সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন

মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ব্যাটালিয়ন

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব:)
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ১৫৩ বার

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি অপারেশন ‘সার্চ লাইটের’ মাধ্যমে গণহত্যা শুরুর সাথে সাথে গর্জে ওঠেন সেনাবাহিনীর বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈনিকরা। শুরু হয় বিদ্রোহ, সবাই রুখে দাঁড়ান হানাদারদের বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হন দেশবাসী। মাত্র চার মাস গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে হানাদাররা নাস্তানাবুদ ও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। হানাদারদের বহু সদস্য নিহত হতে থাকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ আক্রমণে। এমতাবস্থায় সামরিক নেতৃত্ব বুঝতে পারেন যে, হানাদারদের দ্রুত পরাজিত করতে গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি নিয়মিত বা প্রচলিত যুদ্ধও শুরু করতে হবে; যে জন্য প্রয়োজন নিয়মিত ব্রিগেডের। সে আলোকে তিনজন সিনিয়র সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল সফিউল্লাহ ও লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে তাদের নামের আদ্যাক্ষর ‘জেড’, ‘এস’ ও ‘কে’ নামে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার লক্ষে ২৩ আগস্ট ১৯৭১ সালে ২ নং সেক্টরের অধীনে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম, ১০ম ব্যাটালিয়ন এবং ৩ নং সেক্টরের অধীনে ১১তম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার থেকে আদেশ জারি হয়; যা ছিল বিশে^র সামরিক ইতিহাসের যুগান্তকারী এক ঘটনা। কেননা, যুদ্ধকালীন সময়ে প্রথাগতভাবে কোনো ফাইটিং ইউনিট গঠন করার ঘটনা খুবই বিরল। তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে এ তিনটি পদাতিক ইউনিট গঠনের উদ্যোগ মেধাবী সামরিক অধিনায়কদের ব্রেইনচাইল্ড। এর মাধ্যমে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি কনভেনশনাল ওয়ার বা নিয়মিত যুদ্ধ পরিচালনা সহজ হয়ে যায় এবং মুক্তিযুদ্ধ এক আলাদা গতি পায়।

নবম ইস্ট বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের একটি অংশ হলো নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর নিক নেইম ‘চার্জিং নাইন’। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ‘চার্জিং নাইন’ ঐতিহ্যবাহী ইউনিটগুলোর মধ্যে অন্যতম; যেটি ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর অনেক চড়াই-উতরাইর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের ময়দানে জন্ম লাভ করেছিল। নবগঠিত ইউনিট হিসেবে চার্জিং নাইন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা ও সফলতার মাধ্যমে বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
প্রতিষ্ঠার হৃদয়বিদারক ইতিহাস : মুক্তিযুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণী পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এ ইউনিটের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনের ইতিহাস অত্যন্ত হৃদয়বিধারক। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর আগেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নবম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সদর দফতর থেকে আদেশ জারি হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে এ ইউনিট গঠনের পর্যায়ে ছিল। এ জন্য রিক্রুটরাও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) প্রশিক্ষণরত ছিলেন। নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মার্চের প্রথম দিকে ইউনিটের অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হতে মেজর আবু ইউসুফ মুশতাক আহমদ এবং অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হতে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনকে (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) বদলি আদেশ জারি করা হয়। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা এবং বাঙালি-পাকিস্তানি সম্পর্ক ক্রমে উত্তপ্ত হতে থাকে। অধিনায়ক মেজর মুশতাক গমনাদেশ নিয়ে নতুন ইউনিটে যোগদানের উদ্দেশ্যে ২৩ মার্চ সেনাসদরে ব্রিফিং নিতে গেলে প্রতিহিংসার ফলে নির্মমভাবে শহীদ হন তিনি। জানা যায়, পাকিস্তানি অফিসাররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালিদের সমন্বয়ে গঠিত দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্পর্কে কটূক্তি করলে মেজর মুশতাক দৃঢ় প্রতিবাদ করেন এবং অপমানজনক মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে জোর দাবি জানান। প্রতিবাদী ও দেশপ্রেমে বলীয়ান একটি কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতেই এই মেধাবী সেনা অফিসারকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চের সেই অভিশপ্ত রাতে হানাদার বাহিনী নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণরত রিক্রুটসহ ইবিআরসির সব রিক্রুটকে ঘুম থেকে উঠিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। এসব শহীদ রিক্রুটকে পরবর্তীতে ‘সৌম্য শক্তি ক্ষিপ্রতা’ পাহাড়ের পাদদেশে (বর্তমান কোয়ার্টার গার্ডের পাশে) গণকবর দেয়া হয়, যা আজ ‘অজানা শহীদ সমাধি’ হিসেবে পরিচিত।

কুমিল্লা সেনানিবাসের ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হতে বদলি হয়ে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদানকালীন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন উপরোক্ত ঘটনায় খুবই মর্মাহত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন। ৯ম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ও রিক্রুটদের নৃশংস মৃত্যুতে তিনি চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা না করে ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে পুনরায় চলে যান ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই তখনকার মতো যবনিকাপাত ঘটে ৯ ইস্ট বেঙ্গলের রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কর্মকাণ্ড।

মুক্তিযুদ্ধই গর্ভধারিণী : ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে অস্থায়ী সরকারের তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুনর্জাগরিত হয় ৯ম ই-বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা। ‘কে’ ফোর্স কমান্ডার লে: কর্নেল খালেদ মোশাররফ (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও সিজিএস) ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনকে নতুন ব্যাটালিয়ন ৯ম ইস্ট বেঙ্গল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করতে বলেন। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানি এবং ‘এ’ কোম্পানির একটি প্লাটুন নিয়ে ১০ অক্টোবর ১৯৭১ সালে ইউনিট প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় ব্যাটালিয়নের মাত্র দুইজন অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন মো: আইন উদ্দিন ও লেফটেন্যান্ট এম হারুন-আর-রশিদ (পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সেনাপ্রধান)। অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আশরাফ (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) উপ-অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করেন। ব্যাটালিয়নে যোগ দেয়ার পর ক্যাপ্টেন আশরাফকে দেবীপুর সাব-সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর সৈন্যদের দেবীপুরে অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাঠানো হয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মৌলিক কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি দিয়ে ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার কাজ মোটামুটিভাবে সম্পন্ন করা হয়। নবঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচের দুইজন নতুন কমিশন্ড অফিসার সেকেন্ড লে. শাহরিয়ার হুদা ও সেকেন্ড লে. খোন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রম (শহীদ) যোগ দেন এবং দু’জনেই কোম্পানি অধিনায়কের দায়িত্ব নেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে অবদান : প্রতিষ্ঠার পরপরই শত্রুদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত কসবা দখলের যুদ্ধের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ‘কে’ ফোর্সের ব্যাটালিয়ন ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের; যার কমান্ডে ছিলেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন। অপারেশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিধায় বিখ্যাত কসবা রণাঙ্গনে খালেদ মোশাররফ সরাসরি এ ইউনিটকে সহযোগিতা করেন। তার উপস্থিতি সৈনিকরা দারুণ উজ্জীবিত ও মনোবল দৃঢ় হয়। এ যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ গুরুতর আহত হন এবং তিনজন অফিসার ও ৪০ জন সেনা ও মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন, আহত হন ৬০ জন।

অতঃপর লেফটেন্যান্ট এম হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল চন্দ্রপুর ও লাকুমুড়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ২১ নভেম্বর। এ যুদ্ধে একজন অফিসার এবং তিনজন প্লাটুন কমান্ডারসহ ৩১ জন সৈনিক শাহাদাতবরণ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৯ পাঞ্জাবের একজন শিখ মেজরসহ ১২ জন নিহত হন ও প্রায় ৩০ জন আহত হয়। যদিও শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে আক্রমণ প্রত্যাহার করতে হয়েছিল, তথাপি অপারেশনটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। ১১ ও ১২ নভেম্বর কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি দখলের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের কুমিল্লার দিকে আরো পিছু হটিয়ে দেয়া হয়। ২ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ১৪ জন নিহত, ৪০৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দুইজন শহীদ ও একজন আহত হন। ১ ডিসেম্বর কুমিল্লার উত্তর এলাকা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হলে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ারবাজার এলাকায় সমাবেশ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ২ ডিসেম্বর ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসর হয়।

কুমিল্লা মুক্তকরণ : আক্রমণের পরপরই ব্যাটালিয়ন আবার পুনর্গঠন করে সকাল ৮টায় অগ্রাভিযান শুরু করে। লেফটেন্যান্ট হারুন অর রশিদকে অগ্রগামী দলের অধিনায়ক করা হয়। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্লা শহরের চার পাশে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা বিন্যাসের বিষয়টি বিবেচনা করে মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট ও ৯ম ইস্ট বেঙ্গল একই সময়ে আক্রমণ করে বিমানবন্দর ও কুমিল্লা শহর শত্রুমুক্ত করে। মুক্ত শহর কুমিল্লার জনসাধারণের মধ্যে আনন্দ ও খুশির বন্যা বয়ে যায়। শত্রু সৈন্যরা তখনো কিছু কিছু স্থানে অবস্থান করাতে ১০ ডিসেম্বর সকালের মধ্যে সমগ্র এলাকায় ৯ম ইস্ট বেঙ্গল ও মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এই দ্রুত সাফল্যে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল হীরা একই দিন সন্ধ্যায় ৯ম ইস্ট বেঙ্গলকে অভিনন্দন জানান।

মিরপুর মুক্তকরণ : ১৬ ডিসেম্বর দখলদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ শেষেও মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বসবাসরত ‘বিহারি’ সম্প্রদায়ের লোকজন ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করে ও স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেও তাদের এলাকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়াতে থাকে। ২য় ইস্ট বেঙ্গলের শক্তি বৃদ্ধির জন্য জেনারেল ওসমানী কর্তৃক ২৬ জানুয়ারি ৯ম ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুর অপারেশনে অংশ নেয়ার নির্দেশ দেয়ার পর ইউনিট ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মিরপুর পৌঁছায়। ৯ম ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুর ৬, ১০ ও ১১ সেকশন ঘেরাও করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ইউনিটের প্রধান কাজ ছিল বিহারিদের নিরস্ত্রীকরণ এবং দখলদার বাহিনীর দোসরদের হাতে নিখোঁজ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করা। এ সময় মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম নতুন অধিনায়ক হিসেবে ৯ম ইস্ট বেঙ্গলে যোগ দেন। সাবেক বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ইকবাল হোসেন চৌধুরী (পরবর্তীতে উপ-মন্ত্রী) যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসেছিলেন, তিনিও এই ইউনিটে কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে যোগ দেন। ৯ম ইস্ট বেঙ্গল মিরপুর পৌঁছানোর আগেই রেডক্রস, এমএসএফ ইত্যাদি এনজিও বিহারিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কার্যক্রম চালাচ্ছিল। এই এলাকায় তাদের উপস্থিতির ফলে বিহারিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সরকার এই এলাকার বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়; ফলে বিহারি এলাকায় পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। দুই সপ্তাহ পর বিহারিরা ভেঙে পড়ে এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ৯ম ইস্ট বেঙ্গলের সার্বিক প্রচেষ্টায় প্রায় তিন সপ্তাহ পর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মিরপুর এলাকা মুক্ত হয়। বিহারিদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত হয়। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। এ মুক্তির সংবাদে জেনারেল ওসমানী ইউনিটে গিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানান। খুশি হয়ে ইউনিটের পরিচিতি নাম ‘চার্জিং নাইন’ হিসেবে ঘোষণা দেন। মূলত মিরপুরে চার্জিং নাইনের হাত ধরেই অর্জিত হয় বিজয়।

মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের পথে ‘চার্জিং নাইনের’ অনেক অকুতোভয়, বীর সাহসী যোদ্ধা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এসব শহীদান ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের আত্মত্যাগের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেকটি দুর্ধর্ষ ও ঐতিহ্যবাহী ব্যাটালিয়ন হলো ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর পরিচিতি নামও ‘দুর্ধর্ষ দশ’। নামের সাথে এর কর্মের দারুণ মিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ ইউনিট ব্যাপক অবদান রাখে। যুদ্ধের আগেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীনেই ঢাকায় এটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যা ছিল মূলত ক্যাডেট প্রশিক্ষণ ব্যাটেলিয়ন। জাতীয় প্রতিরক্ষা স্কিমের আওতায় যুদ্ধকালীন প্রয়োজনে দ্বিতীয় পর্যায়ের সৈনিক হিসেবে স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের এ রেজিমেন্ট সামরিক প্রশিক্ষণদানে নিয়োজিত ছিল। প্রশিক্ষক ছাড়া সেনাবাহিনীর নিয়মিত কোনো সৈন্য এ রেজিমেন্টে নিয়োগ করা হতো না; যাদের ৫০% ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে, আর বাকি ৫০% ছিলেন পাঞ্জাব, বালুচ ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট থেকে। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ ১৯৭১ তারিখে এ ইউনিট ডিসবেন্ড ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধকে আরো বেগবান করতে সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর অনুরোধে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ২৩ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম, ১০ম ও ১১তম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ জারি করে। চিঠি অনুযায়ী ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ৯ম ইস্টবেঙ্গলের সাথে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে স্থগিত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আগের সদস্যরা ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ একীভূত করে ৭৫০ জনেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা সদস্যের সমন্বয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। এ পুনর্গঠিত ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করা হয় রাজনগর সাব-সেক্টরের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জাফর ইমাম বীর বিক্রমকে। বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন বিলোনিয়ার সুবার বাজারের বিপরীতে ভারতের রাজনগর সাব-সেক্টরে ব্যাটালিয়ন সদর দফতর স্থাপন করা হয়।

এ দিকে রাঙ্গামুড়া সাব-সেক্টরের সব সৈন্য নিয়ে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের আলফা (এ) কোম্পানি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান, বীর বিক্রমকে (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল)। সেই মোতাবেক অক্টোবরের শেষ দিকে রাঙ্গামুড়া ক্যাম্পটি সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে দিয়ে ‘এ’ কোম্পানি গঠন করা হয়। মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বাধীন এ ব্যাটালিয়নের চারটি কোম্পানিকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তার সাথে চারজন অফিসার ছিলেন। আলফা (এ) কোম্পানি- লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান, ব্রাভো (বি) কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মিজানুর রহমান, চার্লি (সি) কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন বৃহত্তর কুমিল্লার সালদা নদী থেকে আগত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট দিদার আতোয়ার হুসাইন। ডেল্টা (ডি) কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোখলেসুর রহমান। গোলাম মুস্তফা ছিলেন অধিনায়কের ইন্টেলিজেন্ট অফিসার (আইও), কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন মুজিব উদ্দিন চৌধুরী দুলাল।

এরপর নবগঠিত ব্যাটালিয়নটির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, যেকোনো মূল্যে বিলোনিয়া এলাকাটি পূর্ণ দখল করা। কারণ, ফেনী জেলার সীমান্তসংলগ্ন বিলোনিয়া পকেটটি অনেক বড় এবং যুদ্ধের সময় সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘কে ফোর্স’ গঠনের পর ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর জাফর ইমামকে বিলোনিয়া অপারেশন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইউনিটেরও যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। বিলোনিয়ার দ্বিতীয় এ যুদ্ধে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে এবং শত্রুকে পরাজিত করে অসাধারণ বিজয় অর্জন করে এবং মুক্ত হয় বিলোনিয়া। এটি ছিল একটি অসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অতি সফল ও সার্থক একটি অভিযান হিসেবে এটি ইতিহাসের পাতায় চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। বিশে^র যুদ্ধেতিহাস ও সামরিক মানদণ্ডে বিলোনিয়া যুদ্ধ এক ব্যতিক্রমী বীরত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এই যুদ্ধে শত্রুর বিরাট ক্ষতি হয়, নিহত হয় বহু অফিসার ও সৈনিক। বেঁচে যান কেবল দুইজন অফিসার ও ৭২ জন সৈনিক, যারা আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শনে অনেকেই বীরত্ব সূচক খেতাবে ভূষিত হন। এরপর ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আরো অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করে। ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্তের পর ৯ ডিসেম্বর মুক্ত করে নোয়াখালী। অতঃপর অভিযান শুরু করে চট্টগ্রাম অভিমুখে। পথিমধ্যে কুমিরা, সীতাকুণ্ডসহ শত্রুর অনেক ঘাঁটি ধ্বংস করে। ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছে রেলওয়ে স্টেশন দখল করে; ১৫ ডিসেম্বর হাটহাজারী শত্রুমুক্ত করে। অতঃপর চট্টগ্রাম মুক্ত করার অভিযানে অংশ নেয়। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে অবস্থান নিয়ে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করে।

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক (বিভিন্ন পদবির) শাহাদাতবরণ করেন ও অনেকেই আহত হন। ৯ জন ‘বীর বিক্রম’ ও ৪ জন ‘বীর প্রতীক’ জাতীয় বীরত্বপূর্ণ খেতাবে ভূষিত হন।

মুক্তিযুদ্ধে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা ও অবদান : ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (দুর্নিবার এগারো) প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধকে আরো বেগবান ও ত্বরান্বিত করতে সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর অনুরোধে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রবাসী সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ আগস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ম, ১০ম ও ১১তম ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ জারি করে। এ চিঠি অনুযায়ী ৩ নং সেক্টরের অধীনে ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ চিঠির আলোকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ফটিকছড়িতে ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয় যার ঐতিহ্যবাহী নাম ‘দুর্নিবার এগারো’।

বাংলাদেশ ফোর্সেসের ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনস্থ ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১০৩ সৈনিক এবং ৩ নম্বর সেক্টর হতে বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধা, ইপিআর, মুজাহিদ ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে এই ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়। তাছাড়া আগরতলা যুব শিবির হতে প্রায় এক হাজার বাঙালি যুবককে আগরতলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এক মাসের মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পর ৪০০ জনকে ‘এস ফোর্স’ সদর দফতরে এবং বাকি ৬০০ জনকে এই রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ২৮ অক্টোবর ১৯৭১ সালে আরো চারজন অফিসার অত্র ইউনিটে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মেজর আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম (পরবর্তীতে লে. জেনারেল ও সেনাপ্রধান) অধিনায়কত্ব গ্রহণ করার পর ‘দুর্নিবার এগারো’ যুদ্ধের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। এই ব্যাটালিয়ন ‘এস ফোর্সের’ অধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। উক্ত সময়ে ব্যাটালিয়ন কর্মরত অন্যান্য অফিসার ছিলেন উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, অ্যাডজুটেন্ট : সেকেন্ড লে. নাসির উদ্দিন, মেডিক্যাল অফিসার : লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মইনউদ্দীন, সেকেন্ড লে. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, সেকেন্ড লে. সামসুল হুদা বাচ্চু, সেকেন্ড লে. আবুল হোসাইন।

‘এস ফোর্সের’ অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ : ‘এস ফোর্স’ কমান্ডার লে. কর্নেল সফিউল্লাহ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও নবপ্রতিষ্ঠিত ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সমন্বিত করে নিয়মিত ব্রিগেড হিসেবে ‘এস ফোর্স’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ফোর্স গঠনে উক্ত দুই ব্যাটালিয়নের সৈন্য সংখ্যার ঘাটতি পূরণে সেক্টর ট্রুপস থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মুকুন্দপুর ও হরমুজপুর এলাকায় নিয়োজিত করা হয়।
এস ফোর্সের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সরাইল ও আশুগঞ্জ থানা এবং হবিগঞ্জ মহকুমা। কিন্তু নভেম্বর মাসের শেষ দিকে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে এস ফোর্স ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই সময় তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার আশুগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব হয়ে নরসিংদী মহকুমার রায়পুরা-নরসিংদী দখলপূর্বক নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জ হয়ে তারাবো ও ডেমরা দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। অক্টোবর থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এস ফোর্সের উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলোর মধ্যে ধর্মগড় এলাকায় মর্টার আক্রমণ (অক্টোবর প্রথম সপ্তাহ), মনোহরদী অবরোধ (২১ অক্টোবর), কলাছড়া চা বাগান অপারেশন (অক্টোবর শেষ সপ্তাহ), বামুটিয়া এলাকায় আক্রমণ (অক্টোবর) আশুগঞ্জে মেঘনা ব্রিজ ধ্বংস (নভেম্বর প্রথম সপ্তাহ) বিলোনিয়ার ১ম যুদ্ধ এবং ২য় বা চূড়ান্ত যুদ্ধ (০৪-২২ জুন ও ০২-০৭ নভেম্বর), মুকুন্দপুর বিওপি যুদ্ধ (১৮ নভেম্বর), আখাউড়া যুদ্ধ (০৩ নভেম্বর ও ০৫ ডিসেম্বর), ব্রাহ্মণবাড়িয়া আক্রমণ (০৬ ডিসেম্বর), সরাইলের পতন (০৮ ডিসেম্বর) ভৈরব ও আশুগঞ্জ যুদ্ধ (০৮-১১ ডিসেম্বর), ভৈরব যুদ্ধ (১০ ডিসেম্বর) কিশোরগঞ্জ সদর আক্রমণ (১১ ডিসেম্বর), হরপুর রেলসেতু এলাকায় যুদ্ধ (ডিসেম্বর) এবং নরসিংদী দখলের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অংশ : স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে এই ব্যাটালিয়ন ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর ভারত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের আখাউড়া, তেলিয়াপাড়া, ধর্মনগর, মনতলায় বিভিন্ন সামরিক অপারেশনে অংশ নেয়। ‘দুর্নিবার এগারো’ ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে উক্ত এলাকাসমূহ শত্রুমুক্ত করে। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার হারিসপুর-শাহবাজপুর অক্ষ অনুসরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে রওনা হয়। ব্যটালিয়নের অগ্রগামী দল তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তর্গত চান্দুরা এলাকায় পৌঁছার পর ইসলামপুরে অবস্থানরত ব্যাটালিয়ন সদর শত্রুর আকস্মিক আক্রমণের সম্মুখীন হয়। এতে ব্যাটালিয়নের চারজন সৈনিক (দুইজন ভারতীয় অপারেটরসহ) শহীদ হন এবং অধিনায়ক মেজর আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমসহ ৬ জন সৈনিক গুরুতর আহত হন (সর্বমোট আহতের সংখ্যা ১১ জন)। এ যুদ্ধে মেজর নাসিম আহত হওয়ার কারণে ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ মেজর মোহাম্মদ আব্দুল মতিন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল, জিওসি, ডিজি ডিজিএফআই, ডিজি দুদক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের দায়িত্ব নেন। ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগেই এই ব্যাটালিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়। তারপর দুর্নিবার এগার মিত্র বাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়নের সাথে একযোগে আশুগঞ্জ এলাকায় শত্রুর প্রতিরক্ষা অবস্থান দখলে আক্রমণ পরিচালনা করে। মিত্র বাহিনীর অভিযান প্রথমে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে যৌথভাবে তীব্র আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে আশুগঞ্জ এলাকা শত্রুমুক্ত করা হয়। অতঃপর ব্যাটালিয়ন আশুগঞ্জ এলাকায় সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। এ সময় শত্রু পশ্চাৎপসরণ করে যাতে ভৈরব এলাকা দিয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করতে না পারে সে জন্য বাধা দেয়ার গুরুদায়িত্ব এ ব্যাটালিয়নকে অর্পণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত আশুগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে এলাকা শত্রুমুক্ত করে।

অধিনায়ক মেজর নাসিমের যুদ্ধে আহত হওয়া : ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল চান্দুরার উত্তরাংশে একটি রোড ব্লক তৈরি করা, যাতে সিলেট থেকে পলায়নের পর পাকিস্তানি সেনারা এ দিকে না আসতে পারে। দ্বিতীয় কাজ হলো চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করা। ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাইকপাড়ায় পৌঁছলে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর নাসিম তার সেনাদলকে চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর, সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। লেফটেন্যান্ট নজরুল ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে অগ্রবর্তী কোম্পানি হিসেবে অগ্রসর হন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর আনুমানিক ১৩০০ ঘটিকায় ব্যাটালিয়ন পর্যবেক্ষক দল ইসলামপুরে অবস্থান করছিল। তখন সেখানে ব্যাটালিয়ন পর্যবেক্ষক দলে এস ফোর্স কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ, অধিনায়ক মেজর নাসিমসহ মাত্র আটজন সৈনিক অবস্থান করছিলেন। এ সময় ইসলামপুরে একটি বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্রমেই পিছু হটছিল।

পাকিস্তানিদের গাড়িকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ নিজেদের গাড়ি মনে করে ভুল করলেন। গাড়ি থামালে দেখা গেল, গাড়িতে পাকিস্তানি সেনা। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ সবাইকে হাত উঠাতে বললে কেউ কেউ হাত উঠাল। গাড়ির সামনে বসা পাঠান সুবেদার লাফ দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহকে ধরে ফেলে। এ সুযোগে পাকিস্তানি সেনারা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গুলি চালানো শুরু করে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহর সাথে বেশ কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর পেছনের দল ছিল বেশ পেছনে। অপর দিকে সামনের দলও বেশ এগিয়ে গেছে। ঘটনার শেষ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর পেছনের দলটি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। উভয়পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হলো। শেষ পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ, মেজর নাসিম প্রাণে বেঁচে যান। এ সংঘর্ষে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মেজর নাসিমসহ ৬ জন গুরুতর আহত হলেন। পাকিস্তানিদের ১১ জনকে জীবিত ধরা হয়। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর নাসিম আহত হওয়ায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ, মেজর মতিন ও মেজর আজিজকে সঙ্গে নিয়ে ৭ ডিসেম্বর পাইকপাড়ায় পৌঁছেন। এরপর মেজর মতিনকে ৭ ডিসেম্বর ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শনে ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনজন ‘বীর বিক্রম’, আটজন ‘বীর প্রতীক’ রাষ্ট্রীয় সামরিক খেতাবে ভূষিত হন।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলোচিত তিনটি ইউনিটের অসাধারণ অবদান আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে করেছে বহুগুণে গৌরবান্বিত।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com