে দামে তেল বিক্রি করা হয়, সেই দামের তুলনায় এখনো বিশ^বাজারে তেলের দাম বেশি। বিশেষ করে ডিজেলের দাম এখনো কিছুটা বেশি। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, তেলের দাম আরও কিছুটা কমলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বিশ^বাজারে তেলের দাম কমা প্রসঙ্গে বিপিসির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মার্কিন বাজারের কোথাও কোথাও তেলের দাম কমছে। বাংলাদেশ মূলত তেল কিনে সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের মার্কেট থেকে। সেখানে এখনো তেলের দাম বেশি। দাম কমার যে কথা বলা হচ্ছে তা অনেক বেশি বেড়ে গিয়ে আস্তে আস্তে কমছে। তবে যে পরিমাণ কমছে, সেটি বাংলাদেশের বাজারের সঙ্গে হিসাব করলে এখনো বেশি।
চলতি বছরের জুলাই থেকে বিশ^বাজারে তেলের দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। বিশ^বাজারে তেলের দাম ক্রমবর্ধমান বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ তেল বিক্রিতে লোকসান করছিল এমন অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়। বিপিসি থেকে বলা হয়েছে, ডিজেল বিক্রিতে সংস্থাটির প্রতিদিন ২১ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। ফলে প্রতিলিটার ডিজেল ও কেরোসিনে ১৫ টাকা করে দাম বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সরকারের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে বলা হয় বিশ^বাজারে তেলের দাম কমলে দেশের বাজারেও তেলের দাম কমানো হবে। বলা হচ্ছিল- দেশের বাজারে তেলের দাম না বাড়িয়ে বিকল্প ছিল সরকারের কাছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিচালক অপারেশন সৈয়দ মেহেদী হাসান আমাদের সময়কে বলেন, বিশ^বাজারে তেলের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এখন কিছুটা কমেছে। তবে এখনো যে দাম তাতেও বাংলাদেশে কমানোর মতো অবস্থায় আসেনি। তিনি বলেন, বিশ^বাজারে যখন তেলের দাম ৭০ ডলার প্রতিব্যারেল থাকে, তখন বাংলাদেশ তেল আমদানি করে বিক্রিতে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে থাকে। অর্থাৎ প্রতিব্যারেল তেলের দাম ৭০ ডলার কিনে আনলে দেশের বাজারে তেল বিক্রি করলে কোনো লোকসান হয় না। বিপিসি লাভও করে না। কিন্তু এখনো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ডিজেল প্রতিব্যারেল ৮৩ ডলার। অকটেন ৮৬.৫৮ ব্যারেল, আর ফার্নেস অয়েল প্রতিটন ৪৪২ দশমিক ৩৪ ডলার।
বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের অবস্থা কী হতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এখন পর্যায়ক্রমে কমে আসতে থাকবে। ইউরোপে কোভিড সংক্রমণ আবার নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে তেলের চাহিদা কমবে। এ ছাড়া বৃহৎ দুই অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এখন বাজার থেকে নতুন করে তেল সংগ্রহ না করে মজুদ জ্বালানি তেল ব্যবহারের ঘোষণা দেওয়ায় তেলের দাম কমতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, হুট করে সরকার জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ালেও হতো। কিন্তু বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার কিছু লাভ করতে গিয়ে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন যেহেতু ক্রমান্বয়ে বিশ^বাজারে তেলের দাম কমছে, ফলে সরকারের উচিত তেলের দাম কমিয়ে দেওয়া। একই সঙ্গে পরিবহন ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিক। তেলের দাম কমলে যেন তার প্রভাব বাজারে পড়ে সে বিষয়টি সরকারের বাস্তবায়ন করা উচিত। গোলাম রহমান বলেন, দুঃখজনক হলো আমাদের এখানে একবার কোনো জিনিসের দাম কমলে তা কমার নজির খুব কম।
বিশ^বাজারে কয়েক মাস ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহত আকারে বেড়েছে। একপর্যায়ে তা ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলার ছুঁয়ে যায়। শুধু তেলের দামই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যায় লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি), লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দামও। ফলে জ্বালানি তেল এবং এলএনজির আমদানি অব্যাহত রাখতে এবং আর্থিক সংকট দূর করতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেশে পরিবহন ভাড়া বাড়ে ২৭ শতাংশ।