বাংলাদেশে বিএনপির কোনো আমলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। উপরন্তু আওয়ামী লীগের আমলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বহুগুণ। এখনো প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে সংখ্যালঘুদের বাড়ী-ঘর দখল, উচ্ছেদ বা মুর্তি ভাঙ্গার যত খবর প্রকাশিত হচ্ছে সব ঘটাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা। সবকিছু জেনে দেখেও মিথ্যা প্রচারের ফেরিওয়ালা সত্যভ্রষ্ট ওবায়দুল কাদের সাহেবদের ডাহা মিথ্যা বলতে লজ্জা করে না। কিন্তু সেই দায় এড়াতেই বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
মঙ্গলবার সকালে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন রিজভী।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাসহ ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে দিল্লীর সম্পর্ক শীতল এবং টানাপোড়েন চলছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে মুরুব্বীদের তুষ্ট করে শীতল সম্পর্ক উষ্ণ করতে আবোল-তাবল প্রলাপ বকা শুরু করেছে এই সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা। নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকপুঞ্জি (এনআরসি) জটিলতায় সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন ঘোষণার জেরে গোটা ভারত যখন বিক্ষোভে উত্তাল তখন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ন্যাক্কারজনকভাবে সমর্থন দিচ্ছে।
সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে তার বক্তব্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরা বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের সময় এখনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগের পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের প্রতিবেশী মুরুব্বীদের সামাল দিতে দায় এড়ানোর জন্য দোষ চাপাচ্ছেন বিএনপির ওপর।
রিজভী বলেন, বাস্তবতা হলো-ভারতে এনআরসি দ্বারা মুসলিম খেদাও অভিযানের বিরুদ্ধে স্বয়ং ভারতের জনগণসহ বিশ্ববাসী যখন সোচ্চার তখন বিএনপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে আওয়ামী নেতারা উক্ত দুটি গণবিরোধী আইনকেই বৈধতা দান করছে। আওয়ামী সরকার নিজ দেশের ভিন্নমতের মানুষদের কলঙ্ক লেপনের চেষ্টার দ্বারা ভারত সরকারের সর্বনাশা এনআরসি এই দুটি আইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
এনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে ফের বলছি, ২০০১ সাল কেন, বিএনপির কোনো শাসন আমলেই দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কোনো ঘটনাই, ঘটেনি। আবহমানকাল ধরে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের সময় বরাবরই বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন ছিল। এমনকি বাবরী মসজিদ সংকট এবং গুজরাট-দাঙ্গার সময় এবং খালেদা জিয়ার আমলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অটুট বাঁধনে কোনো চিড় ধরেনি। এক কথায় বলতে গেলে বিএনপির সরকারের সময় সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতে সফল হয়েছে। কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে কোথাও যায়নি।
রিজভী বলেন, আর ঠিক বিপরীত হলো আওয়ামী লীগ। সংখ্যালঘুদের ওপর আওয়ামী লীগ আমলে যত নিপীড়ন হয়েছে, তা আর কখনো হয়নি। আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের লেখাতেই তার ভুরিভুরি প্রমান রয়েছে। হোয়াইট হাউজে ১৭ই জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে এক সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু অধিকার সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা অভিযোগ করেন তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু ‘নিখোঁজ’ হয়েছে। পরে তিনি বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে জানান, অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত ২০১১ সালে এক গবেষণা করে দেখিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে ৬৩২ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক ‘হারিয়ে যাচ্ছে’। ওই গবেষণা কাজের সাথে প্রিয়া সাহা জড়িত ছিলেন।
তিনি আরো বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বিনা অপরাধে আজ ৬৮৫ দিন ধরে বন্দী করে নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার সুচিকিৎসা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করছে না ক্রোধপরায়ণ ও কলহপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। বেগম জিয়ার ন্যায্য জামিনে বাধা দেয়া হচ্ছে। এখন তার ওপর চলছে রীতিমত চিকিৎসা-সন্ত্রাস। তিনি কেমন আছেন তাকে নিয়ে কি করা হচ্ছে কিছুই জানতে দেয়া হচ্ছে না। আমরা আশংকায় আছি দেশনেত্রীকে নিয়ে। তার অসুস্থতা পূর্বের চেয়ে ভিন্ন ও গভীর। আমরা চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় আছি। আসলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নিয়মিত ওষুধ সেবনে কোনো কারসাজি করা হচ্ছে কি না? সরকারপ্রধানের সরাসরি হস্তক্ষেপে পিজি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মনগড়া স্বাস্থ্য প্রতিবেদনে জামিন বন্ধ করে দেয়ার পর আমরা আশংকা করছি দেশনেত্রীকে প্রাণনাশ করার ভয়ংকার কোনো নীলনক্সা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না, কারণ তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ শামীম ও ডাঃ মামুনকে এখন আর দেখা করতে দেয়া হয় না। আমরা অবিলম্বে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ শামীম ও ডাঃ মামুনকে তার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়ার আহবান জানাচ্ছি। আমি এই মূহুর্তে দেশনেত্রীর নি:শর্ত মুক্তির দাবী করছি।
রিজভী বলেন, প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, একইভাবে এনআরসি জটিলতায় সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করে জোর করে বাংলাদেশে পুশ-ইন করার প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার এনআরসি বিষয়টিকে বারবার ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু আখ্যায়িত করে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে এনআরসি ইস্যুতে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দেয়া সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে কোনো মৌলিক ব্যবধান নাই। এমনিতেই ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ ভারাক্রান্ত। এর ওপর এনআরসির উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার তাদের ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির প্রমাণ হিসেবে যেভাবে নির্বিকার রয়েছে, তা স্পষ্টত:ই আমাদের জনগণ, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান।
রিজভী বলেন, লক্ষীপুর জেলার দত্তপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ফয়সাল খান জয়কে গতকাল (সোমবার) দুপুরে ঢাকা উত্তরা আবদুল্লাহপুর থেকে সাদা পোশাকধারী আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। আমি অবিলম্বে ফয়সাল খান জয়কে তার জনসম্মুখে হাজির করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, আব্দুল খালেক প্রমুখ।