প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণায় তর্কের খাতিরে সত্য বলে ধরে নেয়া হয় সেই পুরনো বচনটিকেই, ‘ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতির দিকে নিয়ে যায় এবং সর্বময় ক্ষমতা তাকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে।’ এ প্রবচনটিই সত্য। কিন্তু মানুষ প্রায়ই এটি মনে করে না। মানুষ যখন ক্ষমতাধর বা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে তখন তার আচার আচরণে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসে। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার লঙ্ঘন এবং একধরনের আচার আচরণ তাদের রুটিনে পরিণত হয়।
কাবুলের পতনের পর মনে হচ্ছে, তালেবানরা অনিশ্চিত বা আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। আইনশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি, কর্তৃত্ববাদী আচরণ এবং বিরোধীদের ওপর নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ গোটা তালেবান সরকারকে দূষিত করে তুলেছে।
তালেবানদেরকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও ভিন্নমতের মোকাবেলা করতে গিয়েই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। কাতারের দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাথে শান্তি আলোচনায় অংশগ্রহণকারী তালেবান নেতা মোল্লা গনি বারাদার, মুহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই ও মোল্লা আবদুল সালাম জারেফসহ বিশিষ্ট তালেবান নেতৃবৃন্দ এই বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন। তালেবান নেতৃবৃন্দের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক ও বিরোধের মূল কারণ হলো হক্কানি নেটওয়ার্কের যোদ্ধাদের স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গি। হক্কানি নেটওয়ার্কের ক্ষমতার অপব্যবহার ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান ও ডেপুটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজ উদ্দিন হক্কানি ও মোল্লা বারাদারের মধ্যে কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও অব্যাহতভাবে ‘ইসলামিক স্টেট খোরাসান’ প্রদেশের আবার উত্থান তালেবানদের জন্য অন্যতম বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তালেবানদের নিজেদেরকে রাষ্ট্রের মূল নায়ক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের রাজনৈতিক পরিচিতি ও যোগ্যতার বিষয় প্রমাণ করা এবং আন্তর্জাতিক বৈধতা বা স্বীকৃতি আদায় করাটাও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আইসিসকে অর্থাৎ ইসলামিক স্টেট খোরাসানের একটি সুবিধা হলো, তারা ননস্টেট অ্যাক্টর এবং আক্রমণাত্মক পন্থায় তাদের কার্যক্রম চালায়। কাবুলের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত আইসিসকে কাবুল, জালালাবাদ, কুন্দুজ ও কান্দাহারসহ বড় বড় শহরে হামলা চালিয়েছে। আইসিস খোরাসানের হুমকি আগেই প্রতিহত বা পণ্ড করে দেয়াটা তালেবানদের জন্য মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফগান নাগরিকদের ব্যাপকভাবে দেশত্যাগের ফলে মেধা পাচার বা দেশ মেধাশূন্য হওয়াটাও তালেবান সরকারের জন্য অপর একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক কমিশন জানিয়েছে, নিরাপত্তাহীনতা, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত ও নির্যাতনের কারণে ৬০ লাখেরও বেশি আফগান নাগরিক তাদের বাড়িঘর ও দেশ ত্যাগ করে স্থানচ্যুত বা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ পাঁচ লাখ আফগান তাদের বাড়িঘর থেকে পালিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে তালেবানরা মৌলিক সরকারি ও জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মারাত্মক প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
আন্তর্জাতিক বৈধতা বা স্বীকৃতি আদায় করাটা তালেবানদের জন্য প্রথম ও প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। এখনো কোনো রাষ্ট্র তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়নি। কূটনীতি, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, ব্যবসায় বাণিজ্য, আর্থিক ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বিষয় পরিচালনার পূর্বশর্ত হলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জন করা।
তালেবানরা জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করেছে এবং তারা আফগানিস্তান শাসন করার জন্য সবসময় যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা, টার্গেট কিলিং, সংখ্যালঘু ও নারীদের নিগৃহীত করা এবং বিরোধীদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। তালেবান শাসন কেমন, কিংবা সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে কি না, উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর সাথে তাদের সম্পৃক্ততা আছে কি না ইত্যাদি যাচাই না করে বা বিবেচনায় না এনে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া ভুল হবে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে।
অতীতে যারা ন্যাটো বাহিনীর সাথে এবং আগের আফগান সরকারের সাথে কাজ করেছে তালেবানরা তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। তালেবানবিরোধী লোকদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বহুলোককে গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তালেবানদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বহুলোক দেশত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের চেষ্টা করছে।
তালেবানদের নির্যাতনমূলক ও সহিংস দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত থাকলে আফগানিস্তানে নৈরাজ্য দেখা দেবে এবং রাষ্ট্রটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে- যেটা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তীব্র রাজনৈতিক দুর্নীতি, মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কট, সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যর্থতা, নিরাপত্তা দানে ব্যর্থতা, সামষ্টিক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করতে না পারা, উগ্রবাদিতা, মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা, অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রভাব এবং আরো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে এখন তালেবান সরকার।
এ সরকারকে স্থিতিশীলতা, সংহতি ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাহীনতা সামাল দিতে একটি লয়া জিরগা নিশ্চিতভাবে সাধারণ নির্বাচনের পথ খুলে দিতে পারে।
তালেবান নেতৃত্বকে অবশ্যই তাদের কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে উদার, গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা পোষণ করতে হবে এবং রাজনৈতিক বিরোধী ও অতীত আফগান সরকারের সাবেক কর্মকর্তাদের প্রতি উদার মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। প্রতিশোধ গ্রহণের নীতি তালেবানদের সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেবে।
গণতান্ত্রিক নীতি ও উদার মূল্যবোধের অনুশীলন বা বাস্তবায়ন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য তালেবানকে অবশ্যই গণতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি এবং নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। অবশ্যই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ক্ষমতা ধরে রেখে ভালোভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। চূড়ান্তভাবে, শিক্ষাও উন্নয়নসংক্রান্ত তালেবান নীতিতে যৌক্তিকভাবে নারীদের শিক্ষার অধিকার প্রদান এবং তাদের কাজের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তালেবান সরকারকে আফগানিস্তানে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট বার্তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করতে হবে।
লেখক : ইসলামাবাদ ভিত্তিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমসের সৌজন্যে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার