ওষুধ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে খাবারের মতোই অত্যাবশ্যকীয় একটি দ্রব্য । প্রায় সবার ঘরে ওষুধ পাওয়া যায়। এমনকি একজন ভিক্ষুকের ঘরেও। শৈশবে দেখেছি জ্বর কিংবা ব্যথা হলেও কেউ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করত না। চিকিৎসক একটা পরামর্শ লিখে দিতেন তা দেখিয়ে দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হতো। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। অবস্থা এখন পাল্টেছে। এমন কোনো পাড়া বা মহল্লা নেই, যেখানে ওষুধের দোকান নেই। হাত বাড়ালেই ওষুধ পাওয়া যায়। ওষুধের দোকানের কর্মচারীরা এখন বড় পরামর্শক। বললেই তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবস্থাপত্র তারাই দিয়ে দেন। স্বল্প আয়ের মানুষগুলো ওষুধের দোকানে বেশি ধরনা দেন। এর কিছু অন্তর্নিহিত কারণও রয়েছে। অনেকে সামর্থ্য এবং সাহস না থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা নামকরা চিকিৎসকের পরার্মশ নিতে পারেন না। ফলে ওষুধের দোকানদার এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগায়।
পৃথিবীর অনেক দেশে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি হয় না। অথচ আমাদের দেশে চাওয়ামাত্রই ফার্মেসির দোকানদার দিয়ে দিচ্ছেন। কারণ কিছু কোম্পানির নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে যা বিক্রি করলে দিগুণ লাভ হয়। কিন্তু বেশি লাভের মুনাফায় মনের অজান্তেই তারা একজন মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায়, সামান্য জ্বর, সর্দি-কাশি হলেই মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন। অথচ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ার কিছু নিয়ম আছে। নির্দিষ্ট মাত্রা এবং মেয়াদে এসব ওষুধ খেতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি মানা হচ্ছে না। ফলে ওষুধের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে, বাড়ছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
বর্তমানে কিডনি রোগী বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যথানাশক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার। কিডনি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার ২০১৯ সালের জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছেন। আক্রান্ত রোগীর মধ্যে প্রতি বছর ৪০ হাজার রোগীর কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের ২০২০ সালের রিপোর্টে বলা হয়, কিডনি-সংক্রান্ত জটিলতায় ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ মারা গেছে। অর্থাৎ ২০২০ সালে কিডনি জটিলতায় ২৮ হাজার ১৭ জন মারা গেছেন, যা আগের বছর ২০১৯ সালে ১০ হাজার ৬২২ জন ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বলা হয়, অনিয়মিত মাত্রায় কম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে আমাদের শরীরের ক্ষতিকারক জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। সাধারণ চিকিৎসায় অনেক উঁচু মূল্যের অত্যন্ত সংবেদনশীল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা ছাড়া রোগ নিরাময় করা যাচ্ছে না। ফলে এগুলো একসময়ে প্রতিরোধী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আমাদের হয়তো চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের পরিমাণ খুবই সীমিত হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের সব দেশকে সাবধান করে দিয়েছে; কিন্তু অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি। এটি যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা দরকার।
শিক্ষিত কেমিস্ট ছাড়া ওষুধের দোকানের লাইসেন্স দেয়া উচিত নয়। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা ব্যথানাশক ওষুধ বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত ওষুধ তৈরি করছে কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন ও তা বাস্তবায়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয় জনবল বাড়ানো উচিত। চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন অডিটের ব্যবস্থা থাকা দরকার। যেন তারা অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথানাশক ওষুধের পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে সাবধানী হতে পারেন। একের বেশি অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেয়ার প্রবণতা পরিহার করা দরকার। পাশাপাশি ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সাবধানী প্রচার ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা দরকার। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একটা অসুস্থ জাতি বেশি দূর এগোতে পারে না। আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কাজে লাগানোর প্রয়াসে আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যের উন্নয়ন দরকার। মনে রাখা দরকার, বাঁচার জন্য ওষুধ, ওষুধের জন্য বাঁচা নয়।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ